শায়রুল কবির খান
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০২:৩৪ পিএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২২, ০৩:৩৮ পিএম
একটি দেশ লক্ষ লক্ষ বর্গকিলোমিটার নিয়ে গড়ে ওঠে। আর গড়ে ওঠা দেশে নানা নামে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বৈরিতা, রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি ও শক্তিমান আগ্রাসনে কৃত্রিমভাবে ভাংচুরের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিংবা নিয়ে যায়। তারপরও সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক মূল্যবোধের কোনও পরিবর্তন হয় না।
দেশ ও সরকার একীভূত রূপ, দেশহীন সরকার অকল্পনীয়, সরকারহীনদেশ এখন পর্যন্ত অকল্পনীয়। মানুষের সর্বোচ্চ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজস্ব নির্ভরতার মধ্য দিয়ে দেশ তার অস্তিত্বের যৌক্তিকতা খুঁজে পায়। আশাবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা তারই আশা পোষণ করেন।
গণতান্ত্রিক দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারকে ধূলিসাৎ করে যেকোনও পন্থায় মানুষের মুক্তির কল্পনা অবান্তর। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ব্যতিরেকে আদর্শ দেশ শুধু কল্পনা জগতের মোড়কেই থাকতে পারে। সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় আদর্শ দেশের ভেতরে সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে সুস্থিরতা ফুটে ওঠে।
গণতান্ত্রিক পন্থায় স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় আত্মমুক্তির পথ বাতলে দেওয়ার প্রশস্ত রাস্তা। সে মুক্তির পথ দিয়ে স্বাধীন দেশের ভেতর চর্চায় গড়ে ওঠে নানান মত ও পথের বিশ্বাস। ওই মুক্তির অন্বেষণে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ স্থান পেয়েছিল বটে, কিন্তু স্বাধীনতার শুভ লগ্নে গড়ে উঠতে পারেনি নানান মত ও পথের বিশ্বাস।
বাংলাদেশের অভ্যূদয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দেশ সৃষ্টির শতবর্ষের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। তার মধ্যেও এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী বাংলাদেশকে কখনও স্বাধীন, কখনও পরাধীন ব্যাখ্যা করে নিজেদের সাংস্কৃতিক প্রবণতার ভেতরে ঐক্য বিকশিত করতে চান। সে ঐক্যের ভিত্তিটা প্রথমে তৈরি করেন বঙ্গদেশ উচ্চারণ করে। কিন্তু বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশ, যার অস্তিত্ব ও বিস্তৃতি সীমাহীন।
স্বাধীন দেশে স্বাধীন সাংস্কৃতিক বিবেচনায় তৈরি হয় নিজস্ব জাতীয়তাবাদের মূল্যবোধ, এই মূল্যবোধটা থাকে অনেক বেশি উদার। বঙ্গদেশের প্রবণতার বুদ্ধিজীবিদের সংস্কৃতি ও তাদের ছবি যা আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ভাবনায় রাজনৈতিক ও মানবিক আদর্শের একটা নৈতিক সংকট তৈরি করে দেয়। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সরকার। নিঃসন্দেহে এই সরকার রাজনৈতিক আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। বাস্তবতার সুকঠিন প্রয়োজনে রাজনীতি চালিত হয়, কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা আর নৈতিকতার সরল পথ একত্রে মিলিত হয় না। উদাহরণস্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলার শুরুতে সারা দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে সরকার বার বার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিতে থাকেন। যদিও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার কর্মসূচি নিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের স্বল্প সময়ে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার ভাবনাটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। উল্লেখ্য সমাজতান্ত্রিক ভাবনাটা ছিল সাধারণ নাগরিকদের চাওয়া-পাওয়ার মাঝে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য মূল সংগ্রামটা করেছেন দরিদ্ররাই, বড়লোকেরা নয়। অথচ সমাজের সব সুবিধা ভোগ করেছেন তথাকথিত শিক্ষিত বড়লোকেরা। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির জন্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাগরিক সংগ্রামের মধ্যকার সুবিশাল পার্থক্যটা তৈরি হয় যখন সরকারের ভেতরে থাকা শিক্ষিত সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনীতির নামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে আপস করছিল তখন থেকেই। এই শক্তি শক্তভাবে থাবা মেলতে দেখে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত নাগরিকরা আবার সামনে তুলে আনতে চেষ্টা করে অতীতের লড়াইয়ের ইতিহাসটাকে। পরবর্তীতে তার অনেকটাই সম্ভব হয়েছিল।
আজ বাংলাদেশ যথার্থ দেশের স্থলে দাঁড়াতে পারছে না সরকারের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার উপলব্ধির অভাবে। গণতন্ত্রহীন শাসনব্যবস্থায় আজ যে স্থলে দাঁড়িয়ে সরকার, সেখান থেকে এককভাবে দেশের সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, দরকার পুরো জনগোষ্ঠীর সমন্নয়। দেশ আর জন্মভূমি যাই বলা হোক না কেন, আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক চেতনার সঙ্গে দেশের রাজনীতির সংযুক্তি অনিবার্য। তা না হলে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আকাঙ্ক্ষার রূপকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাংস্কৃতিক চেতনা বলতে ধর্ম, শিল্প-ভাবনা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সামাজিক রুচি ও মানবিক গুণাবলি জীবনের দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে দেশের আলোকিত মুখগুলোর খুব কমই সংযোগ ঘটে। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল জায়গায় নাগরিকদের অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন ছাড়া যেকোনও উন্নয়নপ্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। সুষম বণ্টনে সমাজ উন্নয়নে ব্যর্থতার কারণে ভৌগোলিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার কোনোটাই কাজ করে না। ভৌগোলিক সীমারেখা চিহ্নিত হবার পরও ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি এমনকি পানি প্রবাহের মতো বিষয়গুলো বিরোধের স্থলে দাঁড়িয়ে যায়।
মানবিক মূল্যবোধ তৈরির সামাজিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে উৎপাদনমুখী রাজনীতি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথাৎ ফসল উৎপাদনের সঙ্গে ন্যায়সংগতভাবে কৃষকের জীবন ভাবনার পরিবেশ তৈরি সরকারের দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে মানবিক জ্ঞান বিকাশের সামাজিক জীবনযাপনের উপকরণ ধর্মীয়, স্বতন্ত্র ও ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব স্তরের নাগরিক অর্থাৎ ভৌগোলিক সীমারেখার অন্তর্গত নাগরিকেরা একত্রে এসে দাঁড়ায়। সেই স্থানটিকে নির্বিঘ্ন ও নিশ্চিত করে তোলা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ- আধুনিক সমাজব্যবস্থার দেশ বলা যায় মালয়েশিয়াকে। মালয়েশিয়া সামাজিক বিকাশের মাধ্যমে বিকশিত দেশে পরিণত হওয়া এক এশীয় মুসলিম দেশ। আমাদের উচিত বাংলাদেশের নাগরিকদের রুচিকে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় রেখে জীবনযাপনের আধুনিকীকরণের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা। এখনও যদি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সরকার দেশের নাগরিকদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সুষম বণ্টনের উন্নয়ন অগ্রাধিকার মনে করে, তাহলে দেশের রাজনীতির গুণগত মান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন সম্ভব।
এতে করে সংকট মোকাবিলা করে বাংলাদেশের নাগরিকদের তার গর্ব করার ইতিহাসের কাছে ফিরিয়ে নেবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা- জাসাস
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বাংলাদেশ গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ শায়রুল কবির খান
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh