র‌্যাব একাই কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে?

এলিট ফোর্স র‌্যাবকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে জাতিসংঘের আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেলকে চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক ১২টি মানবাধিকার সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংস্থাও। চিঠিতে জাতিসংঘের ২০১২ সালের ‘পলিসি অন হিউম্যান রাইটস স্ক্রিনিং অব ইউনাইটেড নেশন পারসোনেল’ বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয়।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ সেনা ও পুলিশ মোতায়েনকারী দেশগুলোর অন্যতম। 

মোটামুটি একই সময়ে ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকা’র অভিযোগে র‌্যাব এবং এর ছয় জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন অর্থ দপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তির বরাতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মার্কিন অর্থ দপ্তরের ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্র্রোল অফিস (ওএফএসি) বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিপীড়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। 

বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ছয় কর্মকর্তা হচ্ছেন- র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, র‌্যাব এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে প্রায়

৬০০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ছয়শ’র বেশি লোকের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া (গুম) এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।

মার্কিন অর্থ দপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং ১২টি মানবাধিকার সংস্থার চিঠি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে বিএনপির আমলে র‌্যাব গঠিত হয়েছিল, তাদের তরফেও প্রকারান্তরে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এই দাবিকে সমর্থন করা হচ্ছে। যদিও সরকারের দাবি, বিএনপি লবিস্ট নিয়োগ করে আন্তর্জাতিক মহলে র‌্যাবের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলা। তবে সরকার এবং তাদের বিরোধী শিবিরের এই তর্কে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি সামনে আসছে তা হলো, র‌্যাব একাই কি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে? রাষ্ট্রের অন্যান্য বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে কি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নেই? 

স্মরণ করা যেতে পারে, পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম গতিশীল ও কার্যকর করার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) নামে এই এলিট ফোর্স গঠন করা হয় এবং ওই বছরের জাতীয় স্বাধীনতা দিবসে প্যারেডে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এ বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। 

জঙ্গি, মাদক ও শীর্ষ অপরাধীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযানের মধ্য দিয়ে র‌্যাব দ্রুতই জনগণের আস্থা অর্জন করে। বেশ কয়েকজন শীর্ষ জঙ্গি নেতাকেও র‌্যাব গ্রেফতার করে। র‌্যাবের পরিসংখ্যান মতে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর র‌্যাবের হাতে দেড় হাজারেরও বেশি জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছে। জঙ্গিবিরোধী এসব অভিযানের পাশাপাশি র‌্যাব ১৭ জঙ্গি এবং জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কাজও করেছে। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন ও রিহ্যাবিলিটেশন নামে একটি কর্ম পরিকল্পনাও নিয়েছে বাহিনীটি। তবে শুধু অভিযানই নয়, র‌্যাব বিভিন্ন মানবিক কাজেও অংশ নিয়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে অনেক মানবিক উদ্যোগের সঙ্গেও র‌্যাব যুক্ত ছিল। 

যদিও বিভিন্ন সময়ে র‌্যাব বিতর্কিতও হয়েছে। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনা এবং ক্রসফায়ারের নামে বিনা বিচারে হত্যার মতো ঘটনাগুলো নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তরফে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অভিযোগ আছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে র‌্যাবের হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে পাঁচ শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন। আবার এও ঠিক যে, নারায়ণগঞ্জে সাত খুনসহ আরও অনেক ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

অস্বীকার করা যাবে না, কিছু বিচ্যুতি থাকলেও দেশকে জঙ্গিমুক্ত করা, শীর্ষ অপরাধীদের দমন এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানে র‌্যাবের ভূমিকা প্রশংসনীয়। যদিও মানুষ কেন জঙ্গি হয় এবং মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের পরেও দেশ মাদকমুক্ত হয়েছে কি-না?- সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের মতো বিচারবহির্ভূত হত্যার পক্ষে জনমত থাকলেও, যে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই তা হলো, বছরের পর বছর ক্রসফায়ারে অপরাধীরা নিহত হলেও দেশ তো অপরাধমুক্ত হয়নি। ক্রসফায়ারে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্তও অনেকে নিহত হয়েছেন; কিন্তু তারপরেও কি দেশ থেকে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে? হয়নি। তাছাড়া বিনা বিচারে কাউকে হত্যা, এমনকি কোনো শীর্ষ অপরাধীকেও বিনা বিচারে হত্যার অর্থই হলো, প্রচলিত বিচারব্যবস্থা বা আদালতে উপেক্ষা করা। র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মূল অভিযোগটা এখানেই। 

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০২ সালে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়ে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে বিনাবিচারে অনেককে হত্যা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, ২০০৩ সালে একটি ইনডেমনিটি আইন করা হয়, যার মধ্য দিয়ে অপারেশন ক্লিন হার্টকে বৈধতা দেওয়া হয়। তার মানে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঘটনা দেশে নতুন নয়। খোদ জাতীয় সংসদেও ক্রসফায়ারের পক্ষে সংসদ সদস্যদের অনেকে বক্তব্য দিয়েছেন; সাফাই গেয়েছেন। এসব কারণে ক্রসফায়ার কিংবা নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন অথবা মৃত্যুও বৈধতা পেয়েছে। সুতরাং র‌্যাব বা কোনো একটি বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সুযোগ নেই এবং নির্দিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার উপরে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যৌক্তিক নয়। কোনো বাহিনী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে- সেটি জনগণ বিশ্বাস করে না। 

২০২০ সালের ৩০ জুলাই সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির (কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার) সভায়ও ঘুরে ফিরে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর জবাবদিহিতা না থাকার বিষয়টি এসেছে। সভায় ২০১৩ সালের নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের বেশ কিছু দুর্বলতার দিকও তুলে ধরা হয়। এমন প্রশ্নও তোলা হয় যে, পুলিশ কি এতটাই স্বাধীন যে রাষ্ট্রের ভেতরে তারা আরেকটি রাষ্ট্র?

এমতাবস্থায় কোনো মানবাধিকার সংগঠনের দাবির মুখে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা র‌্যাবকে নিষিদ্ধ করা হবে কি-না, সরকার এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করছে এবং সেখানে শেষমেশ তারা কতটা সফল হবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে; কিন্তু পুরো বিষয়টায় যে প্রশ্নের সুরাহা করা দরকার তা হলো, অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যেসব কৌশল অবলম্বন করে, সেখানে আসলেই নিরাপরাধ মানুষ ভিকটিম হয় কি-না; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা কেউ ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন কি-না; বাহিনীর কোনো সদস্য বা কোনো অংশ এক পক্ষের কাছ থেকে টাকা খেয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় কি-না বা ক্রসফায়ারে দেয় কি-না; বাহিনীগুলোকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয় কি-না? এসব প্রশ্ন বছরের পর বছর ধরে জনমনে রয়েছে। 

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অপরাধীদের জন্য আতঙ্কের কারণ হলেও, সাধারণ মানুষ এবং শুধু রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক যদি বাহিনীগুলোকে ভয় পায়- তাহলে সেটি উদ্বেগের বিষয়। একজন অপরাধীকে ধরতে গিয়ে অপরাধীর পরিবার বা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কি-না, এসব ক্ষেত্রে র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষায় কতটা সচেতন থাকতে পারছেন এবং মানবাধিকার রক্ষায় তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ রয়েছে কি-না, তাও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। 

অর্থাৎ জনগণের পয়সায় পরিচালিত রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত না সাধারণ মানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারছে, ততদিন পর্যন্ত কোনো না কোনো কারণে তারা বিতর্কিত হবে, প্রশ্নবিদ্ধ হবে। এ রকম প্রশ্ন উঠলে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দল ও সংগঠনগুলো সেখান থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে, সেটিও খুব অস্বাভাবিক নয়। ফলে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো আসলেই কতটা জনবান্ধব এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে বা হতে পারবে, সেটি মূলত নির্ভর করে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //