মওলানা ভাসানী : মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর

লেনিন তাঁর বিখ্যাত ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ নামক গ্রন্থটি শুরু করেন এভাবে-‘শোষিত শ্রেণিসমূহের মুক্তির সংগ্রামের নেতা ও বিপ্লবী চিন্তাবিদদের শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিহাসে বারংবার যা ঘটেছে, আজ মার্কসের শিক্ষার ক্ষেত্রে তাই ঘটছে। মহান বিপ্লবীদের জীবদ্দশায় শোষক শ্রেনিরা তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছিল। বর্বরতম বিদ্বেষ, ক্রোধান্বিত ঘৃণা এবং মিথ্যা ও কুৎসার সর্বাধিক শঠতাপূর্ণ প্রচার দ্বারাই তাদের শিক্ষাকে তুলে ধরেছিল। তাদের মৃত্যুর পরে প্রচেষ্টা নেওয়া হয় তাদেরকে অক্ষম প্রতিমায় রুপান্তরিত করা, তাদেরকে সিদ্ধপুরুষ হিসাবে চিত্রিত করা এবং শোষিত শ্রেণিসমূহের সন্তুষ্টির জন্য তাদের নামকে ঘিরে এক ধরনের মহিমান্বিত ভাব তৈরি করা। শোষিত শ্রেণিকে প্রতারিত করার প্রয়োজনে তারা একই সঙ্গে এই বিপ্লবীদের শিক্ষার বিষয়সমূহকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, শিক্ষার ধারকে ভোতা করে দেয় এবং বিকৃত করে।   

লেনিন যে কথাগুলো মার্কস এবং পৃথিবীর অন্যান্য বিপ্লবীদের  সম্পর্কে বলেছিলেন, তা তার নিজের সম্পর্কেও পরবর্তীতে প্রযোজ্য হয়েছে লেনিনের এই কথাগুলো অধিকাংশ বিপ্লবী ও মহান ব্যক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কথাগুলো মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রেও খুব ভালভাবে লাগানো যায়। বহু বিপ্লবী উপাদানে ভরা ভাসানীর জীবন। তিনি ছিলেন প্রধানত শোষিত মানুষের মুক্তিসংগ্রামের নেতা।  আমার সৌভাগ্য যে, আমি খুব কাছ থেকে এই নেতাকে দেখেছি। আর দেখেছি তার জীবদ্দশায় তার প্রতি শোষক শ্রেণির কী পরিমাণ ঘৃণা, বিদ্বেষ আর আক্রোশ ছিলো।  সারাজীবন তিনি শোষক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা নিগৃহীত ও নির্যাতিত হয়েছেন। আবার মৃত্যুর পরে সেই সব লোকদের লোক দেখানো প্রশস্তিও দেখছি। তাই, লেনিন পৃথিবীর সকল বিপ্লবীদের সম্পর্কে সাধারণভাবে যা বলেছিলেন, ঠিক তাই ঘটেছে মওলানা ভাসানীর ক্ষেত্রেও । 

মওলানা ভাসানী তার বিশাল জীবনে অনেক ধরনের কর্মকাণ্ড করেছেন। তিনি রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি এক বড় জনসমষ্টির কাছে পীর বা ধর্মীয় নেতা ছিলেন।  তিনি নির্দোষ সমাজসেবামূলক বহু কাজও করেছেন। তার মৃত্যুর পর যারা তাকে মহিমান্বিত করতে চায়, জীবদ্দশায় তাকে যারা একেবারেই সহ্য করতো না, সেই প্রতিক্রিয়াশীল ও বুর্জোয়ারা তার রাজনীতির বিপ্লবী উপাদানটুকুকে বাদ দিয়েই তার সম্বন্ধে আলোচনা করে।  মওলানা ভাসানী ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন অথবা তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছেন অথবা বন্যা ঝড়, মহামারীর সময় তিনি কিভাবে সেবা করেছেন এসব আলোচনা করলে শোষক শ্রেণির কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু এসব দিক তার জীবনের প্রধান দিক নয়। তার প্রধান দিক রাজনীতি। যখন সরকারি কর্মকর্তারা তার মাজারে গিয়ে ফুল দেয় তখন তারা তাঁর শিক্ষার বিপ্লবী দিকসমূহ একবারও উচ্চারণ করে না। বড়জোর তারা বলে মওলানা ভাসানী গরিবের বন্ধু ছিলেন। এর বেশি নয়। মওলানা ভাসানী যে গরিব, মেহনতি মানুষকে ধণিক শোষক ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে ক্ষোভে, ঘৃণায় বিদ্রোহে জাগিয়ে তুলতেন একথা কখনই তারা বলেন না বলতেও পারে না। অথচ এটাই ছিল ভাসানীর মহত্ত্বের প্রধান দিক। আর এই কারণেই তিনি তার সময়কালের অন্যান্য নামকরা রাজনীতিবিদের থেকে স্বতন্ত্র। 

ভাসানীর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রথমাংশ সম্পর্কে আমরা অনেকেই খুব কম জানি। আমিও জানি না। ব্রিটিশ আমলে তিনি প্রধানত আসামে রাজনীতি করেছেন। তবে এটুকু জানি যে, তিনি তখনও প্রধানত কৃষকের স্বার্থে সংগ্রাম করেছেন স্বাধীনতার জন্য।  তিনি লড়াই করেছেন জমিদারের বিরুদ্ধে, লড়াই করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। এর অধিক বিস্তারিতভাবে আমার জানা নেই। আমি প্রাধনত আলোচনা করবো পাকিস্তান আমল থেকেই। 

পাকিস্তান আমলের শুরু থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে আমরা তার কয়েকটি বিশাল অবদান চিহ্নিত করতে পারি, যেগুলোর যেকোন একটির জন্যও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন :

১। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানে প্রথম মুসলিম লীগের বিরোধিতা করে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করেন। 

২। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানে প্রথম অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবর্তন করেন। (এখানে উল্লেখ্য যে, ভাসানী প্রথম আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে মুসলিম লীগের স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করেন। সে সময় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি এবং একটু পরে আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে গঠিত গণতন্ত্রী পার্টি থাকলেও, তা তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। মওলানা ভাসানীই পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারণা তুলে ধরেন। মুসলিম শব্দ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব আনেন ভাসানী নিজেই। প্রথম দিকে সোহরাওয়ার্দী এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও পরে মেনে নিতে বাধ্য হন।)

৩। মওলানা ভাসানী পাকিস্তানে প্রথম সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। (এখনে উল্লেখ্য যে, ভাসানী যখন পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি এবং সিয়াটো- সেন্টোর বিরোধিতা করেন, তখন সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব এই চুক্তিগুলোর পক্ষে ওকালতি করেন।)

৪। মওলানা ভাসানীই প্রথম পূর্বপাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বলেন এবং স্বায়ত্বশাসনের দাবি উত্থাপন করেন। (এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৫৭ সালে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের বিরোধিতা করেন । 

৫। মওলানা ভাসানীই পাকিস্তানে প্রথম শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষেকে রাজনীতির মঞ্চে টেনে আনেন এবং মেহনতি মানুষের শ্রেণি শোষণ মুক্তির কথা তুলে ধরেন। (কমিউনিস্ট পার্টিও একই কথা বলতো। কিন্তু পার্টি খুব দুর্বল থাকায় তা তেমন সোচ্চার হয়নি।) 

৬। মওলানা ভাসানীই পাকিস্তানে প্রথম সমাজতন্ত্রকে ব্যাপক প্রচারে নিয়ে আসেন এবং জনপ্রিয় করে তোলেন।  

ভাসানী সরকারে যাননি, চিন্তাও করেননি। এমনকি বেশিরভাগ সময় তিনি রাজধানীর বাইরে গ্রামে থাকতেন। তার জীবন ধারণ ছিল একেবারে গরিব কৃষকের মতো। তার পরিবারের সদস্যদের জীবনমানও একই রকম ছিল। যেকোন গরিব মানুষ যেকোনসময় তার ঘরে প্রবেশ করতে পারতো। আসলে ভাসানী ছিলেন গরিব মানুষেরই একজন। আমাদের দেশের আর কোন নেতা সাধারণ মানুষের এতো আপন হতে পেরেছেন? ভাসানী ছিলেন সবার থেকে স্বতন্ত্র ব্যতিক্রমধর্মী নেতা। আমি এ প্রসঙ্গে আমার দেখা দু’টি ঘটনা তুলে ধরতে চাই। 

১৯৭৩ সালে মওলানা ভাসানী যখন জনগণের দাবি নিয়ে মতিঝিলের ন্যাপ অফিসে অনশন ধর্মঘট করছিলেন, তখনকার একটি ঘটনা। ন্যাপ অফিসের একটি ঘরে শুয়ে আছেন ভাসানী। অফিসের সামনে ভোর থেকে অধিক রাত পর্যন্ত প্রায় অর্ধ মাইল দীর্ঘ মানুষের লাইন। লাইন করে মানুষ ন্যাপ অফিসে ঢুকছে। যে ঘরে ভাসানী আছেন সেই ঘরের এক দরজা দিয়ে ঢুকে অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে এক পলক নেতাকে দেখার জন্য। কয়েকদিন ধরে ভোর থেকে রাতঅবধি এ মিছিলের আর কোন বিরতি নেই। 

এদিকে বৃদ্ধ ভাসানী অনশন করে চলেছেন ডাক্তাররা বলেন এভাবে মানুষ আসতে থাকলে ভাসানীর শরীর খারাপ হবে। তাই যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলেন। তবে একেবারে নিষিদ্ধ নয়। যেসব গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসতেন, তাদের জন্য ভাসানীকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হতো। ব্যাপারটি মওলানা ভাসানীর নজরে পড়েছে। তিনি দায়িত্বরত আমাদের কয়েকজনকে ডেকে বললেন লোকজন আসে না কেন? বুঝেছি ... যদি লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি পরা কোন লোক না আসতে পারে-তবে টাই পরা, প্যান্ট পরা, কোট পরা কাউকে এখানে ঢুকতে দেবে না। ভাসানীর কথা বলার একটা নিজস্ব ধরন ছিলো, তার ভাষারও বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিলো। তার এই কথার মমার্থ হলো-তিনি তথাকথিত ভদ্রলোকদের চান না, তিনি অসুস্থ অবস্থাতেও থাকতে চান সাধারণ গরিব মেহনতি মানুষের মাঝে। আসলে তিনি ছিলেন তাদেরই লোক। তাদের নেতা, শুধু তাই নয়, ধনিক শ্রেণির প্রতি ছিলো প্রচণ্ড ঘৃণা। খেটে খাওয়া মানুষ, নির্যাতিত মানুষের প্রতি ছিলো তার অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং একইভাবে ছিল ধণিক গোষ্ঠী, শোষক ও অত্যাচারীর প্রতি চরম ঘৃণা।  

আরেকটি ঘটনার কথা বলবো। ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর একেবারে প্রথম দিক। আমি এবং রাশেদ খান মেনন অনেক পথ ঘুরে উপস্থিত হয়েছি টাঙ্গাইল শহর থেকে অনেক দূরে বিন্নাফৈর গ্রামে। সেখানে গেলাম, টাঙ্গাইল শহরের তখনও পতন হয়নি, তবে হবে হবে মনে হচ্ছে। টাঙ্গাইল তখনও মুক্ত। ছাত্ররা সশস্ত্র অবস্থায় পাহারা দিচ্ছে। তারা ঢাকার খবরে স্বাভাবিকভাবেই উত্তেজিত এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উর্দুভাষীদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রাণভয়ে এক বিহারী কুলি আশ্রয় নিয়েছে ভাসানীর কাছে। আমি দেখলাম ভাসানী খুব উত্তেজিত। তিনি রাগতস্বরে বলছেন,  হোক সে বিহারী, কিন্তু সে তো কুলি। আমি বেঁচে থাকতে কুলির গায়ে হাত দিতে দেবো না। এই কথা থেকে বোঝা যায়, ভাসানী আসলেই ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী। যে ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন, যে ভাসানী একসময় (১৯৫৬ সালে) পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম বলেছিলেন, সেই ভাসানী বাঙ্গালি যোদ্ধাদের হাত থেকে একজন অতি সাধারণ বিহারীকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এসেছেন, কারণ সে বিহারী হচ্ছে মেহনতি মানুষ। দেশ, জাতি, ধর্মেরও ঊর্ধ্বে ছিল তার শ্রমজীবী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।  

ঘটনাটি ৭১ সালের। যে দিনের ঘটনাটি বলছি, সেদিনই বিকাল বেলা পাকবাহিনী টাঙ্গাইলে ঢোকে। ওই রাতে আমি ভাসানীর বাড়িতেই ছিলাম। পরদিন বিন্নাফৈরের দিকে এগিয়ে আসে পাকবাহিনী এবং ভাসানীর জীর্ণ-শীর্ণ বাড়িতে আগুন দেয়। পাকবাহিনীর আসার খবর পেয়ে আমরা সরে যাই। মওলানা ভাসানীও বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন একাকী গেঞ্জি গায়ে টুপি ছাড়া। কাউকে সঙ্গে নিতে রাজি হননি। পরে আমরা তাকে অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। কয়েকদিন পর আকাশবাণীর খবরে জানলাম, তিনি ভারতে গেছেন। ভারতেও আমরা চেষ্টা করেছি তার সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু কেউ তার ঠিকানা বলতে পারেনি। আসলে তিনি ভারতে গৃহবন্দী ছিলেন। যুদ্ধের সময় কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন ও আমার উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানীর একটি ছোট চিরকুট এসেছিল ; ততে লেখা ছিল-‘তোমরা আপস করো না যুদ্ধ চালিয়ে যাও’। আরও বোধ হয় এক আধটা লাইন থাকতে পারে, ঠিক মনে নেই।  এই ছোট্ট চিঠিটি তাৎপর্যপূর্ণ। এটা সেই সময় যখন কনফেডারেশন ইত্যাদি প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর চির-প্রতিবাদী ভাসানী নিশ্চুপ থাকেননি। সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তিনি ঝড় তুললেন। সবাই জানেন, একইসঙ্গে ভারতবিরোধী প্রচারেও নামেন। তিনি দেখেছিলেন রক্তের বিনিময়ে অর্র্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু তার ভারতবিরোধী প্রচারের ধরণ আমাদের অনেকের পছন্দ হয়নি। আমারও হয়নি। বিশেষ করে কখনও কখনও এই প্রচারণায় সাম্প্রদায়িকতার কিছুটা ভাব আছে বলে আমার মনে হয়েছে। আমি ব্যথিত হয়েছি। এতো বড় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানুষটির কাছ থেকে আমি এটা আশা করতে পারিনি। এই ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমি একদিন ঢাকায় পিজি হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি তখন সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন- ‘আমি যা করছি, তা আমার কৌশল। আমাকে এটা করতে হবে। কিন্তু তোমরা আমার বিষাক্ত নিঃশ্বাস থেকে শত হাত দূরে থাকো।’ মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের কৌশল নিয়েছেন, সে সবের সঙ্গে আমরা একমত নাও হতে পারি। কিন্তু জনগণের মুক্তির লক্ষ্য ও আদর্শের জায়গা থেকে তিনি কখনও একবিন্দু সরে আসেননি।

আমার মনে পড়ে ১৯৭২ সালেও তিনি আমাকে একই ধরনের একটা কথা বলেছিলেন। আমাকে বললেন- ‘তোমার ন্যাপ করার দরকার নাই। তুমি কমিউনিস্ট পার্র্টি করো। এখন কমিউনিস্ট পার্টি আইনী। এখন কমিউনিস্ট পার্টি দরকার। ওরা (অর্থাৎ রুশপন্থীরা ) যে কমিউনিস্ট পার্টি করছে, ওটা তো খাঁটি কমিউনিস্ট পার্টি নয়, ‘তোমরা একটা খাঁটি কমিউনিস্ট পার্টি করো।’ এরপর তিনি আরও যা বললেন, তা সত্যিই চমৎকার। তিনি বললেন- ‘কোন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি না থাকলে কি সেটা সভ্য দেশ হলো। বাংলাদেশেও, যতো ছোটই হোক, একটা কমিউনিস্ট পার্টি থাকা দরকার। আর তা না থাকলে দেশের ভবিষ্যত কোনদিন ভালো হবে না।’ 

কমিউনিস্টদের প্রতি মওলানা ভাসানীর অসম্ভব দরদ ও সহানুভূতি ছিল। তিনি তার পার্টিতে কমিউনিস্টদের আশ্রয় দিয়েছেন, নেতৃত্বে বসিয়েছেন। তিনি মনেপ্রাণে কমিউনিস্টদের সাফল্য কামনা করতেন। আত্মগোপনকারী কমিউনিস্টদের সঙ্গে সবসময় তাঁর  যোগাযোগ থাকতো। শুধু তাই নয় আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি এক সময় তার এতো আস্থা ছিল যে, পার্টি যা সিদ্ধান্ত নিতো, তাই তিনি দ্বিধাহীন-চিত্তে মেনে নিতেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র প্রয়াত নেতা কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা খুবই সৌভাগ্যবান যে মওলানা ভাসানীর মতো এমন এক জাতীয় নেতা পেয়েছেন। কোন দেশের কমিউনিস্টরা এমন সুযোগ পেয়েছে?’ দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা সে সুযোগ ভালভাবে কাজে লাগাতে পারিনি। 

মওলানা ভাসানী কমিউনিস্ট ছিলেন না, কিন্তু কমিউনিস্টদের সবচেয়ে কাছের মানুষ ছিলেন। কমিউনিস্টরা  তার উপর নির্ভর করতে পারতো। মওলানা ভাসানী মনেপ্রাণে সমাজতন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শ্রেণি সংগ্রামে। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন বিপ্লবী।  

মওলানা ভাসানী অতি আধুনিক মানুষ ছিলেন। তিনি কখনই গোঁড়া নন। যেকোন সর্বাধুনিক আইডিয়া তাকে আকৃষ্ট করতো। তিনি বোঝার চেষ্টা করতেন এবং নিজের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করতেন। কেউ কেউ বলতে পারেন যে লোক পীরগিরি করতেন, পানিপড়া দিতেন, তিনি কি করে আধুনিক হলেন? অত্যন্ত পশ্চাৎপদ মানুষের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তিনি যে কৌশল নিতেন, পানিপড়া ইত্যাদি তার অন্তর্ভূক্ত। আমি ভালো করেই জানি যে, তিনি পানিপড়ায় বিশ্বাস করতেন না। আমি দেখেছি কোন রোগীকে পানিপড়া দেওয়ার পর, মওলানা ভাসানী তাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দিতেন এবং সম্ভব হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার উপদেশ দিতেন, এর জন্য তিনি অর্থ সাহায্যও করতেন। তাকেও এও বলতে শুনেছি- এই পানিপড়ায় রোগ সারবে না, ডাক্তার দেখাও, এটা খাও বা ওটা খেয়ো না ইত্যাদি। ভাসানীর মুরিদ হবার মজার দৃশ্য আমি দেখেছি। মুরিদরা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মওলানা সাহেব তাদেরকে শপথ করাচ্ছেন তিনটি বাক্য উচ্চারণ করিয়ে। সেগুলো হচ্ছে “১.আল্লাহ রসূলের বাণী মানিয়া চলিবো, ২. কৃষক সমিতির সদস্য হইবো, ৩. সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করিয়া আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিপতি, জমিদার, জোতদার, দুনিয়ার তামাম শোষক ও জালেমের বিরুদ্ধে সারা জীবন লড়াই করিয়া যাইবো।”

এখানে লক্ষ্যণীয়, ভাসানী তাঁর মুরিদদের কৃষক সমিতির সভ্য হবার জন্য শপথ পাঠ করালেও, তাঁর ন্যাপের সভ্য হওয়াকে বাধ্যতামূলক করছেন না। মওলানা ভাসানী ইসলাম ধর্মের সেই বিষয়গুলোকে তুলে ধরতেন, যেগুলো ধনীর বিরুদ্ধে গরিবের লড়াইকে সাহায্যে করে। তিনি একইসঙ্গে খলিফা ওমরের দৃষ্টান্ত এবং মাও সেতুঙের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেন। এ দেশের ত্যাগী কমিউনিস্টদের (কমরেড মোজাফফর আহমেদ এর নাম তিনি অনেকসময় সম্মানের সঙ্গে বলতেন) আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই উপমহাদেশের সংগ্রামী জাতীয়তাবাদী নেতাদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতেন বক্তৃতায় ও সাধারণ আলোচনায়।  

কোন জাতির ইতিহাসে যদি কোন মহৎ জাতীয় নেতা থেকে থাকে তবে কমিউনিস্টদের তাকে অস্বীকার করা কোনভাবেই উচিত হবে না এবং তাঁর মহৎ অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা এবং তার কাজকে আরও এগিয়ে নেওয়াই হবে আমাদে কর্তব্য। মাও সেতুঙ এভাবেই সান ইয়েৎসেনকে দেখেছেন এবং প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের ইতিহাসে এমনই এক জাতীয় নেতা ছিলেন তিনি মওলানা ভাসানী। কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙ্গার যথার্থই বলেছিলেন- আমরা বড় ভাগ্যবান। এই সৌভাগ্যকে আমরা কতোটুকু কাজে লাগাতে পেরেছি, সে প্রশ্ন স্বতন্ত্র। জীবদ্দশায় আমরা কমিউনিস্টরা এই মহাপুরুষের কাছ থেকে কতোটুকু নিতে পেরেছি বা পারিনি সে আলোচনা এখন থাক। কিন্তু ভবিষ্যতের বিপ্লবী সংগ্রামে আমাদের দরকার হবে মওলানা ভাসানীর। সে জন্য ভাসানীকে আজ উদ্ধার করতে হবে প্রতিক্রিয়াশীলদের খপ্পর থেকে, যারা মৃত্যুর পরে ভাসানীকে খণ্ডিত ও বিকৃতভাবে চিত্রিত করতে চাচ্ছে। অথচ জীবদ্দশায় ভাসানী কোনদিন প্রতিক্রিয়াশীলদের খপ্পর ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাদের চিরশত্রু। আজও ভাসানী হোক শোষক ও প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রেরণার উৎস, সকল অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি সর্বদাই প্রাসঙ্গিক।


লেখক : বাম রাজনীতিবিদ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //