উন্নয়নের দিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্নজয়ন্তী পালিত হয়েছে মোটামুটি জোরেশোরে। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ যে এগিয়েছে তা সহজেই চোখে পড়ে। জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোন থেকে অর্থাৎ দেশের সব মানুষকে যদি এক ধরা হয় তবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতি বিশ্বে অনেকের কাছে বিস্ময়ের, তাতে সন্দেহ নেই। আবার এই উন্নতির টেকসইতা নিয়ে বহু মানুষের মনে যে প্রশ্ন আছে তাও সত্য। 

কিন্তু দেশের সবাই কি এক হয়? শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জনগণ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত - সম্পদের মালিক ও শ্রমের মালিক এই ভিন্নতা ছাড়াও। যে মানুষটি রাস্তায় ঘুমায়, যাকে ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খেতে হয়, অর্থের অভাবে যে সরকারি হাসপাতাল-প্রদত্ত চিকিৎসাও নিতে পারে না, ক্ষমতা-নেটওয়ার্কের বাইরে থাকার কারণে যে বিনা দোষে শাস্তি পায় - এরা কী করে সুবিধাভোগেীদের সমান নিজেদের ভাবতে পারবে? শ্রেণিতে শ্রেণিতে পার্থক্য এখন অনেক বেড়ে গেছে। 

আগের দিনের কোটিপতিও রাস্তার মানুষটির মত করে পান্তা ভাত বা আলু ভর্তা চিনতে পরতেন। এখন সামান্য অর্থনৈতিক ব্যবধানেই জীবনযাপনে, কথায়, সংস্কৃতিতে বিরাট পার্থক্য। একজন ফাস্টফুড খায়, আরেকজন পান্তা পেটের জ্বালায়, আরেকজন আবার সখের নববর্ষে! একজন ‘বাহ’ বলে তো আরেকজন ‘ওয়াও’! জাতির মাঝে পার্থক্যের দেয়াল এখন একটা না, অনেক। আবার একটা দৈত্য তৈরি হয়েছে যার আছে বিরাট সাম্যবাদী ক্ষমতা, যে সবাইকে সমান করে ফেলতে পারে- কালা-ধলা, ন্যায়-অন্যায়, ধর্মাধর্ম, সংস্কৃতি-অসংস্কৃতিবান, জ্ঞানী-মূর্খ সবাইকে এক কাতারে এনে দাঁড় করানোর জাদুকরি ক্ষমতা রাখে। এই দৈত্যের নাম টাকা - যার প্রভাব এখন একচ্ছত্র এবং প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান। 

এই যে মানুষে মানুষে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য ও অনৈক্য এবং টাকার বিনিময়ে ঐক্য - এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান চোখধাঁধানো উন্নতির নির্যাস। উন্নতির অর্থটাই বর্তমানে উলটে গেছে। নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক চোখ উপড়ে ফেলে আমরা যখন টাকার কৃত্রিম চশমা পরি, তখন প্রকৃত উন্নতিকে অবনতি আর অবনতিকেই উন্নতির মত দেখায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এখন তেমনটা ঘটছে। তাই কেবল অর্জনের গান না গেয়ে কিছু ঘাটতির আলোচনাও করা প্রয়োজন।   

শিক্ষা-সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়েছে, ঠিক। যদিও মানের অবনতি হয়েছে, আর কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে তা আরও নামছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বিরাট সংখ্যক মানুষের হাতের কাছে পৌঁছেছে, কিন্তু মাধ্যমিক ও উচ্চ-চিকিৎসা বিরাট সংখ্যক মানুষের নাগালের বাইরে। উচ্চ-চিকিৎসা তো একজন মধ্যবিত্তকে দুচারদিনেই দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে পাঠাতে পারে। বেশিরভাগ মানুষ তাই প্রাথমিক ও নিম্ন-মাধ্যমিক চিকিৎসার পর জীবনকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়, যেহেতু কিছু করার নেই।

বিদ্যুতের সরবরাহ আগের চেয়ে ভাল, তবে ব্যবস্থাপনা উন্নত ও জনবান্ধব করা প্রয়োজন। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হয়েছে, কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থা এখনও লুণ্ঠনবৃত্তিক ও ঝুঁকিপূর্ণ। মুঠোফোনে ও অন্তর্জালিক যোগাযোগ ভাল ও বিস্তৃত হয়েছে, কিন্তু এসবের বাজারদর জনবিরোধী। মানুষে মানুষে ডিজিটাল বৈষম্য শ্রেণীবৈষম্যে নতুন রূপ ও মাত্রা যোগ করেছে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই বৈষম্যের বৃদ্ধি আশঙ্কাজনক মাত্রা লাভ করছে।  

স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অনেক সাফল্য যেমন আছে, তেমনি আছে অনেক ব্যর্থতা। কিন্তু এই সাফল্য ও ব্যর্থতার দাবিদাররা দুই পক্ষে বিভক্ত - এক পক্ষের লোক চারদিকে চোখধাঁধানো সাফল্য ছাড়া কিছুই দেখছে না, আরেক পক্ষ দেখছে কেবলই ব্যর্থতার বালুচর। দুই পক্ষ দুই রকম অন্ধ - কারণটা রাজনৈতিক। দুই পক্ষের লোকই একরকম ট্রাম্পের শিষ্য, ভাষা ও ট্রাম্পিয়ান। দেশের প্রকৃত সর্বজনীন ও গণমুখী উন্নতি সাধন করতে হলে উন্নতি আর অবনতিকে দাঁড়িপাল্লায় মাপার চেয়ে বেশি প্রয়োজন এর চরিত্র ও দিক নির্ণয়। ঠিক করা প্রয়োজন উন্নয়নকে কী করে সার্বিক ও সবার করা যাবে।             

এ কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বর্তমানকার উন্নয়ন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বাজারমুখী, লাভকেন্দ্রিক, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ও সর্বোপরি অনৈতিক। এটাই হলো চলতি তথাকথিত উন্নয়নের মৌল রূপ। ফলে কিছু ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে অন্যের স্বার্থহানির বিনিময়ে। সবকিছুই বাজারের পণ্যে পরিণত হচ্ছে। শিল্প-সাহিত্যেরও মানের ও গুণের মাপকাঠি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বাজারে কাটতি। জিনিসপত্র থেকে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎপাদন পর্যন্ত প্রায় সবই হচ্ছে নগদ লাভের কথা মাথায় রেখে। সকল রকম প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থ বলি দিয়ে কিছু ব্যক্তির উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। সমাজে প্রায় সকল রকম প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে প্রায় নিষ্ক্রিয়। প্রতিষ্ঠান নিষ্ক্রিয় করার গুটিকয় প্রতিষ্ঠানই হয়ে উঠছে অতিমাত্রায় সক্রিয়। উন্নয়নের পবিত্র বেদিতে বলি দেয়া হয়েছে স্বাভাবিক নৈতিক বোধবুদ্ধি। এভাবে তাসের ঘরের মত করে তৈরি হচ্ছে এই উন্নয়নের দুর্গ।                           

এ উন্নয়নটা দেখতে সেই মাটির ঢিবির মত যা তৈরি হয়েছে পাশে সমান বড় এক গর্ত খোঁড়ার মাধ্যমে। উন্নয়নপন্থীরা বলতে পারেন, গর্তটা আনুষঙ্গিক ক্ষতি মাত্র, অর্থাৎ ইরাক আক্রমণকারী যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাষায় কোল্যাটারাল ড্যামেজ। কিন্তু এই ক্ষতি বা ড্যামেজটা যদি অর্জন বা লাভের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে? যদি নতুন খোঁড়া গর্তটা হয় নতুন উন্নয়ন ঢিবির চেয়েও বড়? উন্নয়নবাদীরা একটু ভাববেন কি? দেশের নেতৃত্বকে ভাবতে হবে এমন ঢিবি সম্ভব কিনা যা সমান মাপের গর্ত তৈরি করে বানানো নয়। সম্ভব - সর্বজনীন উন্নয়নের মাধ্যমে, কাউকে পিছনে না ফেলে সবার এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।     

এইসব বিপজ্জনক গর্তের মধ্যে আছে পরিবেশ দূষণ ও ধ্বংস, জ্ঞানের বদলে সনদপত্র বাগানোর শিক্ষা, অতিমারির মুখে এক অসহায় স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি ও বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানের ধ্বংসসাধন, সাংস্কৃতিক চর্চার অনুপস্থিতি, নৈতিক চেতনার অবনতি ইত্যাদি। অনেক আগেই সিনেমার ১২টা বেজেছে, এখন নাটকের ১১টা চলছে। বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন নাই বললেই চলে, তারপরও স্বউদ্যোগে যেটুকু হয়, তারও পৃষ্ঠপোষকতা নেই। গর্ত আরও আছে সবাই জানি। এসব গর্ত ভরাট না করলে অর্থাৎ সমস্যার সমাধান না করলে অতীতের অর্জিত উন্নতি ভবিষ্যতে ধুয়েমুছে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। সারা বছরই এ দেশে গর্ত খোঁড়া ও গর্ত ভরার ব্যস্ততা লেগেই আছে, কিন্তু এই বড় মাপের গর্তগুলো ভরাট করার সদিচ্ছা ও উদ্যোগ রাষ্ট্রের নেই। 

উন্নয়নটা হয়েছে মূলত স্থূল বস্তুতান্ত্রিক ও আর্থিক। আর সেটা বৈষম্যকে বাড়িয়ে এবং তাদেরকে একেবারে পিছে ঠেলে দিয়ে যারা সৎ উপায়ে কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করে। এর ফল হচ্ছে এমন সব উন্নয়নবৃক্ষ যাদের গোড়ায় আছে অপরাধ, প্রতারণা, ধর্ষণ, খুন, সন্ত্রাস, মানসিক বিকৃতি, নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, ভয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-আদর্শিক কারণে মানুষকে বিভক্তিকরণ ইত্যাদি। ফলে এসব বৃক্ষ থেকে কী ফল পাওয়া যাবে তা ভাল করেই ধারণা করা যায়। 

এখন সরকারের আশু কর্তব্য এসব সমস্যাগুলো সমাধান করা। বিশেষ নজর দিতে হবে মানসিক সম্পদ বৃদ্ধি করে মনতান্ত্রিক উন্নয়ন ঘটানো। রাস্তাঘাট, সেতু, বিমান বন্দর, দালানকোঠা, রঙিন টেলিভিশন, স্মার্ট ফোন, বোতলজাত পানি, টিস্যু পেপার, প্রসাধনী সামগ্রীসহ শতশত জিনিস মানুষের প্রয়োজন। কিন্তু আরও বেশি প্রয়োজন মানসিক সম্পদ যা এসব জিনিসের ব্যবহারকে যথার্থ করবে। যার ফলে অপচয় হবে না, পরিবেশ ধ্বংস হবে না, অপ্রয়োজনীয় চাহিদা তৈরি হবে না, অহমবোধ সৃষ্টি হবে না ইত্যাদি। যার ফলে সমাজে শান্তি স্থাপিত হবে, সুখ আসবে এবং মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক দৃঢ় হবে।       

মানসিক সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় কীভাবে? শিক্ষার মাধ্যমে যা কেবল প্রাতিষ্ঠানিক চৌহদ্দির মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এ শিক্ষা ছড়ায় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যার জন্য ভাল সিনেমা ও সিনেমাহল দুইই লাগবে। সংগীত-নৃত্য-নাটককে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশময়। খেলাধুলা হতে হবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের বাহন, কেবল কর্পোরেট পুঁজির কবলে থাকা সোনার ডিম পাড়া হাঁস নয়। যে কোনো সামাজিক, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিক উদ্ভাবনকে যথার্থ পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে উদ্ভাবকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত, জাতিগত, পেশাগত, ধর্মীয় ও ক্ষমতার সঙ্গে সংযোগের পরিচয়কে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে। এও কি সম্ভব এ দেশে?

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী-উত্তর কালে আমাদের আশা উন্নয়নের পথে এসব গর্তগুলো থাকবে না, প্রয়োজনে পথ পরিবর্তন জরুরি। এ স্বাধীনতাকে আরও পূর্ণাঙ্গ ও অর্থবহ রূপে দেখা ও পাওয়া ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার।  


লেখক : সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (ছোটকাগজ) 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //