সব চক্রান্তের গোড়ার কথা

“দৃষ্টিভঙ্গি বদলান, জীবন বদলে যাবে”, “আমাদের মূল সমস্যা দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা”-  এ জাতীয় কথা বহুবার বহুভাবে আমরা শুনে আসছি। বার বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে যে, যাবতীয় নেতিবাচক চিন্তাভাবনা থেকে দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাতে হবে। যেকোনো সমাজ উন্নয়ন বা সেবামূলক সভা সেমিনারে যাবেন, সেখানে বার বার শুনবেন, আমাদের এই করতে হবে, ওই করতে হবে এবং সর্বোপরি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। এত বলার পরও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলায় না। নাকি ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ বিষয়টি কী সেটাই আমরা জানি না? মাঝে মাঝেই মনে হয়, যা কিছু দেখা যায় না, তার ভেতরে এক খোদা ছাড়া আমরা আর কোনো কিছুর অস্তিত্ব প্রায় ভুলতে বসেছি। 

এদেশের বহু নাটক-সিনেমাতে বার বার সততার জয় দেখানো হয়। এতে একটা গল্পই সবখানের ল.সা.গু- অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাবা-মা সবাইকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রতিশোধ নিতে সক্ষম নায়ক খলনায়ককে পরাজিত করে। এটাই সিনেমার সাধারণ ও বহুলপ্রচলিত ফর্মুলা। সেখানে আরো একটি জিনিস দেখানো হয়। তা হলো ধনীদের জীবন বা বড়লোকের জীবন সব পাপে ভরা। ধনীদের সংসারে সুখ বলে কিছু নেই। সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে চেষ্টা করা হয়- ধনসম্পত্তি, বিত্তবৈভব কখনোই মানুষকে সুখ দেয় না। কিন্তু কি সুখ দেয়, কোন দৃষ্টিভঙ্গিটি মানুষকে সুখ দেয়- সেটিও কোথাও তেমন জোর দিয়ে বলা হয় না।

আমাদের তো মনে হয়, এর মধ্যে একটা নিদারুণ চক্রান্ত আছে। এতে করে কারো কারো মনে এই ধারণা পোক্ত হয়ে যায়, যে ধনী বা বিত্তবান হওয়া কোনো কাজের কথা হতে পারে না। আর সুখের জন্য সাধারণ জীবনযাপনই যথেষ্ট। এখানে প্রসঙ্গত সেই বিখ্যাত কৌতুকটি বলে নেওয়া যায়। এক বিরাট শিল্পপতির হঠাৎ গ্রামের বাড়ি যেতে ইচ্ছা হলো। সেই ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে দুয়েকবার গিয়েছেন আর যাওয়া হয়নি। তো গ্রামে গেলেন। হেঁটে হেঁটে একা একা বেরিয়ে পড়েছেন গ্রাম দেখতে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে এসেছেন। তখন বেলা বেড়েছে। এক জায়গায় এসে দেখলেন একটি লোক গাছের ছায়ায় গামছা পেতে শুয়ে মনের আনন্দে পা দোলাচ্ছে, আর গুণগুণ করে গান গাইছে। শিল্পপতির মনে হল, এইসব অলসলোকের জন্য দেশের কোনো দিকে কোনো উন্নতি হল না। তিনি নিজের জীবনে কাজ ছাড়া আর কোনো কিছু বোঝেন না। ফলে লোকটি কাজকাম ফেলে গাছের ছায়ায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে গান গাইতে দেখে তার বেশ রাগই হলো। তিনি লোকটির কাছে গিয়ে বললেন, তুমি কাজ করো না? লোকটি বললো, হ করি।

ভদ্রপোশাকের লোক তার সঙ্গে কথা বলছে দেখে সে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল। তাহলে এমন গাছের ছায়ায় শুয়ে আছে কেন? লোকটি বলে, তাতে আপনার আসুবিধা কী? শিল্পপতি বললেন, তোমাদের মতো মানুষের জন্যই দেশের উন্নতি হয় না। কাজ না করে কেবলই আরাম আর আরাম। লোকটি বলল, আমাকে তয় কী করতে বলেন? শোন মিয়া, তুমি যদি বেশি বেশি পরিশ্রম করো, তাহলে তোমার জমিজিরাত বাড়বে, কী বাড়বে না? হ বাড়ব। তো সেইমতো তুমি যদি জমিজিরাত বাড়াতে পারো তো তোমার কিছু টাকা হবে। সেই টাকা দিয়ে তুমি গঞ্জে একটা ফ্যাক্টরি দিতে পারবে। লোকটি বলে, আচ্ছা দিলাম,  হেরপর? তারপর তোমার খাটুনির কারণে তুমি এক ফ্যাক্টরি থেকে আরো কয়েকটা ফ্যাক্টরির মালিক হয়ে যাবে। হইলাম, হের পর? তারপর তুমি তোমার ব্যবসা আরো বাড়বে। যেমন দেখা গেল তুমি কোল্ডস্টোরেজের মালিক হয়ে গেলে। তো তখনই তুমি এমন গাছের ছায়ায় শুয়ে পায়ের ওপর পা তুলে গান গাইতে পারবে। এবার লোকটি বলল, এই আরাম করার জন্য যদি এত কিছু করতে হয়, তো সেটা তো কোনো কিছু না করেই আমি করছিলাম। - এই কৌতুকের ভেতরও আত্মপ্রতিষ্ঠার জ্বালাযন্ত্রণাকে আদতে হেয়ই করা হয়েছে। সহজ সরল জীবনের প্রতি প্রগাঢ় পক্ষপাত আছে।

মোট কথা, অর্থকড়ির জীবন যে কোনোভাবেই সুখের জীবন নয় তা নানানভাবে আমাদের মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যেও প্রচলিত, বিশেষ করে যাদের ভেতরে সৎ-অসতের বিবেচনা আছে। কিন্তু কেউ কি ভেবে দেখেন এতে করে যারা পুরোনো ধনী, তারাই তাদের ব্যবসাবাণিজ্যে একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে থাকার পথটা পরিষ্কার করে রাখে। ধরা যাক যে, ওই সিনেমাতে টাকা খাটায় ব্যবসা করার জন্য, সেই তার সিনেমায় দেখায়, যে টাকা পয়সার মালিক হওয়ার চেয়ে বড় যন্ত্রণার আর কিছু নেই।- এটা সত্যিই অদ্ভুত চক্র, এবং এটাই গিলতে থাকে সবাই।

অনেকের মতে, মধ্যযুগে খৃষ্টধর্মের পুরোহিতরা নাকি বলা শুরু করলেন, যে যত বেশি ধনসম্পত্তির মালিক হবে, সে ততই ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে পারবে, কারণ ধনসম্পত্তির মাধ্যমে সে মানুষের কল্যাণ করতে পারবে- যেখানে কিনা বলা হতো, সূচের ফুটো দিয়ে হাতি প্রবেশ করা সম্ভবপর, কিন্তু ধনীর স্বর্গে যাওয়া কখনোই নয়। ইসলামধর্মের মূল্যবান যে সব উপদেশমালা আছে তার একটিতে বলা হয়েছে- মাত্র দুজন ব্যক্তিকে ঈর্ষা করা যেতে পারে। যে বিপুল বিত্তের অধিকারী কিন্তু সে তার সেই বিত্তবৈভবের বড় অংশ জনকল্যাণে ব্যয় করেন, তাকে। এবং সেই জ্ঞানী ব্যক্তি যে তার জ্ঞানকে জনকল্যাণে ব্যয় করেন, তাকে। এই দুই ব্যক্তি ছাড়া জগতের আর কোনো ব্যক্তি বা কোনো কিছুকে কোনোভাবেই ঈর্ষা করা যাবে না। ফলে দুই ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে- মূল লক্ষ্য হল মানুষের কল্যাণ করা। আর সবাই জানেন যেকোনো রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হওয়ার কথা ছিলো মানবকল্যাণ- সেখানে রাজনীতি হয়ে পড়েছে একান্তই ক্ষমতাকেন্দ্রিক। আর এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যেখানে তলে তলে প্রচার করা হচ্ছে, রাজনীতি খুবই খারাপ জিনিস, এর মধ্যে কারো যাওয়ার দরকার নেই।- এটাও ওই ধনীদের জীবনে সুখ নেই, ধনী হওয়ার মানে যন্ত্রণা- এর মতো আরেকটা ব্যাপার। ফলে রাজনীতির নামে অপরাজনীতিই সর্বত্র জেঁকে বসেছে। সৎ,সাহসী ও প্রকৃত কল্যাণকামী মানুষেরা যাতে রাজনীতিতে অনুৎসাহিত হয়- সে জন্যই এই প্রচারণা চলে। এটা হল এক ধরনের গভীর মনস্তাত্ত্বিক চক্রান্ত। ধন অর্জন ও ক্ষমতা অর্জনে নতুন কোনো ভাগীদার এক্ষেত্রে ক্ষমতালোভীরা কখানোই আশা করেন না।

রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি বলে যদি কোনো কিছু থেকে থাকে তো সেটি হলো- ক্ষমতা দখল করো এবং নিজের স্বার্থ উদ্ধার করো। ধনী হও, অভিজাতদের কাতারে নাম লেখাও। অথচ কোনো রাজনীতিবিদ ক্ষমতায় যাওয়ার পর তিনি তো আসলে তার পক্ষ-বিপক্ষ সবারই নেতা হয়ে যান। তিনি তখন আর কোনো বিশেষ দলের লোক থাকেন না। যারা তাদের ভোট দিয়েছে, তাদেরও মন্ত্রী তিনি, যারা তাকে ভোট দেয়নি, তাদেরও মন্ত্রী তিনি। তিনি আপামর জনতার সবার নেতা তখন। কিন্তু দেখা যায়, তিনি কোনোভাবেই এটি করেন না। অথচ যেকোনো উন্নত দেশের দিকে খেয়াল করা গেলে আমরা কি দেখবো- যে তারা তাদের সমস্ত সভায় সমিতিতে কারণে অকারণে বিরোধী দলের পিন্ডি চটকাচ্ছেন? এছাড়া আর কোনো কথাই বলতে পারছেন না? ভাবা যায়, বারাক ওবামা রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজেকে দেশের রাষ্ট্রপতি না ভেবে কেবল ডেমোক্রেটদের রাষ্ট্রপতি ভাবছেন? এবং অবিরাম রিপাবলিকানদের দুর্নাম করে চলেছেন? তবে এও সত্য সেখানে ক্ষমতাসীনরা সব রকম সহযোগিতা পান বিরোধী দলের কাছ থেকে। আর পান গঠনমূলক সমালোচনা। যেটা আমাদের দেশের বিরোধীদল প্রায় কখনো করে না।

তাই ক্ষমতাসীনরা তাদের নিজের দলের মন্ত্রী ছাড়া নিজেদের আর কিছু ভাবতে পারেন না, তেমনি বিরোধীরাও মনে করে, ক্ষমতায় না গেলে আর কোনোভাবেই দেশের কাজ করা যায় না। বিরোধী দলে থেকেও যে দেশের মানুষের কাজ করা যায়- এই মানসিকতার তেমন কোনো নমুনা আমরা পাই না তাদের ভেতরে। ফলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কেবল নিজের দলের কথা ছাড়া, আদতে নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো কিছু ভাবতে পারেন না। 

আমরা আজ পর্যন্ত একটি সাধারণ নির্বাচন পাইনি, যেখানে কোনো দল হেরে গিয়ে পরাজয়কে মেনে নিয়ে এবং নতুন ক্ষমতাসীনদের সব রকমের সহযোগিতা করার কথা শুনতে পেয়েছি। বার বারই শুনেছি- ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করা হয়েছে, সূক্ষ্ম কারচুপি করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর কয়েক মাস যেতে না যেতেই শুরু হয় হরতাল, যে হরতালকে তারা ঘৃণা করতো ক্ষমতায় থাকার সময়, সেই হরতালের তাল ওঠে তাদের। দেশের অগ্রগতি কতভাবে বাঁধাগ্রস্ত করা যায়, তারই নিত্য নতুন ফন্দি খোঁজেন তারা। 

বলা হয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের নেতারাই অপেক্ষাকৃত কম মেধার হয়ে থাকেন। প্লেটো বলেছিলেন, শাসক যদি দার্শনিক হতে পারেন, তাহলেই জনগণের প্রকৃত কল্যাণসাধন সম্ভব। এর চেয়ে সহজ উদারণ দেওয়া যায়। আমাদের তো হরদম গণপরিবহণে বা পাবলিক বাসে বা রেলগাড়িতে চড়তে হয়- সেখানে কত উচ্চশিক্ষিত লোকজনও ওঠেন, অফিসের নির্বাহী কর্মকর্তারাও ওঠেন, কিন্তু বাসের বা গাড়ির যে চালক তারা তো আর এসব ভদ্রযাত্রী কিংবা শিক্ষিত যাত্রীদের সঙ্গে কোনো দিক থেকে তূল্য নন; কিন্তু তার মানে তো এই না যে, তিনি গাড়িটা চালাতে পারবেন না। তার কাজ গাড়ি চালানো- সেটা তিনি ঠিক মতো পারছেন কিনা, সেটা হলেই বাকিদের চলে যায়। ঠিক তেমনি, একজন নেতা কত মেধাবি কি গুণী- সেটা তো বিবেচনার বিষয় হতে পারে না, আসল কথা হলো- তিনি ঠিক মতো নেতৃত্ব দিতে পারছেন কিনা- দেশকে ঠিক পথে চালাতে পারছেন কিনা। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তার চারপাশে থাকেন, সেই রকম অতি-উচ্চশিক্ষিত কিছু উপদেষ্টা। কিন্তু আমাদের সন্দেহ হয়- ওই মানের উপদেষ্টার কাছ থেকে তারা আদৌ কি কোনো উপদেশ গ্রহণ করেন? নাকি উপদেষ্টারা এমন সব উপদেশ দেন, বা দিতে ব্যর্থ হন, যে শেষ অব্দি নিজের বুদ্ধিতেই নেতাকে চলতে হয়। অথবা উপদেষ্টারা নেতার মন জুগিয়ে চলেন মাত্র, জনগণের স্বার্থ বা কল্যাণে অকল্যাণে তাদের কিছু যায় আসে না।

মূলত কী হয়, তা তো রাজনীতি ও ক্ষমতার গন্ডি থেকে অনেক দূরে থাকা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বোঝা সম্ভব হয় না। আমরা কেবল টের পাই আমাদের রাষ্ট্র নামের গণপরিবহনটি ঠিক মতো চলছে না, বা একে ঠিক পথে চলতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ আমাদের নেতারা সেই পুরনো অগণতান্ত্রিক মানসিকতাটি লালন করে চলেছেন। আমাদের কেবল আরো একবার জানা হয় যে, অগণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে কোনো দিনও গণতন্ত্রকে সার্থক করে তোলা যায় না।


লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //