পিনাক রঞ্জনের ‘বাঙালি মুসলমান’

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশে ভারতের এক সাবেক হাইকমিশনার আর বর্তমানে অবসরের পর তিনি ভারতের নিজস্ব এক স্থানীয় উদ্যোগের থিঙ্কট্যাঙ্ক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন বা (ওআরএফ) এর ফেলো। তাঁর গুরুত্ব হলো যে তিনি ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালে বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আমরা যদি ওই সরকারের আমল থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সরকারে আমেরিকা তো বটেই সঙ্গে ভারতের হস্তক্ষেপ শুরু হওয়ার দিকটা খেয়াল রাখি তবে বুঝব তার ভূমিকা। 

ভারতের প্রণব মুখার্জি যিনি ছিলেন কংগ্রেসের সিনিয়র মন্ত্রী ও পরে ভারতের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তিনিই হলেন ওয়ান-ইলেভেনের সময় থেকে বাংলাদেশে রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের প্রধান নায়ক; কিন্তু প্রণব মুখার্জি হলেন সেই লোক যিনি এমন হস্তক্ষেপকে নিজ গর্বের ব্যাপার হিসাবেই শুধু দেখেন না বরং গর্বভরে এনিয়ে বইও লিখে ফেলতে পারেন। সেটা অবলীলায় এবং কোনো অপরাধবোধ ছাড়াই। অন্যদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা বেআইনি ও অনৈতিক; অন্তত ওদেশের আম-আদমির নাগরিক অধিকারের দিক থেকে চিন্তা করলে। আমেরিকান কূটনীতিকরাও এ নিয়ে প্রকাশ্য স্বীকৃতি বা স্টেটমেন্ট দেয়া এড়িয়ে চলেন; কিন্তু প্রণব মুখার্জি ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স’ বইয়ে তাঁর এসব কার্যকলাপকে গর্ব হিসাবে তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে বিবিসির এক রিপোর্ট পড়ে দেখতে পারেন আগ্রহীরা। 

তাহলে সেকালে ওয়ান-ইলেভেনের সময় প্রণব ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর পিনাক রঞ্জন ছিলেন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত। মানে পিনাক ছিলেন বাংলাদেশে প্রণবের সিদ্ধান্তের মাঠ পর্যায়ে অনুসরণ ও বাস্তবায়নের প্রধান ব্যক্তিত্ব।

পিনাক রঞ্জন গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, এক নিবন্ধ লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘এক অনন্য সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন : উদ্বেগজনক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও ভারত এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে অংশীদারিত্ব’। লেখার ভিতরে দেখা যায় তিনি আসলে বলতে চেয়েছেন ভারত-বাংলাদেশের এক ‘অনন্য সম্পর্ক’ সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভারতের অস্ত্রক্রয়ের অফার ফেলে চীনের থেকে কিনতে গিয়ে চীনের ওপর ‘অতি নির্ভরশীলতা আছে’ বলে মনে করেন। আর তাই এটাকে তিনি এক ‘উদ্বেগজনক প্রতিবন্ধকতা’ হিসাবে দেখছেন। 

এমনিতেই ভারত ‘বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দিয়েছে’ ধরনের কথা প্রায়ই বলে থাকে। সেটা একালে মানে ২০০৯ সালের পর থেকে আরও বেশি করে বলা শুরু হয়েছে, আর তাতে যোগ করা আরেক ইঙ্গিত হল যেন বলতে চায় যে বাংলাদেশের মালিক হল ভারত। এমন ইঙ্গিত তারা দেয় সাধারণত যখনই বাংলাদেশ কোনো খাতে চীনা-বিনিয়োগ নেয় সেই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে। ব্যাপারটা যেন এরকম যে ব্রিটিশ আমলের ভারতে কোনো ভাইসরয় আমাদেরকে বলছেন, ‘আমরা তোমাদেরকে কলোনিদখল করেছি ও শাসন করছি, এটা আমার গর্ব’। আসলে বৃটিশেরা এটা কখনও বলবে না। আজকের যে চীনকে আমরা দেখছি, এখন দুনিয়ার মধ্যে সবদেশের চেয়ে বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ-পুঁজি ভিন-দেশে ঋণ দেয়া বা বিনিয়োগের সক্ষমতা রাখে। অথচ এই চীন মাত্র ১৯৭৮ সালে থেকে নিজেই প্রধানত আমেরিকার ওয়াল স্টিটের পুঁজি-বাজারের বিনিয়োগ নিয়ে তা কাজে লাগিয়ে আজকের এ জায়গায় এসেছে। এ জন্য আমেরিকার এমন বলা বা মনে করা কী সাজে, যদি সে বলে চীনের এসব উত্থান তো আমেরিকাই করে দিয়েছে! দুনিয়াকে দেখা ও বোঝাবুঝিতে ঘাটতি থাকলে আর পেটি-মধ্যবিত্তের সংকীর্ণ-মন ও ফেক ভ্যানিটির চোখে সব কিছু দেখলে এমন দেখা যায়। 

আসলে পিনাক রঞ্জনের এ লেখাটা মনোযোগ আকর্ষণের কারণ অন্য কিছু, এখন সেদিকে যাব। এমনিতে এই মূল লেখাটা ছিল ইংরাজিতে; কিন্তু প্রায় একমাসেরও পরে সে লেখাটাই এবার ওআরএফের নিজস্ব বাংলা সাইটে ছাপা হয়েছে, এরপরে এটা নজরে আসে আমাদের। 

প্রথমত লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ‘বাঙালি মুসলমান’ বলে এক শব্দের ব্যবহার দেখা গেছে এখানে। অন্তত চারবার তা ব্যবহার করা হয়েছে। কলকাতার কথিত ‘অসাম্প্রদায়িক’ চোখ এই ব্যবহার ‘অস্বস্তিকর সাম্প্রদায়িক’ মনে করে থাকে। এমনিতেই যেখানে কলকাতা কোনো মুসলমানকে বাঙালি বলতে রাজি হবে কিনা এ নিয়ে দ্বিধা দেখা যায়। যেটা একালের বাঙালি হিন্দু বিজেপির মধ্যে অনেক বেশি।

দ্বিতীয়ত, পিনাক রঞ্জন লিখেছেন, ‘...মহম্মদ আলি জিন্না তাঁর রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে উর্দুকে জাতীয় ভাষা রূপে বেছে নেন’-এভাবে। এখানে দেখা যাচ্ছে তিনি অনেক কষ্ট করে পাকিস্তানের ইতিহাস ঘেঁটেছেন। কিন্তু পড়েছেন জমিদার-হিন্দুর স্বার্থ চোখে। আর কমন যে কথা দেখা যায় জিন্নাহ’র বিরুদ্ধে মানে দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা তুলে বিষ উগলানো। এটা তো আসলে নেহেরু-গান্ধীর কংগ্রেসের অপকর্মকে ঢাকা দেয়ার ভাষ্য। নেহেরু-গান্ধীর কংগ্রেস ভারতকে একটা হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের রূপ দিয়েছিল এটা ভোলা যাবে না। যার অর্থ, অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদেরকে কংগ্রেসের হিন্দু জাতিরাষ্ট্রের বাইরে আরেকটা মুসলমান-জাতিরাষ্ট্র গড়ে নিতে ঠেলে দেয়া। ঘটেছিলও তাই, নিরুপায় জিন্নাহর মুসলিম লীগ তাই করেছিল। অথচ এটাকেই আজ ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ বলে গালি দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ হিন্দু-জাতি তত্ত্বেরই অপর পিঠ হলো মুসলমান-জাতি তত্ত্ব (এই পয়েন্টটা মিস করা যাবে না), যার অপর নাম জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব। তাহলে আসল দোষী কে?

আবার পূর্ববঙ্গ-এর (বাংলাদেশের) দিক থেকে দেখলে জিন্নাহ তাদেরও হিরো এজন্য যে, পাকিস্তান কায়েম (ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন) হয়েছিল বলেই পূর্ববঙ্গে জমিদারি উচ্ছেদ সম্ভব হয়েছিল। আমরা কলকাতার অধীনে থেকে গেলে জমিদারি উচ্ছেদ ঘটত না। আর উচ্ছেদ না হলে আজও পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রজারা কেউ চাষাবাদি জমির মালিক, যা তারা আজ হয়ে আছে, তা পারত না। এ জন্য জিন্নাহ তাদের হিরো!

তৃতীয়ত, পিনাক রঞ্জন লিখেছেন, জিন্নাহ ‘উর্দুকে জাতীয় ভাষা’ করার কথা ঘোষণা করেন, তখন তিনি ছাত্রদের পরিহাসের শিকার হন’। আসলে মুসলমানবিদ্বেষী কথা সবসময় পিনাক রঞ্জনের পক্ষে নাও যেতে পারে। আর তাঁর উচিত হবে ভারতেরও ‘রাষ্ট্রভাষার’ ইতিহাস জেনে নেওয়া যে, ভারতের কোনো ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ’ বা রাষ্ট্র ভাষা নাই, কেন? কেন ভারতের সুপ্রিম আদালতগুলোর রায় হলো যে ভারতের ‘স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ’ বলে কিছু নাই!

আসল কথাটা হলো, ভারতের জওহরলাল নেহেরুও জিন্নাহ’র মতোই ‘পরিহাসের শিকার’ ও অপমানিত হয়েছিলেন এবং তা ভাষার ইস্যুতেই। তফাত এই যে জিন্নাহর বেলায় ঘটনাস্থল ছিল পূর্ব-পাকিস্তান আর নেহেরুর বেলায় এটা ছিল পুরা দ্রাবিড়ীয় দাক্ষিণার্ত বা দক্ষিণ ভারত। ভারতের হিন্দি-বিরোধী ১৯৬২ সালের সেই আন্দোলনে নেহেরুর হিন্দি চাপানোর বিরুদ্ধে, যার কেন্দ্র ছিল তামিলনাড়ু।

অল্প কথায় শেষ করতে চেয়ে বললে, নেহেরু ও জিন্নাহর চিন্তায় ভুলটা একই ছিল। সেকালটা ছিল জাতি-রাষ্ট্র চিন্তার। ফলে তারা দু’জনেই নিজ নিজ পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছিল সারাদেশকে একই ভাষায় আনা গেল কথিত তাদের স্ব স্ব জাতি দ্রুত একাত্ম হয়ে উঠবে। সারকথায় তারা উভয়েই ভেবেছিল এক ভাষার জাতি বানাতে পারলে তাদের স্ব স্ব দেশ শক্তিশালী ও একতাবদ্ধ হবে। ভাষাই দেশকে একতাবদ্ধ ‘জাতি’ দেখানোর এক বড় উপাদান।

এই অনুমান ছিল ভুল। বরং নতুন কথিত রাষ্ট্রভাষার সুবিধা যাদের পক্ষে যাবে তারা রাষ্ট্রের বাকিদের ওপর আধিপত্য কায়েমের সুযোগ পাবে ও নেবে। মূলকথা, রাষ্ট্র চরম নাগরিক বৈষম্যের উৎপাদক এক আখড়া হয়ে দাঁড়াবে। অথচ রাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য নাগরিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। আসলে জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা জিন্নাহ-নেহেরু উভয়কেই মিস-গাইড করেছিল বা ভুল অনুমানে নিয়ে গেছিল। আর এতে শেষে কেবল পাকিস্তানই ভাঙেনি। সেই থেকে আজও তামিলনাড়ুতে হিন্দিভাষী কংগ্রেস বা বিজেপি ঢুকতে পারে নাই। কেন স্থানীয় ডিএমকে (উগক) আর পরে এ থেকেই ভেঙে বের হওয়া আন্না-ডিএমকে ছাড়া অন্য কোনো দল তামিলনাড়ুতে ওই ১৯৬২র পরে কখনো রাজ্য সরকার গঠন করতে পারে নাই, এর জবাব ওখানেই আছে। 

পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর উচিত হবে প্রথমে নিজ রাষ্ট্র-ইতিহাসকে নির্মোহভাবে বোঝা, যাতে পরে অপর দেশকেও বোঝা সহজ হয়। যেমন মূল নেশন-স্টেট বা জাতি-রাষ্ট্র এই ধারণার সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা এবং সমাধান স্টাডি শেষ না করেই মুসলমানবিদ্বেষ করতে গেছেন বলে এভাবেই তিনি ধরা খাবেন। যেমন এখন মোদির আরএসএস মনে করছে, ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র ঘোষণা করার সময় এগিয়ে আসছে। 

সম্পাদক শেখর গুপ্তা, ভারতের প্রভাবশালী পাঁচজন মিডিয়া ব্যক্তিত্বের নাম করতে গেলে তাঁর নাম আসবেই। বর্তমানে তিনি করপোরেট মিডিয়া হিসাবে উদিয়মান আরেক হাউস ‘দ্য প্রিন্টের’ প্রতিষ্ঠাতা ও এডিটর ইন চিফ। ৬৪ বছরে এখনো তিনি নিয়মিত লেখেন, সাপ্তাহিক কলাম তো লেখেনই। তাঁর একটাই বা বড় সমস্যা, তিনি ভারতের আম-ইন্টেলেক্টদের মতোই জাতিবাদি। তার কলামের নামও ‘ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট’; কিন্তু চলতি সপ্তাহে তিনি লিখেছেন ভারতের কেন্দ্র-রাজ্য নিয়ে মারাত্মক দ্বন্দ্বের কথা। শেষে উপায় না পেয়ে লিখেছেন, এক ফেডারল ইন্ডিয়া গড়ার কথা। অর্থাৎ ভেঙে গড়ার কথা, যা আমি তাকে প্রথম দেখলাম! এখনো ভারতে এই আইডিয়া নিয়ে চর্চাই যেন নিষেধ, সেই ভারত ভেঙে যাবে হয়তো সহজেই কিন্তু গড়া কত কঠিন, প্রথমত কত কী পড়াশোনা-প্রস্তুতি লাগে তখন যদি তাঁরা বুঝে!! 

কাজেই কারো পিছনে লাগার কিছু নাই, নিজ নিজ রাষ্ট্রগঠন সমস্যার দিকে ওই শ্রমটা ব্যয় করেন!!!


গৌতম দাস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //