মানবতার মাঝি মিলন খান

রাত ৩টার দিকে দিয়াকুল গ্রামের সুগন্ধা নদীতে যাত্রীদের চিৎকার ও আগুন দেখে ট্রলার নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান মাঝি মিলন খান। জ্বলন্ত লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে যে সব যাত্রী ভাসছিলেন তাদের উদ্ধার করে পাড়ে নিয়ে যান। এ ছাড়াও রাত ৩টা থেকে সকাল পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০০ যাত্রীকে নদী পারাপারে তার ট্রলার দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিনে পয়সায় সহায়তা করেছেন। এলাকার লোকজনও তীরে ওঠা দগ্ধ, হাত-পা ভাঙা যাত্রীদের গরম পোশাক এবং দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। 

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বলছে, লঞ্চটিতে ৪০০ যাত্রী ছিল; তবে লঞ্চ থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অনেকের দাবি, নৌযানটিতে যাত্রী ছিলেন আট শতাধিক। ঢাকা-বরগুনা নৌপথে এখন ৬টি লঞ্চের রুট পারমিট থাকলেও কোনো দিন দুটির বেশি লঞ্চ চালানো হয় না বলে জানা যায়। ৬টি লঞ্চ চললে অতিরিক্ত যাত্রী হয় না, অতিরিক্ত যাত্রী না হলে অতিরিক্ত মুনাফাও হয় না। অতিরিক্ত যাত্রী টানার জন্য আগুনে ভস্মীভূত লঞ্চটিতে কিছুদিন আগে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ইঞ্জিন অনভিজ্ঞ মেকানিক দিয়ে সংযোজন করা হয়েছে।

লঞ্চের কর্মীদের জন্য ২২টি লাইফজ্যাকেট থাকলেও যাত্রীদের জন্য কোনো লাইফজ্যাকেট ছিল না। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ছিল ২১টি; কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করতে কোনো কর্মচারীকে দেখা যায়নি, কর্মচারীরা এই যন্ত্রগুলো ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলেও মনে হয় না। দেড় শতাধিক বয়া থাকলেও সেগুলো ছিল মেঝে থেকে ৯ ফুট উঁচুতে। অন্যদিকে সেগুলো রশি দিয়ে একটির সঙ্গে আরেকটি বেঁধে রাখার কারণে সহজে ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। 

গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার সদরঘাট থেকে বরিশাল-বরগুনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া একটি লঞ্চে পথিমধ্যে রাত ৩টার দিকে আগুন ধরে যায়। আগুন লাগার প্রাথমিক অবস্থায় লঞ্চটি কূলে ভেড়ানোর জন্য যাত্রীদের অনুরোধে কর্ণপাত না করে স্টাফরা যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়ে ব্যস্ত ছিল; তাদের বক্তব্য ছিল, ‘ভয় নেই, আগুন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে’। মনে হয়, ইঞ্জিনে যারা ছিল তারা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু ইঞ্জিন রুমে প্রচুর জ্বালানি তেল থাকায় আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যে তেলের ড্রামগুলোতে বিস্ফোরণ হতে থাকে এবং আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

যারা সাঁতার জানতো তারা মাঝ নদীতেই ঝাঁপ দিয়েছে, সাঁতার জানলেও যাদের সঙ্গে সন্তান বা বৃদ্ধ মা-বাবা ছিলেন তারা ঝাঁপ দেননি, তাদের কেউ কেউ স্বেচ্ছায় আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। যারা সাঁতার জানতো না তারা আগুনে বা পানিতে ডুবে মরেছে। অনেকের মতে চালক এক সময় লঞ্চটিকে তীরে ভীড়াতে সমর্থ হয়, আবার অন্য মতে ইঞ্জিন অচল থাকায় লঞ্চটা স্রোতের টানে এক সময় তীরে চলে এলে সম্মুখে যারা ছিল তারা লাফ দিয়ে কূলে ওঠে। কিন্তু নোঙর না করেই চালক ও স্টাফরা নেমে যাওয়াতে জ্বলন্ত লঞ্চটি আবার প্রায় ৪৫ মিনিট ভাসতে ভাসতে অন্য তীরে গিয়ে থামে। প্রথমে লঞ্চটি নোঙর করা হলে হয়তো আরও অনেক যাত্রী বেঁচে যেত। 

নানা অব্যস্থাপনা ও দুর্ঘটনা সত্ত্বেও নদীপথে ভ্রমণ সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক বিবেচনা করা হয়ে থাকে; কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনার সুরাহা হয় না বলে নৌ দুর্ঘটনা কমে না। লঞ্চের নকশা সঠিক থাকে না বলে লঞ্চের কাঠামো হয় ত্রুটিপূর্ণ। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করার কথা নতুন নয়, দুর্ঘটনার পর কিছুদিন সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, সময়ের ব্যবধানে সবাই তা ভুলে যায়।

অদক্ষ চালকের বেপরোয়া চালানোর জন্যও নদীপথে মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। যানবাহন চালানোর প্রতিযোগিতা শুধু সড়কে হয় না, নদীপথেও হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া লঞ্চডুবির আরেকটি কারণ; আবহাওয়া সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য পাওয়ার আধুনিক ব্যবস্থাদি সব লঞ্চে নেই। তবুও দক্ষিণ বাংলার চাকরিজীবীরা নদীপথে ভ্রমণে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন; কারণ সারাদিন অফিস করে রাতের লঞ্চে ঘুমিয়ে ভোরে গন্তব্যস্থলে পৌঁছা যায় এবং ফেরতপথে রাতে উঠে ঘুম দিয়ে সকালেই ঢাকা।

ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে সদরঘাট পৌঁছানোর কষ্টদায়ক ভ্রমণের তুলনায় নদীপথে লঞ্চে ভ্রমণ অনেক বেশি আরামদায়ক। লঞ্চে ভ্রমণ আরামদায়ক হলেও খুব নিরাপদ বলা যাবে না; এক সময় ঘন ঘন ডাকাতি হতো। ডাকাতি রোধ করার জন্য সশস্ত্র আনসার নিয়োগ দেয়ার পর ডাকাতি কমেছে, কিন্তু বেড়েছে আনসারের যাত্রী হয়রানি। আনসারদের সঙ্গে ডাকাতদের সখ্য থাকার অভিযোগও শোনা যায়।

লঞ্চ, স্টিমার, কারখানা, অফিস-ভবন, দোকান যেখানেই আগুন লাগুক না কেন মামলা হয় এগুলোর মালিকের বিরুদ্ধে, অনুমোদনকারী বা তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়। লঞ্চের একজন মালিক এবং দুইজন মাস্টারকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। কেন দুর্ঘটনা ঘটলো, কারিগরি কোনো সমস্যা ছিল কী না, তা না খুঁজে চালক আর মালিককে গ্রেফতার করা মুখ্য হয়ে ওঠে। তাই দুর্ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে চালক, হেলপার, মালিক পালাতে থাকে।

কোনো মালিক চান না দুর্ঘটনায় তার লঞ্চ, স্টিমার, বাস, ট্রাক, ভবন, কারখানা ধ্বংস হোক বা আগুনে পুড়ে যাক। চালকের ভুল থাকতে পারে এবং ভুলের মাশুলও তাকে দিতে হবে। তবে অবহেলা থাকলে তা অপরাধ। অতি লোভে মালিক অনেক প্রয়োজনীয় শর্ত অপূর্ণ রেখে দেয়; এই অপূর্ণ রাখার ক্ষেত্রে অনুমোদন প্রদানকারী কর্তৃপক্ষও দায়ী। অপরাধ এবং ত্রুটি ঢাকার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির উদ্ভব। দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক পক্ষকে গ্রেফতার করা হলেও আরেক পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায়ও আনা হয় না। 

বাংলাদেশকে সব সম্ভবের দেশ বলা হয়; কারণ আমাদের দেশে দুর্ঘটনার পর জানা যায়- বাস, লঞ্চ, ট্রাক ইত্যাদির ফিটনেস সার্টিফিকেট ছিল না, অথবা গাড়ি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স ভুয়া। শুধু তাই নয় আগুনে পুড়ে মরার পর প্রমাণিত হয় কারখানা বা ভবন গড়ে উঠেছে বিনা অনুমোদনে, অথবা ভবন নির্মাণে অনুমোদিত নক্সা অনুসৃত হয়নি। ঢাকা শহরে এতগুলো খাল বেদখল হয়ে গেল, খালের ওপর বহুতলা ভবন নির্মাণ করে বাপ-দাদার আমল থেকে বসবাস করে আসার পর এখন ওই সকল ভবন অবৈধ। বহু বছর জমির খাজনা নেয়ার পর সিটি করপোরেশন এখন বলছে জমিটি তাদের। যারা খাজনা নিয়েছে তাদের জবাবদিহিতা কখনো হয় না, খাল ভরাট হয়ে ভবন নির্মাণ হলো, অথচ খালের মালিকের ঘুম ভাঙেনি। কেন খালের মালিক খাল ভরাটের সময় বা ভবন নির্মাণের সময় সজাগ ছিলেন না - এই জবাবদিহিতা কখন নিশ্চিত করা হবে? স্টিমার বা লঞ্চ ডুবলে বলা হয় ‘অতিরিক্ত যাত্রী’ ছিল। প্রশ্ন করলে কমন উত্তর ‘তদারকির জনবল নেই’।

প্রতিটি সেক্টরে জনবলের এত অভাব? অভাব হলে প্রতিটি সরকারের শাসনামলে শত শত কর্মকর্তা ওএসডি থাকেন কী করে? অনেক অফিসে কর্মচারী আর কর্মকর্তাদের অলস বসে থাকতে দেখা যায়- চা, বিড়ি, পান খেতে বের হলে কয়েক ঘণ্টা আর সিটে ফেরত আসেন না। যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে অতিরিক্ত লোকবল, আর যেখানে প্রয়োজন সেখানে লোকবলের মারাত্মক ঘাটতি। দুর্নীতির ব্যাপকতা রোধ করা যাচ্ছে না। যারা তদারকিতে আছেন তাদের নজরদারি না থাকলেও নজরানা থাকে; শুধু তাদের নয়, তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্যও নদীপথে ভ্রমণে বিনে পয়সায় ভিভিআইপি রুম বরাদ্দ থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাই লঞ্চের বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা স্থায়ী রূপ নিয়েছে। 

গত ৫০ বছরে সাত শতাধিক নৌ দুর্ঘটনায় পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়েছে। কমিটি গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তা নিয়ে উপহাস করে; কারণ এই সকল তদন্ত প্রতিবেদনে আদৌ কোনো কাজ হয় বলে মানুষ বিশ্বাস করে না। সাতশত প্রতিবেদনে নিশ্চয়ই দুর্ঘটনা রোধে অজস্র সুপারিশ রয়েছে; সুপারিশগুলোর পরিপালন বা বাস্তবায়ন হলে ভুল-ত্রুটি বা অবহেলার পুনরাবৃত্তি হওয়ার কথা নয়, নৌ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে চলে আসার কথা। মনে হচ্ছে, কোনো কমিটি উপযুক্ত সুপারিশ করেনি, অথবা করলেও তা বাস্তবায়নের গরজ কারো নেই। দেশের লোকসংখ্যার আধিক্য সব সমস্যার মূল কারণ। জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্বেও মানুষ বাস-ট্রেনের ছাদে ওঠে, ট্রেনের দুই বগির মাঝখানে শিশু সন্তান কোলে নিয়ে বসে থাকে, ধাক্কাধাক্কি করে লঞ্চে উঠে ডেকে গাদাগাদি করে বসে থাকে।

অগণিত লোকের চাহিদা পূরণে সরকার গলদ্ঘর্ম। ছোট্ট এই বাংলাদেশে যেভাবে লোকসংখ্যা বাড়ছে এই সমস্ত সমস্যা সমাধান না করলে তাতে দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব হবে না। মিলন খান মাঝির মতো এখনো কিছু লোক আছে বলেই দেশ নরকে পরিণত হয়নি।


জিয়াউদ্দীন আহমেদ
সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //