শেকড়ের রাজনীতি, রাজনীতির শেকড়

রাজনীতি বিষয়টিই শেকড়ের। তারপরও আলাদা করে শেকড়ের রাজনীতির কথা বলতে হয়। কারণ রাজনীতি কুফল শেকড় পর্যন্ত পড়লেও রাজনীতির সুফল শেকড় পর্যন্ত পৌঁছায়নি। সবারই জানা, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আলাদা করে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস করা হয়েছে। প্রায় ত্রিশ বছরের বামফ্রন্ট-দুর্গ ভেঙে তারা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু গুণগত তেমন কোনো পরিবর্তন আনার বদলে তারা নতুন করে সমস্যা তৈরি করছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশের নানান সুবিধা নিয়ে যেসব চুক্তি কেন্দ্রীয় সরকার করার কথা তা করতে বাধা দিয়েছে তৃণমূল। তাহলে কোন মানুষের জন্য তারা রাজনীতি করে? দেশের মানুষের ভালো করতে হবে অন্য দেশের মানুষের ক্ষতি করে- এই নীতির সঙ্গে হিটলারি নীতির তফাৎ কোথায়? 

নোংরা ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চেয়ে নোংরা রাজনীতি আর কী হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সর্বত্রই তা-ই চলছে। যদিও দেশে দেশে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। একদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায় কেবল সে দেশের ব্যাপার থাকে না, সেটি হয়ে ওঠে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। অথচ এখনো সেই অপরাধ করতে দ্বিধা করে না আমেরিকা ও তাদের মিত্র দেশগুলো। যাদের নাকি আমরা সভ্যদেশ বলে জানি। কিন্তু খতিয়ে দেখলেই টের পাওয়া যাবে অন্ধকারের রাজনীতিকে তারা কোথায় পৌঁছে দিয়েছে।

কিন্তু এর ভেতরেরও গভীরতর ব্যাপার আছে। আমরা চোখের সামনে দেখি রাজনীতি চালায় বারাক ওবামা বা বুশের দল। কিন্তু আদতে কলকাঠি নাড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ধনিক-বণিক গোষ্ঠী। যাদের নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল রিজার্ভ- তারাই হলো যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত কিছুর হোতা। তাদের হাতের পুতুল বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং আরো যা যা সাহায্য সংস্থা। এরা গোঁড়া কেটে আগায় পানি ঢালার কাজ করে। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ তাদেরই মদতে হয়েছে। এখন আমরা তো সবচেয়ে ধনী হিসেবে বিল গেটসের নাম জানি। কিন্তু তিনি তো ধনসম্পদ অর্জন করাদের মধ্যে নতুন। তাহলে পুরানোরা কোথায়? তারা কী গরীব হয়ে গেছে? মোটেও তা নয়। তারা দিনে দিনে আরো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাদের ভেতর আছে রথচাইল্ড, রকফেলার, জন ফোর্ডের উত্তরাধিকারিরা। তারাই চালায় মার্কিন পুঁজির বড় অংশ। তাদের হাতেই ব্যাংক, বীমাসহ অর্থ ও পুঁজির মূল জায়গাগুলো। সেখান থেকে সারা বিশ্বে তারা তাদের স্বার্থ রক্ষায় যা যা দরকার তা-ই করে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলছি কারণ এটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পুঁজিবাদী দেশ। এর আরেকটি চেহারা- আন্তর্জাতিক মাস্তানের চেহারা। বিশ্বমোড়ল। জার্মানি বা জাপানের মতো দেশের অর্থনীতি যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়ার পরও, বা পার্শ্ববর্তী কানাডাও দিনে দিনে অর্থনীতিতে এগিয়ে যাওয়ার পরও মোড়লগিরিতে তারা এর ধারে কাছেও নেই। অনেকেই বলেন, আমেরিকা নামের ভেতরেই যে ক্যারিশমা আছে তা আর কারো নেই। ফলে আগামী দিনে চীনের মতো দেশ যতই শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠুক আমেরিকার নামের ক্যারিশমা তাদের নেই। এই ক্যারিশমার বদৌলতেও তাদের অর্থনীতি দিনে দিনে অন্তঃসারশূন্য হওয়ার দিকে যেতে শুরু করলেও আগামী কমপক্ষে দুশো বছর লাগবে তাদের দাপট কমতে।

রাজনীতির অন্যতম দিক এই ক্যারিশমা বিষয়টি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিবুর রহমানেরই সেই ক্যারিশমা ছিল। কিন্তু তিনি কি কেবল ক্যারিশমাতেই মুগ্ধ করেছেন সেই কালের বাঙালিকে? ইতিহাসের পাঠক মাত্রই জানেন ভাসানীর মতো নেতা এবং তিনি বা তার সময়ের নেতারা- একেবারে খালি হাতে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছেন, সামান্য চিঁড়ামুড়ি খেয়ে দিন পার করেছেন, নৌকার ঘুরে ঘুরে দেশের সেই সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েছেন যেখানে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বাস। তাদের আগে আবুল হাশিমের মতো নেতারাও কাজ করেছেন। মুসলিম লীগকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যতই বলা হোক গ্রামের জোতদার আর ছোটখাটো জমিদার ভূস্বামীদের দল ছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু তাদের সেই সময়ের নেতাকর্মীরা তৃণমূলে পৌঁছাতে পেরেছিল এবং তারা তখন দেখেছেন মানুষের স্বার্থ। তখন অর্থবিত্তের অধিকারী হওয়ার জন্য রাজনীতি করার কথা তারা চিন্তা করেননি। মুসলিম লীগের পেছনে কতটা সাম্প্রদায়িকতা কাজ করেছে, কতটা ছিলো বৃটিশের চাল তারা সেই হিসাবও করতে যাননি। 

মুসলিম লীগের রাজনীতির সূত্রে দেশ ভাগ হয়েছে- এই ঢালাও মন্তব্য নিয়ে তর্ক তোলার কোনো প্রাসঙ্গিকতা এখানে নেই। আমরা দেখতে চাইছি বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগ দেশের মানুষের শেকড়ে গিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিল। কিন্তু মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় শক্তির সবকিছু পাকিস্তানের দিকে মোড় নিলো এবং পূর্ববাংলার মানুষকে বঞ্চিত করা হলো। পরে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষও মুসলিম লীগের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। দেশভাগের অল্প সময় পরই বাংলাভাষার ওপর দমনপীড়নের সূত্রে মুসলিম লীগের শেকড় আলগা হতে শুরু করে। এবং সেখানে ক্রমে ক্রমে শেকড় ছড়াতে থাকে আওয়ামী মুসলিম লীগের রাজনীতি। সোহরাওয়ার্দি ভাসানী ও আরো আরো অনেক নেতার পরিশ্রমের ফলে আওয়ামী লীগ তার গা থেকে মুসলিম তকমাটি খসিয়ে ফেলে।

এদিকে চলে বামপন্থীদের শেকড় গাড়ার কাজ, কিন্তু নানান কারণেই সেই রাজনীতি প্রান্তিক মানুষকে টানতে পারেনি। আওয়ামী লীগই বাংলাদেশে রাজনীতিকে শেকড়ে পৌঁছে দিয়েছিল, শেকড়ের জন্য দরকারি রাজনীতির দিকগুলো তুলে ধরেছিল। বাঙালিদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়ে ক্রমে ক্রমে স্বাধীনতার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল তারাই। সেই সূত্রে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কিন্তু তারপর দেশ স্বাধীনের পরই আওয়ামী লীগের চেহারা সম্পূর্ণ বদলে যায়। বদলে যান স্বয়ং শেখ মুজিব। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না যে, তাঁর নামেই চলেছিল বাংলাদেশে মুক্তি সংগ্রাম। কিন্তু স্বাধীনতার পর পরই এক ভিন্ন দৃশ্যপটে আর্বিভাব হন তিনি। তাঁকে রাতরাতি ঘিরে ফেলে সুবিধাবাদী লোকজন এবং দূরে সরিয়ে দেওয়া হয় স্বাধীনতার মূল ডায়নামো তাজউদ্দিন আহমেদকে। সেই ইতিহাস এখানে টেনে আনার বোধ করি দরকার নেই। সবাই কমবেশি জানেন কী করে শেখ মণির কারণে দুটো মারাত্মক ভুল ঘটে এবং ভুল দিকে চলে যায় বাংলাদেশের রাজনীতি। একদিকে তাজউদ্দিনকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়, অন্যদিকে ছাত্রলীগ ভেঙে জাসদ ছাত্রলীগ তৈরি হয় সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির যে-উজ্জ্বল ইতিহাস ছিল- তা রক্তে আগুনে খুনে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সংগ্রামরত ছাত্রজনতা ও কৃষকশ্রমিকের কানে তুলে দেওয়া হয় পাকিস্তান বাহিনী বর্তমানের মূল শত্রু হলেও, তারচেয়ে বড় শত্রুর মোকাবেলা করার সময় এসে গেছে। দেশ স্বাধীন করেই তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে।- পরিস্থিতির এই জটিলতা অল্পকিছু লোকই তৈরি করেছিল। তাদের ছদ্মবেশী শ্রেণিসংগ্রামের কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি শেকড়ের যাওয়ার চেয়ে আরো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বলতে গেলে সব রকমের তাল কেটে যায়। একদিকে সদ্য স্বাধীন দেশে সীমাহীন সংকট এবং অন্য দিকে রাজনৈতিক অরাজকতায় বাংলাদেশের মানুষের সমস্ত স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সেই ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন আজ অবদি জোড়া লাগেনি। কারণ রাজনীতির সুফল আজো তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছেনি। 

আর এখন তো রাজনীতি হয়েছে স্রেফ প্রচারমাধ্যম আর হৈ হট্টগোলের বিষয়। আড়ালে আছে লুটপাট, এছাড়া এর আর কোনো ভূমিকা নেই। লুটপাটের বিষয়টাকে আড়াল করতে কিছু বায়বীয় জিনিস নিয়ে অনর্থক তর্কবির্তক চালু রেখে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার কাজটিই রাজনীতিতে প্রধান হয়ে উঠছে। 

ধর্মীয় কী রাজনৈতিক কোনো চেতনা দিয়েই কোনোকালে মানুষের জীবন চলেনি। মানুষের জীবনের জন্য চাই প্রথমত জানের নিরাপত্তা; আর এজন্য চাই অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা এবং এর প্রত্যেকটি সুষ্ঠুভাবে আদায়ের জন্য চাই জবানের অধিকার। জান ও জবানের এই অধিকার আজো অব্দি বাংলাদেশের মানুষ পায়নি। তাই যখন বলা হয় পরাধীন বাংলাদেশে মানুষ যতটা স্বাধীনভাবে নিজের মত ও অমত প্রকাশ করতে পারতো- স্বাধীন বাংলাদেশে তা ক্রমে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। সংবাদপত্র ও রেডিও-টিভি হয়ে উঠেছে মূলত ব্যবসা। এর দায়বদ্ধতা নামে মাত্র। বিশেষ করে রাজনীতিকে শেকড়ের নিয়ে যেতে এবং শেকড়ের রাজনীতিকে শক্তি যোগাতে এর ভূমিকা খুব একটা জোরালো নয়। দায়সারা মাত্র। দায়সারা না হলে তিনটি কাজ তো অন্তত করায় এরা ভূমিকা পালন করতে পারতো। বা এখনো পারে। 

শিক্ষার জন্য ভালো স্কুল, স্বাস্থ্যের জন্য ভালো খেলার মাঠ এবং মানসিক বিকাশের জন্য ভালো লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা- এই তিনটিকেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শেকড়ের রাজনীতির মূল কাজটি সম্পন্ন করার উদ্যোগ কি তাদের মাধ্যমে কোথাও নেওয়া হয়েছে? তা যদি না হয়ে থাকে তো ক্ষমতার জন্য করা রাজনীতি কখনো মানুষের জন্য রাজনীতি হয়ে উঠতে পারবে না। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকের দিকে নিয়ে না গেলে দেশে মানুষের গুণগত পরিবর্তন আসার কোনো সম্ভবনা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো গোষ্ঠীই চায় না, এই তিন মূল বিষয় সবার আগে অর্জিত হোক। 

গ্রাম তো দূরের কথা শহরে পর্যন্ত ভালো স্কুল নেই। খেলার মাঠ তো বিরল এবং পাড়ায় মহল্লায় ভালো লাইব্রেরির কথা এখন তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না। ফলে গ্রাম বলি আর শহর বলি, রাজনীতির শেকড় সবখানে গেঁড়ে বসলেও শেকড়ের রাজনীতি, মানুষের অধিকার, তার প্রকৃত বিকাশের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার কাজটি এখনো সুদূরপরাহত। শেকড়ের রাজনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য কিশোর-কিশোরীদেরকেই রাজনীতি ও অর্থনীতির বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন করা দরকার। আর সেটি কোনো দলীয় আর্দশের ভিত্তিতে নয়। মুক্তমনে তাদের চিন্তার বিকাশ ঘটানোর কাজটি পরিবার ও স্কুল থেকেই শুরু করতে হবে। 

স্বাধীনতার পর অনেক বছর তো পার হলো। আমাদের পূর্বসূরিদের কারো কারো বুকের হাহাকার হয়ে একটি প্রশ্ন বেজে ওঠে- ‘আমার কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?’ উত্তর সবারই জানা। কিন্তু বর্তমানে আমরা যারা সচেতনতার কথা বলি, তাদের একটি প্রশ্ন বারবার করার দরকার- ‘আমরা কোন বাংলাদেশ রেখে যাচ্ছি?’ আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি?- এই প্রশ্নের সূত্রে যদি একটা একটা করে মানুষের মনে চেতনা তৈরি হয়, মানুষের মনে যুক্তির উদ্বোধন যদি ঘটে তাহলে তারা ঠিকই বুঝতে পারবেন, আমাদের কিছু কাজ, কিছু দায় আছে, আর তা হলো, আমাদের প্রতিটি মানুষকে নিজের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা। আর তাতেই শেকড়ের রাজনীতি জোর পাবে, রাজনীতির সুফল প্রান্তিক মানুষের দোরগাড়ায় পৌঁছে যাওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।


লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //