গ্যাসের দাম কেন বাড়ে?

গ্যাসের দাম কি আবারও বাড়ছে? এখন দুই চুলা গ্যাস ব্যবহারের জন্য ভোক্তাকে দিতে হয় ৯৭৫ টাকা; কিন্তু সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলাসহ তিতাস, জালালাবাদ, বাখরাবাদ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। তারা গ্যাসের খুচরা মূল্য প্রায় ১১৭ শতাংশ বা দ্বিগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে। যেখানে রান্নার জন্য দুই চুলার সংযোগে ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১০০ টাকা এবং এক চুলার ব্যয় ৯২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও কমিশন এটি ফেরত পাঠিয়েছে। ফেরত পাঠানোর অর্থ এই নয় যে, দাম বাড়বে না। বরং নতুন করে প্রস্তাব যাবে এবং তার ওপর শুনানি হবে। 

অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, শুনানিতে দর-কষাকষি ও বিতর্কে কোম্পানিগুলো কিছুটা নমনীয় হলেও, শেষ পর্যন্ত দাম ঠিকই বাড়ে। বিপরীতে ভোক্তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ, বিশেষ করে রাজধানীতে যারা পাইপলাইনের গ্যাস ব্যবহার করেন, তারা বেশ কিছু দিন ধরেই গ্যাস সংকটে ভুগছেন। অধিকাংশ এলাকাতেই সকাল ১০টার পরে গ্যাসের চাপ থাকে না। ফলে এই শীতের মওসুমে একদিকে রান্না করা, খাবার গরম করা এবং গোসলসহ দৈনন্দিন কাজরে জন্য পানি গরম করার কাজগুলো ব্যাহত হচ্ছে। অর্থাৎ রান্নাসহ দৈনন্দিন কাজের জন্য ভোক্তারা পর্যাপ্ত গ্যাস পাবে না, অথচ মাসে মাসে বিল দিতে হবে। উপরন্তু নিয়মিত বিরতিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হবে। এটা সাংঘর্ষিক নয় কি? প্রত্যাশিত মাত্রায় গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, মানে হলো সেবার মান কমছে। তো সেবার মান কমিয়ে পণ্যের দাম বাড়ানো হয় কী করে? একদিকে গ্যাসের চাপ কম, অন্যদিকে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব। এ রকম সাংঘর্ষিক অবস্থার মধ্য দিয়েই চলছে দেশের জ্বালানি খাত।

যদিও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, গ্রাহক অসন্তোষ যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কাজ চলছে। জ্বালানির অপচয় কমাতে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অব্যাহত রাখার কথাও বলেন তিনি; কিন্তু প্রশ্ন হলো, কত টাকা পর্যন্ত বাড়ালে গ্রাহক অসন্তোষ হবে না? দুই চুলা গ্যাসের বিল যখন ৯৭৫ টাকা করা হলো, তখন গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হয়নি? এখন বিভিন্ন কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর শুনানি করে যদি দুই চুলা গ্যাসের মাসিক বিল ১২শ’ বা ১৫শ’ টাকাও করা হয়, সেটি কি অসংখ্য মানুষের জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করবে না? এটি কি গ্রাহকদের অসন্তোষের কারণ হবে না? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, গ্যাসের দাম কখনোই দশ বিশ টাকা বাড়ে না। সুতরাং এবার ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে রাউন্ড ফিগার করে এক হাজার টাকা করা হবে, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং আরও বেশি বাড়বে।

বাস্তবতা হলো, করোনোর দীর্ঘ প্রকোপে যখন অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন, বেকার হয়েছেন, অসংখ্য মানুষের আয় কমে গেছে, সেই সময়ে নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগটাই অমানবিক। তাতে দাম বাড়ানোর অংকটা যা-ই হোক।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, তিতাস গ্যাস কোম্পানি গত চার বছরে ১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বিক্রির ২২ ভাগই মুনাফা করেছে কোম্পানিটি। অথচ এখন তারাই গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে কমিশনে দৌড়ঝাঁপ করছে। কোম্পানি লাভে থাকার পরেও কেন গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে? প্রতিষ্ঠান লাভে থাকার পরেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি কতটা যৌক্তিক এবং রাষ্ট্র কি ব্যবসা করতে পারে কি-না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।

কিছু দিন আগেই জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামে। ভরা মৌসুমেও শীতকালীন সবজির দাম রাজধানীর বড় বাজারগুলোতেও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। যার পেছনে মূল কারণ বলা হচ্ছে, জ্বালানির তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া। এর মধ্যে এখন যদি আবার গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়, সেটি নতুন করে সংকট তৈরি করবে নানা খাতে। বিশেষ করে গ্যাসের দাম বাড়ালে একই যুক্তিতে বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেবে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস।

করোনার কারণে রাষ্ট্রের বিপুলসংখ্যক মানুষ যখন আর্থিক সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছেন, তখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া কোনোভাবেই জনবান্ধব নীতি হতে পারে না। বরং আমরা করোনার কারণে চলমান লকডাউনের সময় অনেক বাড়িওয়ালাকে দেখেছি বাসা ভাড়া কমিয়েছেন। ব্যক্তি পর্যায় থেকে যখন এ রকম মানবিক উদ্যোগের খবর পাওয়া যায়, তখন রাষ্ট্র কী করে মানুষের বিপদের মুহূর্তে  দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে বেশি জরুরি জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়? রাষ্ট্রকে তো আরও বেশি মানবিক হতে হয়। সুতরাং অতিমারির বাস্তবতায় গ্যাস বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নয়, বরং কমানো উচিত।

অস্বীকার করা যাবে না, প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ একসময় শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে, ভয়াবহ জ্বালানি সংকটে পড়বে দেশ। গ্যাস পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে যাবে। যে কারণে দীর্ঘ দিন ধরেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু সেই ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাপেক্স একা না পারলে বেসরকারি খাতের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বেও অনুসন্ধান কূপ খননে গতি আনা উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন; কিন্তু এই ইস্যুতে খুব বেশি কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। 

নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তার কী প্রভাব পড়বে? এই ইস্যুতে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে  ফেসবুকে সাধারণ মানুষ নানারকম প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। যেমন- একজন নারীর একটি মন্তব্য এ রকম : ‘দিনের বেলা গ্যাসই থাকে না। পর দিনের রান্না করতে হয় আগের রাতে। দৈনন্দিন কাজের জন্য পানি গরম করার মতো গ্যাসও থাকে না। এরপরও যদি গ্যাসের দাম বাড়ে, তাহলে সারারাত গ্যাস জ্বালিয়ে রাখব।’ মানুষের এই ক্ষোভের ভাষা রাষ্ট্রকে বুঝতে হয়। আমলে নিতে হয়।

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী যেমনটা বলেছেন, গ্রাহক অসন্তোষ যাতে না হয়, সেটি তারা বিবেচনা করবেন; কিন্তু গ্রাহকরা তো এখনই অসন্তুষ্ট। প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার টাকা বিল দিয়েও তো তারা সময়মতো গ্যাস পাচ্ছে না। এর মধ্যে আবার দাম বাড়ানো হলে সেটি নতুন করে যে অসন্তোষ তৈরি করবে, সেটি বোঝার জন্য কোনো গবেষণার প্রয়োজন নেই। তবে রাষ্ট্র জানে, নতুন করে আবারও গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে, তাতে সাধারণ মানুষ কিছুই করতে পারবে না। গণমাধ্যমে গ্রাহকদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে কিছু রিপোর্ট হবে; বিশেষজ্ঞরা কিছু কলাম লিখবেন; সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু গালিগালাজ হবে। তারপর সবই ঠান্ডা। আখেরে কোম্পানিগুলোর স্বার্থে গ্যাসের দাম ঠিকই বাড়বে। আবার সেই ধারাবাহিকতায় হয়তো কিছু দিনের মধ্যে বিদ্যুতের দামও বাড়বে। মানুষ কিছু দিন চিৎকার করবেন। কিছু দিন পরে আবার নতুন কোনো ইস্যু পেয়ে তারা গ্যাস-বিদ্যুতের ইস্যু ভুলে যাবেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //