এম আর খায়রুল উমাম
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৫৯ এএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৫৯ এএম
জীবন জীবনের জন্য কথাটা সাভারে রানা প্লাজায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল। দল, সম্প্রদায়, লিঙ্গগত পরিচয় উদ্ধারকর্মীদের মধ্যে ছিল না। ধ্বংসস্তুপে আটকে পড়া দুর্গতদের উদ্ধারে পরিচয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। মনের সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে জীবন বাঁচানোর তাগিদে মানুষ মানুষের জন্য এগিয়ে গিয়েছিল। অভিজ্ঞতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্তু মনের জোর অসাধ্য সাধনে ব্রতী করে তুলেছে। মানুষের এমন সংশ্লিষ্টতা জাতির এক পরম পাওয়া।
জীবনের নিরাপত্তা নেই, মানবিক বিপর্যয় সামলানোর অতীত অভিজ্ঞতা নেই, সাজ-সরঞ্জাম নেই তা সত্ত্বেও কয়েকদিন আটকে থাকা এত মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। পরিকল্পিত উদ্ধার কাজ বাধাগ্রস্থ হয়েছে, অনেক সময় সমন্বয়হীনতাও দেখা গিয়েছে। সাধারণ মানুষ উদ্ধারকারীদের পাশে সবকিছু নিয়ে হাজির ছিল। উদ্ধার কাজে বা চিকিৎসার কোনো অভাবের কথা প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় উপকরণ ঘটনাস্থলে পৌঁছে দিয়েছে। লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরে কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। জাতির এই বিশাল প্রাপ্তি ও সাফল্য আগামী দিনের পাথেয় হয়ে থাকবে।
সাভার ট্র্যাজেডি মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে নাড়া দিয়েছে। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে অনেকেই মনে করেন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এখন মানুষ পাওয়া কঠিন। মানুষের আবেগ-অনুভূতির জায়গাটা নৈতিক অধঃপতনের কারণে যথাযথ কাজ করে না। দলাদলি, হানাহানি, মারামারি, সাম্প্রদায়িকতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, হত্যার খেলায় হিংস্র মানুষরূপী পশুদের আচরণ দেখে মানুষ তার মানবিক গুণাবলী ভুলে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের ক্ষমতাবানদের অন্ধত্ব ও সংকীর্ণতাকে ঠেলে সরিয়ে স্বরূপে বের হয়ে আনতে পারে তা এবার সাভার ট্র্যাজেডি প্রমাণ করলো। জাতি সাভার ট্র্যাজেডির সাফল্যের মর্মবাণী উপলব্ধি করে যদি দাঁড়াতে পারে তবে তারা অনেক জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারবে। রাজনীতির জন্যও এটা শিক্ষার। প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞ প্রাণকর্মী ও সরঞ্জামের অভাব সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ কী অসাধ্য সাধন সম্ভব।
আমাদের রাজনীতিতে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির লোভ মানবতাকে নাড়া দেয় না। হরতাল, ধর্মঘট, দাঙ্গা,সংঘাত, মারপিট, ইত্যাদি সবকিছুই সচল ছিল। সরকারি ও বিরোধীদলের দায়িত্বশীল রাজনীতিকরা নিজেদের দাপট বুঝাতে উল্টো পাল্টা বক্তব্য হত্যার ঘটনা সংঘাতে লিপ্ত থেকেছে। জামায়াত হরতাল দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ধর্মঘটে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ মানবিক দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছে সবকিছু পেছনে ফেলে কিন্তু আমাদের রাজনীতি জাতির মানবিক বিপর্যয়কে স্মরণেই রাখতে পারলো না। সাভার ট্র্যাজেডি সাফল্যের মাইলফলক হলেও রাজনীতির জন্য লজ্জার মাইল ফলক হয়ে থাকবে।
আমাদের শিক্ষিত পরিপক্ক আমলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর সংস্কৃত প্রবচন ‘সর্বনাশং সমুৎপন্নে আর্ধং ত্যজতি পণ্ডিত’ এর মতো বিরোধীদলের ওপর দায় চাপিয়ে দিলেন। সাভারের রানা প্লাজা ধসের জন্য হরতালকারীদের স্তম্ভ ধরে ধাক্কাধাক্কি দায়ী হতে পারে বলে বিস্ময়কর বিশেষজ্ঞ মতামত প্রকাশ করেন। দেশ এখন ভবনের ফাটল আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে। মন্ত্রী মহোদয় যে কোনো একটা ফাটল ভবনে ধাক্কা ধাক্কি করে ফেলে দিয়ে তার বিশেষজ্ঞ মতামতের যথার্থতা প্রমাণ করতে পারেন। শুধু সংবাদকর্মীদের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা সাধারণ মানুষকে দেখতে হতো না।
বিরোধীদলের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বললেন দুর্ঘটনায় নিহতদের আগামীতে তার দল ক্ষমতায় গেলে ২০ লাখ টাকা করে দেবেন। আজকের বিরোধীদল বিএনপি ক্ষমতাসীনকালে যে মানবিক বিপর্যয়গুলো ঘটেছিল সেখানে মওদুদ সাহেবরা কত টাকা করে দিয়েছিলেন তা কি তাদের মনে আছে? ২০০৪ সালে শাঁখারী বাজারের ভবন ধস, ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস, ২০০৬ সালে ফিনিক্স ভবনের কথা ভুলে গেলে চলবে? ক্ষমতায় গিয়ে সংবাদকর্মীদের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়িয়ে যাবেন?
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের ক্ষমতাধররা ভীষণ বোকা ভাবেন। প্রকৃত অর্থে এরা বোকা কি না জানি না তবে সাধারণ মানুষ ভদ্র এটা জোর দিয়ে বলা যায়। সাধারণ মানুষের ভদ্রতাকে বোকা বিবেচনা করে আমাদের রাজনীতি পরিচালিত। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সংবাদকর্মীদের চ্যালেঞ্জ করে বসলেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা যুবলীগের সাভার কমিটির মধ্যে নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে সরকারি দলের নেতাদের নামের তালিকা কেন্দ্রে নেই। এতদিন জানতাম আমাদের রাজনৈতিকদলের সদস্যদের কোনো তালিকা নেই। বিশ টাকার ফুলে যেভাবে প্রতিনিয়ত নেতাদের আদর্শ বদল ঘটছে তাতে নেতাদের তালিকা রাখা অকল্পনীয়। শীর্ষ দুই রাজনৈতিক দলের প্রায় প্রতিটা জায়গায় একাধিক কমিটি ক্রিয়াশীল। কেন্দ্রের ও এলাকার অনুমোদনের দ্বন্দ্বে নেতারা নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তার সচল রেখেই অস্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। তাই সাভার থেকে কমিটি এনে চ্যালেঞ্জ কতটা যুক্তিযুক্ত ভাবা প্রয়োজন। দায়মুক্তির এমন চ্যালেঞ্জ সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ কমিটি বাতিল হলে প্রশ্ন থেকেই যায়।
আমাদের দেশে প্রায়শই দেখা যায়, নিজের দায়িত্ব লেজে গোবরে করে ফেললেও অপরের দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি বিশেষজ্ঞ। আমাদের ভবন বিশেষজ্ঞ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব ছিল সাভার ট্র্যাজেডির হোতাদের আইনে সোপর্দ করা। কিন্তু তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে পথে হাঁটলেন না। সাভার ট্র্যাজেডির মতো ঘটনায় যদি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হয় তবে যাদের নিজেদের বিন্দুমাত্র বিবেচনা নেই তাদের জাতি পুষবে কেন? মন্ত্রীরা জাতির অহংকার হিসেবে ধাক্কা দিয়ে ফাটল ধরা ভবন ধসিয়ে দেবার তত্ত্ব দেবেন? তদন্ত প্রতিবেদন না হাতে পাওয়া পর্যন্ত তিনি বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে ব্যস্ত থাকবেন? তবে একটা বিষয় জনগণের কাছে খুব পরিষ্কার যে সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা নিজেদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকেন। দলীয় প্রধানের কাছে দলের নেতাকর্মীদের এমন আনুগত্য সুখ অনুভূত হয়। কিন্তু যখন দেশ, জাতি, দলের ভাবমূর্তি বিবেচনায় দলীয় প্রধানের নির্দেশ অমান্য হয় তখন দলীয় রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হয় স্বার্থের টান মানুষকে কোথায় নিয়ে চলেছে।
বিরোধীদলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন লাশ গুম করে যেন মৃতের সংখ্যা কম না করা হয়। এক সময়ের সরকার প্রধানের মুখে এমন হুশিয়ারী সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে পাকাপোক্ত করেছে যে, সরকার মৃতের সংখ্যা কম দেখানোর জন্য লাশ গুম করে থাকে। স্পেকট্রাম গার্মেন্টস, ফিনিক্স ভবনে এমন ঘটনা ঘটানো হয়েছিল? দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা উদ্ধারকর্মীরা তাদের রাতদিনের শ্রমকে স্বার্থক করতে এই ঘৃণ্য কাজে বাঁধা দেবে তা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কারো বাবা-মা-ভাই-বোনকে জীবিত না পারলেও অন্তত লাশটা স্বজনদের হাতে তুলে দেবার জন্য দিনরাত জেগে শ্রম দিয়ে চলেছে। শুধুমাত্র মনের জোরে যারা একের পর এক কংক্রিটের বেড়া সরিয়ে ৭০ ফুট ভেতরে গিয়ে মানুষের স্পন্দন শুনতে চেয়েছে তাদের অজেয় কিছু আছে বলে বিশ্বাস করি না।
বিগত কয়েক দশক ধরে বিল্ডিং কোড নিয়ে কথাবর্তা শোনা যায়। ভবন সংক্রান্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ঘন ঘন সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাদের পৌরসভাগুলো ভবনের নকশা বা প্লান অনুমোদন করে থাকে। ডিজাইন তারা দেখে কিন্তু তা বোঝার জন্য তিন শতাধিক পৌরসভার প্রকৌশল শাখার কোনো লোকবল নেই। ডিজাইন বোঝার ক্ষমতা দশভাগ পৌরসভার নেই। প্লান ও ডিজাইন সম্পূর্ণ আলাদা। তাই দেশের পৌরসভাগুলো বিল্ডিং কোডের সুবিধা নিয়ে কিছু প্রকৌশলীকে তালিকাভূক্ত করেছে তাদের সম্মতি ছাড়া ভবনের প্লান অনুমোদন হয়। তাই সাভার ট্র্যাজেডির জন্য সেই প্রকৌশলীকে খুঁজে বিচারের সামনে দাঁড় করানো প্রয়োজন। আমাদের পেশাজীবী সংগঠনগুলো নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিল্ডিং কোডের মতো আইন পাশ করিয়ে নেয় কিন্তু তা নিজেদের জন্য প্রয়োগ করে না। আজ পর্যন্ত কোনো ভবনের জন্য কোনো প্রকৌশলীকে জবাবদিহি করার কথা শোনা যায়নি। গত দশ বছরে কত ভবন হেলে গেল, ধসে গেল কিন্তু কারো কিছু হলো? সবাই পরের কাঁধে বন্দুক রেখে পার হয়ে গেল।
পেশাজীবীরা দলীয় রাজনীতির সাথে লীন হয়ে যাওয়ার কারণে আইনের প্রয়োগ হয়তো হয় না। আইনের প্রয়োগ থাকলে এমন দুর্ঘটনা আমরা কম দেখতাম। তাই প্রথমে ভবনের প্লান ও ডিজাইন যে করেছে সেই প্রকেশলীকে, পরে ঠিকাদারকে এবং তারপরে মালিককে দায়ী করা জরুরি। এখানে পৌরসভার দায় আছে তবে তাদের কৈফিয়ৎও আছে। ভোটের রাজ্যে বাংলাদেশ যেখানে গদ্যময় সেখানে পৌরসভাকে টেনে লাভ কি?
সাভার ট্র্যাজেডি নিয়ে রাজনীতি হবে তা অস্বাভাবিক নয়। রাজনীতি হতেই পারে তরে তাতে শুধু কাঁদা ছিটানোর হবে এমনটা স্বাভাবিক নয়। দেশের মানুষের দুর্ভাগ্য তারা অস্বাভাবিক কাজই দেখে, জাতির এই দুঃখের সময় কোথায় সবাই সংযত আচরণ করবে তা নয়, অনেকের মধ্যে সুযোগ খোঁজার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। রাজনীতিতে ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার প্রচলন থাকলেও সব ঝোপে যে কোপ মারা যায় না তা আমাদের রাজনীতি বিশ্বাস করতে পারে না। তবে ভোট বাঁচানো আর সংগ্রহের দিকে পুরো নজর সীমাবদ্ধ থাকার ফলে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।
সাভার ট্র্যাজেডি আমাদের মানুষ মানুষের জন্য যে শিক্ষা দিয়েছে তা রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের মধ্যে সঞ্চারিত হোক। ভালোকে ভালো বলার মতো মানসিকতার সৃষ্টি হোক। অতীত স্মরণ রেখে কথা বলার অভ্যাস হোক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ দেশটায় মানবিক দুর্যোগ রোধে আন্তরিক হোক। কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ- এমন নীতি কৌশল থেকে ক্ষমতাধররা দূরে থাকুক। উদ্ধারকর্মীদের সম্মানিত করি। দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হোক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : সাম্প্রদায়িকতা ট্র্যাজেডি রাজনীতি
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh