দুঃখে ভরা চা শ্রমিকদের জীবনগাঁথা (চতুর্থ পর্ব)

শিক্ষা, বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের অভাব

রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা অদৃশ্য। দু’শো বছর ধরে তাঁরা চরমভাবে বঞ্চিত এবং অবহেলিত। তাঁদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় উন্নত মানের চা বিদেশে রপ্তানি হয়। জিডিপিতে রয়েছে তাঁদের অবদান; কিন্তু কৌশলে তাঁদেরকে আটকে রাখা হয়েছে। তাঁদের রয়েছে হাজারো সমস্যা। রয়েছে সংকুচিত ও অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান এবং ভূমির সমস্যা। তাঁরা স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। কঠোর দৈনন্দিন জীবনে নেই আনন্দ-বিনোদন ও নিরাপত্তা। রয়েছে শিক্ষা, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাব। এসব নিয়ে চার পর্বে সাজানো হয়েছে চা শ্রমিকদের এক অজানা জীবনগাঁথা। লিখেছেন- শানু মোস্তাফিজ।

‘কাজ আর অভাবের কারণেই আমি পড়ালেখা করার সুযোগ পাইনি। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন এখনকার মতো লেবারলাইনে তেমন কোনো স্কুল ছিল না। তাই আমি ছোটবেলা থেকে নানারকম কাজ করে রোজগার করেছি। এ ছাড়া ওই সময় অভিভাবকরা সন্তানদের পড়ালেখার বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। এখন আমি পরিকল্পনা করে চলছি। লেবার লাইনেও সামান্য কয়েকটা স্কুল আছে। তাই আমার সন্তানদের শিক্ষার জন্য শেষ চেষ্টা করে দেখব’ শেষের কথাটিতে হরিহরের চোখেমুখে দৃঢ় প্রত্যয় ফুটে ওঠে। 

চা বাগানে এ সমস্যা অনেক শ্রমিকের। চা বাগানে কাজ করলেও তাদের ছেলেমেয়েরা টুকটাক কাজ করে। অনেকেই সেভাবে কোনো পেশা বেছে নিতে পারে না। বেশিরভাগ ছেলে আশায় থাকে তাদের বাবা-মা কখন অবসরে যাবেন এবং তারা সেই কাজে যোগ দেবে। বাগানে অন্য কোনো কর্মসংস্থান নেই বলে বেকারত্ব দিন দিন বাড়ছে। বাগানকেন্দ্রিক তাদের এ জীবন উন্নতির পথে অন্তরায় বলে নিজেরাই স্বীকার করেন। পঞ্চম কৈরী বলেন, ‘এটা ঠিক যে আমাদের ছেলেদের এভাবে অনেক সময় নষ্ট হয়; কিন্তু আমরা কী করতে পারি? বাগানের বাইরে কাজ করার রেওয়াজ ইদানীং কিছুটা হলেও, আগে তেমন ছিল না। তাই আমাদের ছেলেরা যুগ যুগ ধরে পূর্ব পুরুষদের মতো চা বাগানের কাজের অপেক্ষায় বসে থাকে। এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত।’ 

আবার অনেক শ্রমিক বলছেন, পড়ালেখা করেই বা কী হবে আমাদের? আমরা শ্রমিকের সন্তান, সে হিসেবেই কাজ পাই। আমাদের মধ্যে যারা পড়ালেখা করে তারা বাগানের অফিসগুলোতে ভালো পদে কাজ পায় না। তারাও শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। বাইরের জগৎটা আমরা তেমন চিনি না। কোথায় যাব কাজ খুঁজতে? তাই শ্রমিক হিসেবেই চা বাগানে জীবন কাটাই। বাগান থেকে চলে গেলে আমরা বাঁচব কীভাবে? 

হৃদয় তিরকি বলেন, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা বিষয়গুলো মেনে নিয়েছিলেন। আমরাও মানছি; কিন্তু আমাদের সন্তানরা যেন এ অন্ধকার জগত থেকে বের হয় এটাই আমাদের চাওয়া। কিন্তু কীভাবে? যে অভাবের জন্য আমরা পড়তে পারিনি, সেই একই অভাব এখনো রয়েছে। পরিবর্তন একটাই- তখন বাগানে স্কুল তেমন ছিল না, এখন খানিকটা বেড়েছে। বাগান আমাদের যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মতো বাঁচতে দেয়নি। বেশি না খানিকটা সুবিধা পেলে বাপ-দাদার এ পেশায় আমরা খুশি মনে জীবন চালিয়ে দিতাম। সেই সুবিধা কোনো দিন পাব কিনা জানি না। পাশে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের কথাগুলো শুনছিল সঞ্জয় রিকমুন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সঞ্জয় প্রশ্ন করেন, ‘এ জন্য কারা ভাববেন আমাদের কথা?’ 

আট ফুট দৈর্ঘ্য এবং ষোল ফুট প্রস্থের একটি ঘর নিয়েই কোম্পানির দেয়া একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে ভাগ করে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান হয়ে থাকে। স্কুলটিতে একজন প্রধান শিক্ষক এবং তিনজন সহকারী শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০০। স্কুলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য যেখানে প্রয়োজনীয় চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ কিংবা ব্ল্যাকবোর্ড নেই, সেখানে স্যানিটেশন কিংবা নলকূপের কথা ভাবাই যায় না। স্কুলের শিক্ষার্থীরা মাটিতে বসেই পড়ালেখা করে। স্কুলঘরের টিনগুলো পুরনো ও মরিচা ধরে ফুটো হয়ে যাওয়ায় একটু বৃষ্টি হলেই ছিদ্র দিয়ে মেঝেতে পানি পড়ে। তাই বর্ষার সময় শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা করানো খুব কঠিন হয়ে যায়।

স্কুলটির শিক্ষক কল্পনা বুনার্জী বলেন, ‘একটি স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যূনতম যে সমস্ত উপকরণ দরকার, সে সব কিছুই নেই এখানে। এ বিষয়ে কোম্পানির কাছে বলেও কিছু পাওয়া যায়নি। উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে বই পাওয়া গেলেও পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়ার জন্য খাতা, কলম ইত্যাদি কেনার সামর্থ্য বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর নেই। তাই অনেকেই পঞ্চম শ্রেণির আগেই ঝরে পড়ে।’ 

কল্পনার সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষকরা বলেন, ‘আমরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সকলেই বাগান থেকে অনেক দূরে বাস করি। স্কুলে আসার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। তাই নিয়মিত ও সঠিক সময়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারি না।’ 

তারা আরো বলেন, ‘স্কুলের সামান্য বেতনে আমাদের ঠিকভাবে সংসার চলে না। তাই শিশুদের শিক্ষার বিষয়ে আমরা বেশি মনোযোগ দিতে পারি না।’ 

আট বছরের সংসার জীবনে ছেলে ও স্বামীর মৃত্যু রিনা পাশীকে অনেক বাস্তববাদী করেছে। তাই তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে পড়ালেখা শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখাতে চাই। যাতে তাকে আর শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে না হয়। কিন্তু এ বিষয়ে আমাকে কে সাহায্য করবে? আমার একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। যদি কেউ এগিয়ে আসতো তাহলে এটা সম্ভব হতো।’

মেয়ের বিষয়ে পূর্ণিমা বাউরি বলেন, ‘বিয়ের আগে মেয়েকে বাগানের কাজ করতে দেব না। তার বিয়ে দেওয়াই এখন আমার প্রধান কাজ।’ 

শুধু অভাবের জন্য অনিমার বিয়ে হচ্ছে না তা নয়, অভাবের কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনিমা পড়ালেখা বাদ দিয়েছে। কেননা নৌকা করে তাকে স্কুলে যেতে হয়। এতে তার যাওয়া-আসার খরচ প্রতিদিন দশ টাকা লাগে। এটা পূর্ণিমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় বলে অনিমাকে স্কুল বাদ দিতে হয়েছে। এখন অনিমা ঘরেই বসে থাকে।

একই কারণে পূর্ণিমার অন্য দুই ছেলেও ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়তে পারেনি। মেজো ছেলে বাগানে মাঝে মধ্যে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে। যদিও অনেক সময় সে বেকার বসে থাকে। বড় ছেলে কীর্তন গায়। পূজার মৌসুমে সাধারণত দুই তিন মাস কাজ থাকে। বাকি সময় সেও তেমন কোনো কাজ করে না। বড় ছেলে বিয়ে করেছে তার তিনটি সন্তান রয়েছে। 

পূর্ণিমা বলেন, ‘আমার স্বামী ও ছেলেদের তেমন রোজগার নেই। তারা অনেক সময় ঘরে বসেই থাকে। আমার একার রোজগারে এত বড় সংসার চালাতে হিমশিম খাই। ছেলেরা যদি বাগানে কাজ পেত, তাহলে অনেক উপকার হতো। কিন্তু কোনোভাবেই এ ব্যবস্থা করতে পারছি না।’

এভাবেই বাগানে শিক্ষা, বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাবে মানুষ কষ্টকর জীবন কাটান। তারা বুঝতে পারছেন না কীভাবে এ সমস্যার মোকাবেলা করবেন এবং এ থেকে বেরিয়ে আসবেন?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //