দুঃখে ভরা চা শ্রমিকদের জীবনগাঁথা (তৃতীয় পর্ব)

‘কী মূল্য আছে আমাদের জীবনের’

রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা অদৃশ্য। দু’শো বছর ধরে তাঁরা চরমভাবে বঞ্চিত এবং অবহেলিত। তাঁদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় উন্নত মানের চা বিদেশে রপ্তানি হয়। জিডিপিতে রয়েছে তাঁদের অবদান; কিন্তু কৌশলে তাঁদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। তাঁদের রয়েছে হাজারো সমস্যা। রয়েছে সংকুচিত ও অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং ভূমির সমস্যা। তাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। কঠোর দৈনন্দিন জীবনে নেই আনন্দ-বিনোদন ও নিরাপত্তা। রয়েছে শিক্ষা, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাব। এসব নিয়ে চার পর্বে সাজানো হয়েছে চা শ্রমিকদের এক অজানা জীবনগাঁথা। লিখেছেন- শানু মোস্তাফিজ। 

‘এত পরিশ্রম করেও ঠিকভাবে তিনবেলা খাবার জোটে না। কোম্পানির দেওয়া একটি ঘর পেলেও নিজের চেষ্টায় আরেকটি ঘর তুলেছি। আমার মা-বাবাও বাগানের শ্রমিক ছিলেন। তাঁদেও জীবন কষ্টে কেটেছে। আমার জীবনও তাই। দেখছি, আমার সন্তানদেরও এভাবেই বাঁচতে হবে। জানি না, এভাবে আর কতদিন চলবে?’- মলিন মুখে শীর্ণদেহী শুভঙ্কর পট্টনায়ক কথাগুলো বলে চারপাশ দেখে নেন কেউ তা শুনেছে কি-না। 

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সবার জীবন প্রায় একই। আমরা একই ধরনের খাবার খাই। একই ঘরে গরু-ছাগল ও হাঁসমুরগির সঙ্গে ঘুমাই। আমাদের খাবার পানির কষ্ট। হাসপাতালে ঠিকভাবে চিকিৎসা পাই না। আরও কত কী।’ নির্লিপ্ত কণ্ঠে কথাগুলো বলে শুভঙ্কর যেন খানিকটা স্বস্তি পেলেন। 

এ নিয়ে তাঁরা কারো কাছে অভিযোগ করেন না। সমস্যার কথা বলতে ভয় পান। কোম্পানির কেউ শুনলে যদি কাজ চলে যায় তাহলে কীভাবে বাঁচবেন? কেননা চা বাগান ছাড়া তাঁদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। দেশে আর কোনো জায়গাকে তাঁরা আপন ভাবতে পারেন না। মানুষ তাঁদের ভাষা বোঝে না। কেউ ভালোভাবে কথা বলে না। চা বাগানের কাজ ছাড়া তাঁরা আর কোনো কাজ জানেন না। বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্ক বলতে শুধু প্রভু ও দাসের সম্পর্ক। যারা তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। সেই প্রভুদের তাঁরা সমস্যার কথা বলবেন কীভাবে? 

তাঁদের দৈনন্দিন জীবন খুবই কঠোর, নিরানন্দ এবং রুটিন মাফিক। বিশেষ করে নারীদের কাজ পুরুষদের তুলনায় বেশি এবং একঘেঁয়েমীতে ভরা। নারীরা ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়িঘর পরিষ্কার করে রান্নার কাজ সেরে ৮টার আগে চা পাতা তুলতে যায়। চা পাতা তোলার কাজ করে বলে তাঁদের পাত্তিওয়ালী বলে। সেখানে রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাতা তোলার কাজ খুবই কঠিন। কাজ শেষে বাড়ি ফেরে লাকড়ি জোগাড়, ঘরের অন্যান্য কাজকর্ম সেরে পানি এনে রান্নার কাজ, সবার খাওয়া শেষ হলে- তবেই ছুটি। পুরুষরা বাগানের নির্ধারিত কাজ শেষে বাগানের বাজারে আড্ডা দেয় কিংবা অলস সময় কাটায়। 

এত ছোটাছুটি করে কীভাবে নারীরা তাঁদের কাজে শক্তি পায়? সরলা পাশিকে জিজ্ঞেস করি, সারাদিনে কী ধরনের খাবার খান? সরলা বলেন, ‘রুটি, ভাত, চা আর চালভাজা খাই। সকালে তিনটা রুটি আর দুধ-চিনি ছাড়া এক গ্লাস চা। প্রতিদিন দুপুরের খাবারের জন্য সঙ্গে নেই আরও তিনটা রুটি এবং একটুখানি চা পাতার চাটনি (তেঁতুল, মরিচ, লবণ ও কঁচি চা পাতা বেটে তৈরি)। সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রুটি থাকলে সেটা খাই, নইলে চা দিয়ে চাল ভাজা খাই। রাতের খাবার হিসেবে সাধারণত ভাত খাই। অনেক সময় রুটিও খাই। সঙ্গে থাকে আলু ভাজি বা আলু ভর্তা। সপ্তাহে দুই/এক দিন ডাল বা ঘরের পাশে লাগানো শাক-সবজিও খাই। এ ছাড়া কচুশাক আর সজনে পাতা প্রায় আমাদের খাবারের তালিকায় থাকে।’

মাংস খান না জানতে চাইলে বলেন, ‘মাংস খাই না। তবে মাসে একবার মাছ খাই। বড় মাছ তেমন জোটে না। ছোট মাছই খাই। হয়তো বছরে একবার মুরগি খাই। নিজের গরু নেই। কখনো সুযোগ হলে অন্যের কাছ থেকে এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) দুধ কিনে সবাই ভাগ করে খাই। কী করব? পয়সা জোটে না।’ এ ছাড়া শখ করে খেতে ইচ্ছে করে এমন খাবার খাওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে সরলা ম্লান হেসে বলেন, ‘ওসব আমাদের ভাগ্যে নেই। তবে পূজা পার্বনে পিঠা খাই।’ গর্ভবতী সময়েও সরলা এভাবে খাবার খেয়েছেন বলে জানান। বাড়তি কিছু জোটেনি। পরিবারের অন্যান্য সদস্য এবং শিশুদের জন্যও একই খাবার বরাদ্দ। 

এসব খাবার একজন কর্মক্ষম পূর্ণবয়স্ক নারীর দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ করতে পারে না। তার শরীরে ক্যালসিয়ামসহ ভিটামিনের ঘাটতিও রয়েছে। সেটা পূরণ না হওয়ায় কয়েক বছর আগে সরলার যক্ষ্মা হয়েছিল। তখনো তিনি তেমন ভালো খাবার খাননি। তিনি বলেন, ‘ডাক্তার বাবুর কথায় দুধ-মাছ কিছুদিন খেয়েছি; কিন্তু খেয়ে কী লাভ? এ জন্য ঋণ করতে হয়েছে। ছেলেমেয়েদের না দিয়ে নিজে এ সব খাই কী করে? তাই পরে আর খাইনি।’

বাগানে শ্রমিকরা ঋণ ছাড়া চলতে পারেন না বলে জানান। কারো কোনো জটিল রোগ হলে কোম্পানির হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ নেই। রোগের যন্ত্রণায় অনেক সময় তাঁরা কাজ ছেড়ে দেন এবং চিকিৎসার জন্য তাদের ঋণ করতে হয়। এ ছাড়া মেয়ের বিয়ে বা শ্রাদ্ধ কিংবা গরু কেনা ইত্যাদি কারণে শ্রমিকরা ঋণ করেন। বেসরকারি সংস্থা বা বাঙালিদের কাছ থেকে তাঁরা ঋণ নেন। শ্রমিকরা বলছে, যা বেতন পাই এতে আমাদের সংসারের খরচ কুলায় না। তাই অনেক সময় ঋণ করতে হয়।

কোম্পানি থেকে অবসর নেওয়ার পরে শ্রমিকদের পেনসন বা পরবস্তি দেওয়ার কথা থাকলেও অনেকেই তা পান না। অলপ ভক্তা বলেন, ‘সারা জীবন কষ্ট করে চলেছি। এখনো তিন বেলা ঠিকভাবে খাবার জোটে না। আমি দীর্ঘ চল্লিশ বছর কোম্পানিতে কাজ করেছি, শেষ বয়সে কোম্পানি থেকে আমি কোনো পেনসন পাই না। এটা কি ঠিক?’ শুধু পেনসন নয়, বাগানগুলোতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা ও অন্যান্য সেবা খুবই কম বলে জানান শ্রমিকরা। অনেকেই বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এবং অন্যান্য ভাতা পান না। ষাট বছর বয়সেও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে বাঁশের টুকরি বানান পরেশ পট্টনায়ক।

তিনি বলেন, ‘সরকার প্রতিবন্ধীদের ভাতার ব্যবস্থা করলেও আমি প্রতিবন্ধী হয়েও তা পাই না। কেনো? সেটা আমি জানি না। রোগব্যাধি ছাড়াও এমন অনেক সমস্যা আছে, যা ভাবলে মনে হয় কী মূল্য আছে আমাদের জীবনের? আমরা কী মানুষ? আমরা শুধু জীবন পার করছি। দেশ এগিয়ে যাওয়ার অনেক খবর শুনি। কিন্তু আমরা যেনো এখনো ব্রিটিশদের অধীনে আছি। এ জন্য এ বিষয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।’ পরেশের এ কথা এমনই ইঙ্গিত করে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন যেমন বদলায়, তেমনি এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //