কে বেশি কর্তৃত্ববাদী, রাজনীতিক না আমলা?

আমলা বনাম রাজনীতিবিদ এই দ্বন্দ্ব পুরনো এবং পৃথিবীজুড়ে দীর্ঘ দিন ধরে অব্যাহত আছে। কট্টর সমালোচকরা একে শাশুড়ি-বউয়ের দ্বন্দ্ব হিসেবেও আখ্যায়িত করতে ছাড়েন না। মূলত দু’পক্ষের কেউই রাষ্ট্রের মালিক নন। রাষ্ট্রের মালিক সাধারণ জনগণ। রাজনীতিবিদরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সরকার পরিচালনায় আসেন।

অন্যদিকে সরকারের নীতি ও আইন বাস্তবায়ন করেন আমলারা। দু’পক্ষই অপরিহার্য; কিন্তু আমলারা নির্বাচিত সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ সম্পাদন করে থাকেন। এখানেই দ্বন্দ্ব। রাজনীতিকরা ভাবেন আমলারা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করছেন না। আবার আমলারা ভাবেন রাজনীতিকরা সঠিক বা জনসম্পৃক্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। 

রাজনীতিকদের তুলনায় আমলারা বেশি কর্তৃত্ববাদী বলে মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি কর্মজীবনে সরকারের বড় আমলা ছিলেন এবং সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে ডেভেলপমেন্ট জার্নালিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশের (ডিজেএফবি) এক অনুষ্ঠানে একথা বলেন তিনি।

পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, এ অঞ্চলে রাজনীতিবিদদের তুলনায় আমলারা অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী। আমাদের দেশেও আমলারা কর্তৃত্ববাদী। ‘কেননা আমরা বিনিয়োগকারীদের জন্য ফুলের মালা আর দুধ নিয়ে বসে থাকি। তাদের আহ্বান জানাই এদেশে এসে বিনিয়োগ করার জন্য; কিন্তু তারা যখন বিমানবন্দরে নামেন তখন হয়রানির শিকার হন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিনিয়োগকারীদের বলেন আসুন, বিনিয়োগ করুন; কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এসে আমলাতন্ত্রের কাছে মার খান।’

দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বলেও জানান মন্ত্রী। ডিজেএফবির সভাপতি হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ও পরিকল্পনা সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী। ‘এলডিসি উত্তরণ : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। 

এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রী ১০ জুন রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিসংখ্যান ভবনে বিবিএস গ্লোসারি (কনসেপ্টস অ্যান্ড ডেফিনিশান) শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, আমলাতন্ত্রের বিকল্প শূন্যতা। আর জীবনে শূন্যতা মানে ভয়ংকর কিছু।

মন্ত্রী বলেন, বেতন-ভাতাসহ সরকার সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়েছে। এটা নিয়ে আমরা নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হই বাইরে। আমলাতন্ত্রের প্রশংসা করি; কিন্তু এটা তাদের মাথায় তেল দেওয়ার জন্য নয়। আমলাতন্ত্রের যে কত প্রয়োজন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সব পর্যায়ে কর্মকর্তাদের উচিত, মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ বাড়ানো। ইউএনও, ডিসিসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উচিত, স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান এমনকি মেম্বারদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো। 

অন্যদিকে ৮ জুন ২০২১ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, ‘আমলাতন্ত্র মন্দ নয়। আমলাতন্ত্র ভালো। আমলাতন্ত্রের বিকল্পওতো নাই। কেউ আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর বিকল্প বের করতে পারেনি। চীনারা পারেনি। ফেরাউনও পারেনি। খলিফারাও পারেনি। সেই আমলাতন্ত্র আমাদের মাঝেও আছে।’

সংবাদ সম্মেলনে আমলাতন্ত্রের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে একনেক সভায় সাভারে বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ একটি প্রকল্পের তথ্য তুলে ধরতে গিয়ে। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘আমি নিজেও এক সময় ছোটখাটো আমলা ছিলাম। মনে প্রাণে এখনো বড় আমলা আছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কেটেছে আমলাতন্ত্রের ভেতরে। সেই আমলাতন্ত্রের জন্য তাদের যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে সাভারে, সেটির আধুনিকায়ন, সংস্কার, ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, প্রশস্ত, সব কিছু করব। সেখানে ২০ তলা অত্যাধুনিক ভবন হবে। তবে আশা করছি তাদের কাজের গতিও আধুনিকায়ন হবে।’

আবুল মনসুর আহমদ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন- ‘কিছু দিনের মধ্যে একটা ব্যাপারে আমি মনে ভিষণ আঘাত পাইলাম। অপমান বোধ করিলাম। দেখিলাম, আমাদের বাড়ির ও গাঁয়ের মুরুব্বিরা নায়েব আমলাদের সঙ্গে দরবার করিবার সময় দাঁড়াইয়া থাকেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝি নাই। আরও কিছু দিন পরে জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদের নায়েব-আমলারা ‘তুমি’ বলেন। নায়েব আমলারা আমাদেরও ‘তুই তুমি’ বলিতেন। আমরা কিছু মনে করিতাম না। ভাবিতাম, আমাদের মুরুব্বিদের মতোই ওরাও আদর করিয়াই এমন সম্বোধন করেন। পরে যখন দেখিলাম, আমাদের বুড়া মুরুব্বিদেরেও তাঁরা ‘তুমি’ বলেন, তখন খবর না লইয়া পারিলাম না।

জানিলাম, আমাদের মুরুব্বিদেরে ‘তুমি’ বলা ও কাছারিতে বসিতে না দেওয়ার কারণ একটাই। নায়েব আমলারা মুসলমানদের ঘৃণা করে! হাতে-নাতে এর প্রমাণও পাইলাম। পাশের গাঁয়ের এক গণক ঠাকুর আমাদের বাড়িতে ভিক্ষা করিতে আসিত। কিছু বেশি চাউল দিলে সে আমাদের হাত গণনা করিত। আমাদেরে রাজা-বাদশা বানাইয়া দিত। এই গণক ঠাকুরকে দেখিলাম একদিন নায়েব মশায়ের সামনে চেয়ারে বসিয়া আলাপ করিতেছে। নায়েব মশাই তাকে আপনি বলিতেছেন। এই খালি-পা খালি-গা ময়লা ধুতি-পরা গণক ঠাকুরকে নায়েব বাবু এমন সম্মান করিতেছেন কেন? আমাদের বাড়িতে তাকে ত কোন দিন চেয়ারে বসিতে দেখি নাই।

উত্তর পাইলাম, গণক ঠাকুর হিন্দু ব্রাক্ষ্মণ। কিন্তু আমাদের মোল্লা মৌলবিদেরও ত নায়েব-আমলারা ‘আপনে’ বলেন না, চেয়ারে বসান না। আর কোনও সন্দেহ থাকিল না আমার মনে। রাগে মন গিরগির করিতে লাগিল। ... বেআদব বেত্তমিয, তুই নায়েব বাবুরে ‘তুই’ কইলি কোন আক্কেলে? এবার আমি মুখ খুলিলাম। বলিলাম : আমারে তুই কইল কেন? দাদাজী কিছুমাত্র ঠান্ডা না হইয়া বলিলেন : বয়সে বড় তোর মুরুব্বি। তানি তোরে ‘তুই’ কইব বইলা তুইও তানরে তুই কইবি? এই বেত্তমিযি তুই শিখছস কই? আমরা তোরে তুই কই না? নায়েব বাবু তানার ছাওয়ালরে তুই কয় না? আমি দাদাজীর দিকে মুখ তুলিয়া নায়েব বাবুকে এক নযর দেখিয়া লইয়া বলিলাম : আপনে বাপজী কেউই তো বয়সে ছোট না, তবে আপনেগরে নায়েব বাবু ‘তুমি’ কয় কেন? দাদাজী নিরুত্তর। কারও মুখে কথা নাই। নায়েব আমলাদের মুখেও না।’

এই দুঃখ, বেদনা, সামাজিক বিভাজন, সাংস্কৃতিক বৈপরীত্য থেকে বাঙালি বেরোতে পারেনি আজও। পারার দৃশ্যমান চেষ্টাও চর্চিত হয়নি। ফলে, সেদিনের সেই বিষবৃক্ষ এই বাংলায়-তাদানীন্তন পূর্ববঙ্গে বহাল তবিয়তে টিকে আছে, যা আমাদের জন্যে লজ্জার। শুধু প্রেক্ষাপট বদল হয়েছে, সেদিনের হিন্দুত্বের জায়গায় আধিপত্য গেড়েছে বাঙালি মুসলমান। এই আধিপত্যে পিষ্ট হয়ে আবুল মনসুর আহমদ যেমন দুঃখ পেয়েছিলেন, রাগে গিরগির করেছিলেন। আমরা কি লক্ষ্য করছি, আজ সেই রাগ গিয়ে জায়গা করে নিয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের মনে। বড়র যে ভূমিকা পালন করার কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি সেটা পালন করছে, এই প্রশ্ন আজ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সেদিনের সেই সামাজিক বিভাজন কি আজও বাস্তবে রয়ে যায়নি? রয়েছে নিশ্চয়। রয়েছে বলেই শ্রীযুক্ত নারায়ণ চন্দ্র রায়রা এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেন যাচ্ছেন তা নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক থাকতে পারে, রাজনৈতিক চাপানউতোরের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু এর পেছনে যে সামাজিক বিভাজনই মূলত দায়ী, তা আমরা তালাশ করি না। 

নারায়ণ বাবুর চৌদ্দ পুরুষের জন্ম বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলা সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী এলাকায়। সর্বশেষ বসত গেড়েছিলেন ফিলিপনগর ইউনিয়ন পরিষদের ফিলিপনগর গ্রামের হিন্দুপাড়ায়। ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। পার্শ্ববর্তী বৈরাগীর চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন এবং সেখান থেকেই যান অবসরে। তার হাতেই কত ছেলেমেয়ের জ্ঞানের দিব্যচোখ খুলে গেছে ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সেই শিক্ষকও আমৃত্যু এদেশে থাকেননি (পড়ুন থাকতে পারেননি)। তিনিও দেশ ছেড়েছেন, ছেড়ে গেছেন প্রিয় হিন্দুপাড়া, ফিলিপনগর, দৌলতপুর, কুষ্টিয়ার সঙ্গে গড়ে ওঠা অভিন্ন আত্মার বন্ধন। 

সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন ঘটানোর বিকল্প নেই। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পারষ্পরিক সম্পর্ক যেমন পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে পুনর্নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনি সাধারণ জনগণের সঙ্গে তাঁদের অঙ্গীকারের বিষয়টিও সামনে এনে ঢেলে সাজানোর আবশ্যকতা আছে। স্বাধীন দেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে গণমুখী প্রশাসন তথা ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। আমাদের নিজেদের অবস্থান ও আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন আনার অবকাশ রয়েছে। কারণ জনগণ দেশের মালিক। অন্যদিকে রাজনীতিবিদ ও আমলা ভিন্ন স্তরের সেবক; কিন্তু দেশের মালিক নন।


প্রণব চক্রবর্তী
কথাসাহিত্যিক ও
সাবেক অতিরিক্ত সচিব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //