শিক্ষা বাণিজ্যের রাশ টেনে ধরার উপায় কী

‘বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে শুধু মূর্খই করে।’ তত্ত্বের দিক থেকে এই কথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও শিক্ষা অর্জনের খাতিরে আমাদের শিক্ষা ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে থাকতে হয় বছরের পর বছর । 

একজন মধ্যবিত্ত অভিভাবকের দু’জন সন্তান যদি একটি মধ্যম সারির বেসরকারি স্কুলে পড়ে, তাহলে বছরের শুরুতেই তাকে ন্যূনতম এক লাখ টাকার জোগান দিতে হয়। এবং এই খরচ বয়স ও শ্রেণিভেদে প্রতি বছর বাড়বে। ছাত্র বা ছাত্রী যে কিনা কোনো একটি স্কুলে একবার ভর্তি হলো, সে যদি ১০ বছর ওই একই স্কুলে পড়ে তবে ওই দশ বছরে দশবার তাকে একই স্কুলে প্রতিটা শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি হতে হবে। এবং সেই ভর্তি ফী ন্যূনতম দশ হাজার থেকে ২৮/৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর তাকে বইখাতা ও স্টেশনারি, ড্রেস, জুতা বাবদ আরও ব্যয় করতে হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এই টাকা স্কুলের মান ও মাধ্যম (ইংরেজি, ইংলিশ ভার্সন ও বাংলা) ভেদে আরো বাড়বে বৈ কমবে না। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে একজন অভিভাবককে এ বছরের শুরুতে তার স্বাভাবিক আয়-ব্যয়ের খরচের বাইরে এই বাড়তি খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হয়।

অন্যদিকে শিক্ষাকে বাণিজ্যে রূপ দেয়া এসব স্কুলগুলো বইখাতা স্টেশনারি ও ড্রেস কেনার সুযোগ অভিভাবকের হাতে না দিয়ে তাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাখে। যেখানে একজন প্লে বা নার্সারি শ্রেণির ছাত্রের পাঁচটা ফটোকপি বর্ণমালা ও ছবি আঁকার বই ১২০০ থেকে ২৪০০ টাকায় কিনতে অভিভাবককে বাধ্য করা হয়। এক বছরের কলম, পেন্সিল, রঙ পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার স্কেল, কাগজ, পোস্টার কাগজ, অফসেট পেপার, আর্ট পেপার, জল রঙ, তেল রঙ ইত্যাদি রসদ একবারে কেনার টাকা স্কুলে জমা দিতে হয়। এ ছাড়া স্কুলগুলোর ধরিয়ে দেয়া লম্বা বইয়ের লিস্ট তো আছেই। এবং এ সবই কিনতে হবে প্রথম মাসের নির্দিষ্ট তারিখের ভিতরেই। এরপর আছে মাসের-পর-মাস ইউটিলিটি ফি নামে টিউশন ফি’র সঙ্গে নতুন নতুন ফি যোগ হওয়ার হ্যাপা। এরপর স্কুলের শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবে কে জানে! অভিভাবককে তার সন্তানের ভালো ফলের আসায় ছুটতে হবে কোচিং সেন্টারগুলোতে। এবং বলাই বাহুল্য সেখানকার খরচ স্কুলের তুলনায় দ্বিগুণ এবং বেশিরভাগ কোচিংসেন্টারগুলোর শিক্ষক ওই স্কুলেরই শিক্ষক শিক্ষিকারা।

এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, একই শিক্ষক যখন কোচিংয়ে ছাত্র-ছাত্রীকে এতো ভালো বোঝাতে সক্ষম হচ্ছেন, তবে শ্রেণিকক্ষে বোঝাতে সমস্যাটা কোথায়? যে ছাত্র বুঝবে না তার তো কোনো জায়গায় বোঝার কথা না! আর যে বুঝবে তারসর্বত্রই বুঝতে পারার কথা- যদি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাটা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এ তো গেল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অভিভাবকদের সন্তানের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের একটি ন্যূনতম চিত্র। নিম্নআয়ের অভিভাবক যারা আছেন, যারা তাদের সন্তানকে সরকারি-আধা সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে পড়তে পাঠান তারা কতটা সুলভে পান শিক্ষাটা? সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে পড়তে গেলে যে শিক্ষাটা সুলভে পাওয়া যাবে এই ধারণা এখন ঠিক না। উন্নয়নের দেশে ভর্তি খরচ নামে এক ডাকাত চেপে বসে আছে। শ্রমজীবী বা নিম্নআয়ের মানুষকে বছরের শুরুতেই ভিক্ষুক বানিয়ে দেয় এই শিক্ষা ব্যবস্থা। স্কুলের বাইরে নিম্নআয়ের এইসব অভিভাবকদের সন্তানদেরও প্রতিটি বিষয়ে কোচিং করাতে হয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাধ্যতামূলকভাবে কিনতে হয় কয়েক হাজার টাকার গাইড বই, নতুন স্কুল ড্রেস ইত্যাদি। সরকারি স্কুলগুলোতে উপবৃত্তির টাকা অনেক সময় স্কুলে কেচিংয়ের নামে কেটে নেওয়া হয়। 

যার মাসিক আয় নয় দশ হাজার টাকা তাকে যদি মাসে কোচিং খরচ ১৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয় তাহলে সেই ব্যক্তির সংসার চলে কিভাবে! আমাদের শহর ও নগরের মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত বাবা মায়েরা সন্তানকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে গিয়ে জীবনের সব সাধ বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবুও শেষরক্ষাটা হচ্ছে কি? একটি বিশ্বমানের শিক্ষা এদেশের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে কি? 

২০২০-এ করোনাকালীন লকডাউনে দেখা গেছে হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়ায় ঘরবাড়ি ছেড়েগ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তাদের ন্যূনতম দুই বা তিন মাস টিকে থাকার মতো সঞ্চয় নেই। মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলা এই দেশের নগরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এত বেশি যার সিংহভাগই ব্যয় হয় শিক্ষা খাতে যা বিশ্বের অন্য কোথাও বিরল। এমন কোনো সভ্য দেশের দেখা নিশ্চয়ই মিলবে না যেখানে স্কুলে পড়ার কোনো দাম নেই; কোচিংয়ে যা পড়ায় সেটাই অফিসিয়াল শিক্ষা ব্যবস্থা। এভাবে একটি মধ্যম আয়ের দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাথমিকের পরেই ঝরে যায়। আর এভাবেই বিশ্বের ৪০তম শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বাল্যবিবাহের চতুর্থস্থানে গৌরব অর্জন করে। কারণ এক একটি গাইড বই ৪০০/৫০০ টাকায় কিনতে পারেন না বলে বাবা- মায়েরা তাদের মেয়েকে পড়াতে ব্যর্থ হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আগেই পণ্য হয়েছে, এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিলেতিলে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সামর্থের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোতে ক্লাস হয় না, কোচিং না করলে পাশ হয় না। বেসরকারি স্কুলগুলোতে উচ্চ বেতনে পড়ার পর আবার কোচিং করতে হয়। বছরের পর বছর ভর্তি খরচের লাগামহীন ঘোড়দৌঁড় তো চলছেই। সুতরাং অভিভাবকের কাছে শিক্ষা আজ হয়ে পড়েছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।

পদ্মা সেতু হচ্ছে, কর্ণফুলীর নিচে দীর্ঘ টানেল হচ্ছে, মেট্রোরেল হচ্ছে। উড়ালপথ হচ্ছে। রাশিয়া থেকে এক্সপার্ট ভাড়া করে এনে বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ খরচে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, অথচ শিক্ষা খাতে উন্নয়ন কতটা হচ্ছে? গত কয়েক বছরে শিক্ষা কারিকুলামে একের পর এক পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবে শিক্ষার মান ও গুণগত পরিবর্তন খুব একটি হয়নি বরং ছাত্র ছাত্রীদের গাইড বই, কোচিং ও গৃহ শিক্ষকের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে চলেছে। শিক্ষাকে পণ্য করার প্রতিযোগিতায় নামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাশ টেনে ধরার কী উপায় আছে আমরা জানি না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //