গলিপথ-রাজপথ থেকে রাষ্ট্র-সমাজের ওপরতলা

‘রাস্তা দেখে হেঁটো’ প্রতিদিন প্রাতঃভ্রমণে বের হবার সময় কথাটা শুনতে হয়। আগে যখন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান ওষুধ গ্রহণের জন্য রমনা পার্কে যেতাম, তখন শুনতে হতো, ‘রাস্তা দেখে পার হইও।’

এখন রাস্তা পার হতে হয় না, এমন পথে হাঁটি। তবে ‘দেখে হেঁটো’ বাড়ির কর্ত্রী বলবেন না কেন? যতই বয়স বাড়ছে, ততই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছি। রাস্তায়-গলিতে ছোট-বড় পোস্টার, দেয়াল লিখন, ব্যানার, শীতের ভোরে রিকশায়-রাস্তায় মানুষের ঘুমিয়ে থাকা, মানুষের চলাচল প্রত্যক্ষ করা, কাজের মহিলাদের মোবাইলে কথা বলা প্রভৃতি উপভোগ করতে খুব ভালো লাগে। বাসা থেকে বের হয়ে দুই হাজার গলি দিয়ে ইস্কাটন গার্ডেন রোডে যাওয়ার জন্য রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রধান রাজপথ ইস্কাটন রোডের বাম দিকে যেতে হয়। 

প্রথমে পড়ে একশ’ ফুটের মতো উঁচু-নিচু ফুটপাতে তিনটে বড় আর ছোট গর্ত। পড়লে রক্ষা নেই। একদিন তো স্বপ্নই দেখলাম, সকালের কুয়াশাঘেরা পরিবেশে সুউচ্চ-সুদৃশ্য ভবন থেকে বের হতেই গর্তে পড়ে গেছি। বাঁচার জন্য চিৎকার করছি। ছাত্র-যুব বয়সে শরীরের মধ্যে অদৃশ্য থাকা প্রতিবাদী মনটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে গেছে। হাঁটতে গিয়ে প্রায়শই কানে আসে, বড় বড় সাহেবরা তো ফুটপাতে হাঁটেন না কিংবা গণপ্রতিনিধিরা তো রাতকানা। এসব শুনি কিন্তু প্রতিবাদে কিছু করতে পারি না।

রাজপথ পার হয়ে দুই হাজার গলিতে গেলেই মেলে পরম শান্তি। রাজপথ থেকে গলিটা মসৃণ, হাঁটতে বেশ। জনশ্রুতিতে কথা কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে। জালের মতো গলি এদিক ওদিক ঠিকই; কিন্তু দুই হাজার! অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষের কল্পনাশক্তি। ওই পথে হাঁটতে গিয়ে প্রায়শই ইতিহাসে অবগাহন করি। প্রশ্ন জাগে, গলিগুলো কি ছিল জমির আইল? হতেও পারে! ইস্কাটন শব্দটি নাকি এসেছে ‘স্কটল্যান্ড’ শব্দ থেকে। মানুষ কেবল কথা বাড়ায় কিংবা কমায়ই না, বিকৃত করতে করতে পরিবর্তন করে দেয়। 

নতুবা ভারত ব্রিটিশ রাজের অধীনে যাওয়ার আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে স্কটিশ ধর্ম প্রচারকদের গির্জা থাকার কারণে এলাকার নামটা এ যুগে এসে ইস্কাটন হবে কেন? গির্জার চিহ্ন আছে কি না জানি না। ইতিহাস এমন কেন জানি না; অনেক কিছুই কালস্রতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, যদি জমির আইল হয় হাজার গলি, তবে এলাকায় মানুষ্য বসতি হলো কবে? কবে গলিটা পাকা হলো। 

কখনো ভাবি কালস্রতে সব ভাসিয়ে নিতে পারে না। কিছু চিহ্ন রেখে যায়। হঠাৎই একদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি, ম্যানহোল পরিষ্কার করার জন্য ওয়াশা যে লোহার ঢাকনা বসায়, তাতে লেখা আছে সন। ১৯৯৫ পর্যন্ত লেখা পড়া যায়, দু-একটা আছে মানুষের পদচিহ্নে মুছে গেছে। স্মৃতি-বিস্মৃতির মধ্যেই থাকে ইতিহাস। কে বলতে পারবেন জানি না, কখন লোকালয় আর কখন মানুষের আধুনিক বসবাস গড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে পাগল মন ভাবে, এলাকার প্রবীণ কাউকে জিজ্ঞেস করি। শিকড়ের সন্ধান তো প্রাণরস জোগান দেয়, সামনে অগ্রসর হবার অনুপ্রেরণা জোগায়, পরক্ষণেই মনে হয়, জেনেই বা কী হবে! কে শুনবে কার কথা!

রাস্তায়-গলিতে যেমন থাকে গণমানুষের পদধুলি আর ইতিহাসের চিহ্ন, ঠিক তেমনি আমাদের দেশের দেয়াল হচ্ছে চলমান সমাজের প্রতিচ্ছবি। গণমানুষের মনস্তত্ব থেকে প্রয়োজন সবকিছু দেয়ালে প্রতিফলিত হয়। উন্নত দেশে এখন অনলাইন যে কাজটি করছে, গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন যা করে, এখনো তার অনেকটাই করে আমাদের দেয়াল। হাঁটতে হাঁটতে এগুলো প্রত্যক্ষ করে মনে বিমল আনন্দ অনুভব করি। কেননা তাতে সমাজের সামঞ্জস্য ও অসামঞ্জস্য সুস্পষ্ট হয়ে পড়ে। 

কত ধরণের যে কবিরাজ রয়েছে ঢাকায়, টিপরা নারী থেকে বাঙালি নারী সবই রয়েছে। তাঁদের মধ্যে আবার তন্ত্র-মন্ত্রের পিঠস্থান ভারতের কামরূপ-কামাখ্যা থেকে সিদ্ধিলাভ করা ব্যক্তিও রয়েছেন। তাদের কথা, স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া থেকে শুরু করে এমন কিছু অশুভ নেই যা শুভ করা যায় না। একই সঙ্গে দেয়ালে আছে আধুনিক হাসপাতালের নাম-ঠিকানা, মাদ্রাসার বিজ্ঞাপন তেমনি আছে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা মহফিল অনুষ্ঠানের পোস্টার- দেয়াল লিখন। নারী নির্যাতনের প্রতিবাদ, রয়েছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় হবু নেতাদের পোস্টার, তাতে তাদের ছবি বড় করে আর ক্রমে বড় থেকে ছোট হয়েছে এলাকার নেতা, ঢাকা সিটির নেতা ও বঙ্গবন্ধু-শেখ হাসিনা-সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবি। প্রচারে প্রসার  কথাটা নেড়েচেড়ে মনে মনে ভাবি কম বয়সের হবু নেতারা এসব ছাপানোর অর্থ জোগাড় করেন কিভাবে? অর্থ ছাড়া নেতা হবার পথ কি? আগে নেতা হতেন আন্দোলন-সংগ্রাম করে, আর এখন! পোস্টার ব্যানার ছাপিয়ে। 

ব্যানারগুলোর প্রয়োজন প্রচারের পরও ফুরায় না। রাস্তায় ঘুমায় এমন মানুষের তোশকের কাজ দেয় ব্যানার, রাস্তার দোকানি কিংবা বস্তির মানুষের বহু কাজে লাগে। ফ্লাইওভার কিংবা ওভারব্রিজের নিচটাও কিন্তু খুবই কাজে লাগে। এক দম্পতি ওভারব্রিজের নিচে ঘর-সংসার আর রিকশার গ্যারেজ করছে। 

কবিগুরু অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার ‘কিনু গোয়ালার গলি’ কবিতায় ছন্দের তালে তুলে লিখেছেন, ‘গলিটার কোণে কোণে/ জমে ওঠে পচে ওঠে/আমের খোসা ও আঁটি, কাঁঠালের ভূতি,/মাছের কানকা,/মরা বেড়ালের ছানা/ ছাইপাশ আরো কত কি যে!’ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে সুষ্ঠু আবর্জনা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ‘দুই হাজার গলি’তেই কেবল নয়, রাজপথেও ছাইপাশ কত কি যে পড়ে থাকে। আদিম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার আধুনিক ব্যবহার্য থেকে ছাইপাশ সবই জোটে গলিতে-রাস্তায়। তবে অনেক চেষ্টা করেও মরা বেড়ালের ছানা দেখতে পাইনি, পেয়েছি মরা বড় ইঁদুরের রক্তাক্ত দেহ। দেখে মজা-দুঃখ দুটিই পাই। রাজপথ-গলিপথের দু’পাশে দামি দামি সুউচ্চ ভবন, দামি দামি গাড়ি নামছে যত দ্রুত, ততটা উপযুক্ত মানুষের অভ্যাস, সাংস্কৃতিক মান ও ব্যবস্থাপনা দাঁড়াচ্ছে না। অসামঞ্জস্যতা সর্বত্র ছড়ানো-ছিটানো। অসামঞ্জস্যতাই সৃষ্টি করে সমাজে নানা ফাটল। ফাটলে আগাছা জন্মে, ক্রমে ফাটল বড় হয়। তারপর! এমন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা তো আমরা চাই, যা ছিল স্বাধীনতার মর্মবাণীতে, যেখানে অসাঞ্জস্যতা থাকবে না। ‘কত দূর আর কত দূর বল মা...’ হেমন্ত মুখার্জির এই গান এতটা প্রিয় হয় কি সাধে!

কয়েকদিন আগে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে দেখি, কাজী নজরুল ইসলাম রোডে দুই ছেলে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে নিষিদ্ধঘোষিত হিজবুত তাহরীরের ইসলামী বিপ্লবের পোস্টার লাগাচ্ছে। বেশ দূরে সামনে-পেছনে দু’জন পাহারা দিচ্ছে। পাহারাদাররা যেন পথচারী। পোস্টার লাগানোর দু’জনও এক সময় পথচারী হয়ে গিয়ে দ্রুত ওভারব্রিজ দিয়ে রাস্তার অপর পারে চলে গেল। কিছুদূর হাঁটার পরই পুলিশের দেয়ালে সাঁটা টিনের কয়েকটি সচেতনামূলক বিজ্ঞাপন দেখলাম। সেগুলোতে প্রকৃত ধর্ম প্রচারক ও উগ্রবাদী রিক্রুটারের পার্থক্য, উগ্রবাদী হওয়ার পথে যাওয়ার সময় পরিবর্তনের লক্ষণসমূহ এবং তা প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তৃত সব লিখা রয়েছে। ওই ঘটনার পর প্রতিদিন দেখি পথচারী কেউ সেসব বিজ্ঞাপন পড়ে কি না। পড়ছেন এমন একজনও চেখে পড়েনি। 

ওইদিন চার যুবক চলে যাওয়ার পর ভাবলাম, পোস্টারটা ছিঁড়ে ফেলি; কিন্তু পারলাম না। ভয়ে নাকি আড়ষ্ঠতায়! জানি না। প্রসঙ্গত বলি, বেশ কয়েক বছর আগে টাইলস কিনতে গিয়ে ওই সংগঠনের লিফলেট বিলি করতে থাকা একদল যুবকের মধ্যে একজন যুবকের হাত চেপে ধরেছিলাম। বুঝিয়েছিলাম, ওই দল নিষিদ্ধঘোষিত। একাজ করো না। ধরা পড়লে বিপদ হবে। মা-বাবা কষ্ট পাবে। তোমার জীবনও শেষ হবে। দলটি চলে যাওয়ার পর কেবল জীবন সঙ্গিনীর নয়, দোকানদারদেরও বকুনি খেয়েছিলাম। যদি থাকে ওদের হাতে পিস্তল! 

পোস্টার লাগানোর পরদিন দেখলাম, ওই জায়গায় পোস্টারটা নেই। সচেতন উদ্যোগী কেউ কি ছিঁড়েছেন! নাকি পুলিশ! যিনি বা যারাই ছিঁড়ুক, তার বা তাদের প্রতি মাথা নত করলাম। একটু এগোতেই বৈদেশিক কর্ম সংস্থান অফিসের সামনে দেখলাম, বিশাল বিশাল ব্যানারে লেখা: ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত বৈদেশিক কর্মসংস্থান ৭২ লাখ এবং প্রাপ্ত রেমিট্যান্স ১৯২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। শীতের ভোরের বেশ ঠান্ডার মধ্যে ওই অফিসের সামনে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক যুবক-যুবতীদের ভিড়। মনে মনে তাদের প্রতিও মাথা নোয়ালাম। 

প্রাতঃভ্রমণের যাবার আগে দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার প্রথম অংশের হেডিং দেখা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পরশু-গতকালের হেডিং নিম্নরূপ: রবিবার, গাড়ি বিলাসে ঢাকার দুই সিটি। রফতানি বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে গবেষণা ও ব্র্যান্ডিংয়ে: প্রধানমন্ত্রী। প্রথম বেতনের টাকা মায়ের হাতে দেবো: কনস্টেবল পদের নিয়োগ পাওয়া আপসিয়া। সোমবার-র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিবেচনার অনুরোধ: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি। করোনা শনাক্তের হার কিছুটা বাড়তি। শামিম ওসমান মাঠে নেই, আছে তাঁর ছায়া। বেসিক ব্যাংকে নিজের খুশিমতো নিয়োগ দিয়ে গেছেন আবদুল হাই। বাংলাদেশে স্বপ্নের এক দিন: নিউজিল্যান্ড টেস্ট। 

রাজপথ-গলিপথ নয়; এসব হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর তলার প্রতিচ্ছবি। কি অসামঞ্জস্য তাই না! পত্রিকা না থাকলে কী হতো কে জানে! প্রসঙ্গত, বলি পত্রিকার প্রথম পাতায় যা ওঠে, তা সবটা অতি গুরুত্বপূর্ণ এমন নয়, আবার গুরুত্বও রয়েছে। সর্বাংশে সত্য কিংবা সত্য নয়, অভিজ্ঞতা থেকে এমন সংশয়ও মাঝে মাঝে কাজ করে। পত্রিকা কেবল সমাজেরই প্রতিচ্ছবি নয়, মালিক ও সম্পাদকের ভাবনা-চিন্তারও প্রতিচ্ছবি। সে কথা আজ নয়। প্রশ্নটা হচ্ছে অসামঞ্জস্যতা আর ফাটলের। ঠিক রাজপথের বড় বড় গর্তের মতো। গলিপথের ছাইপাশের মতো। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের অসামঞ্জতা দূর হোক, রাজপথ-গলিপথেও, এটাই আজকের কামনা।


শেখর দত্ত
কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //