যদি চুরি হয়ে যায় প্রতিবাদের ভাষা

প্রতিবাদ মানে এর পেছনে যুক্তি থাকতে হবে। অবশ্য কোনো কারণ ছাড়া, ইস্যু ছাড়া প্রতিবাদ করাটা আমাদের দেশের রাজননৈতিক সংস্কৃতিতে বেশ মানিয়ে গেছে। কেবল প্রতিবাদ করার জন্য প্রতিবাদ, সমালোচনা করার জন্য সমালোচনাই এখানে সুলভ। এদেশের সেই চালই চালু রাখা হয় যেখানে মাঠ-গরম করাই একমাত্র উদ্দেশ্য।

কিন্তু সবাই জানেন এদেশে এই অঙ্গনে কেবল একদল আরেক দলের কাজের প্রতিবাদ করেন। দলের ভেতরে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ দলের কোনো ব্যক্তি তেমনভাবে করে না। আর যদি কেউ তেমন শক্ত প্রতিবাদ করতে চান তাহলে তার পরিণতি কী সেটাও জানা। তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো কঠিন সততা ও যুক্তির জায়গা থেকে যে সেই প্রতিবাদ হয়, তাও না। সেখানে থাকে অর্থনৈতিক স্বার্থ বা ব্যবসায়ী স্বার্থ। যদি তা না হয়, তো প্রতিবাদ কানেও তোলা হয় না, প্রতিবাদকারীকেও কিছু বলা হয় না।

অনেকেরই মনে থাকতে পারে দলত্যাগী নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর একটি চমকপ্রদ উক্তির কথা। এরশাদের পতন তখন ইতিহাস। দেশে চালু হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্র। তিনি সেই সময়ের প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘দেশের বয়স তো ত্রিশ পার হয়ে গেল, আর কতদিন হাফপ্যান্ট পরিয়ে রাখবেন।’ এই কথার ভেতরে ব্যঙ্গ যতোটা তারচেয়ে বেদনাটাও কম নয়। হাফপ্যান্ট তো কেবল সভ্যভব্য হওয়ার প্রতীকমাত্র। আর এই সভ্য হয়ে ওঠার মূল দিক হলো সুশাসন। যখন সুশাসন নিশ্চিত করা হয় না, তখন আর কোনো কিছুই আসলে রাজনীতিবিদদের করা হয় না। তাদের কাজের জায়গায় শূন্য ছাড়া আর কিছু দেওয়া সম্ভব হয় না।

রাজনীতিবিদরা অর্থনীতিবিদ নন, সমাজতাত্ত্বিকও নন। তারা কৃষকের মতো শ্রমিকের মতো মাঠেঘাটে কাজ করেন না। শিক্ষিকদের মতো, ডাক্তারের মতো কাজ করতে আসেন না। তাদের দ্বারা আদতে উন্নয়নের সেই কাজটি করা সম্ভব- সেটা হলো  প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নয়ন। 

পাঠকরা জানেন রামায়ণ ও মহাভারত ভারতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনন্য দুটো নির্দশন। তার ভেতরে রামায়ণের আবেদনটা পারিবারিক এবং মহাভারতের আবেদন রাজনৈতিক। মহাভারতের প্রতিপদে উঠে আসে রাজনীতির বিচিত্র কূটকৌশলের কথা। এতে আছে রাজনৈতিক সংকট মুক্তির জন্য প্রজ্ঞাময় উক্তি ও দর্শনের অসংখ্য কথা। কিন্তু এর সঙ্গে এও সত্য যে, সমস্ত উক্তি ব্যর্থ হয়ে গেছে; কারণ এর প্রধান ব্যক্তিটি ছিলেন অন্ধ। অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র আসলে সর্বকালের সর্বদেশের ক্ষমতার মূল ব্যক্তির প্রতীক হয়ে আছেন। 

এখনকার রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের কাজই হলো ক্ষমতায় যাওয়া ব্যক্তিকে অন্ধ করে দেওয়া। তিনি তখন নিজের পরামর্শে আর চলতে পারেন না। তিনি চলেন তাকে ঘিরে থাকা চাটুকার মন্ত্রী ও সভাসদদের কথায়। তিনি দেশ ও মানুষের সঠিক পরিস্থিতি যাচাই করতে পারেন না।

মহাভারতকে বহুবার বহুভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মূলের কাহিনীর বিন্যাস ঠিক রাখলেও বারবার এতে যুক্ত হয়েছে বিচিত্র সব উপকাহিনী। চলেছে সংযোজন-বিয়োজন। যেমন ধৃতরাষ্ট্রে রাজ্যাভিষিকের একটি ভিন্ন পাঠে পাওয়া যায়- যেখানে ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যাভিষেকের সময় মন্ত্রী বিদুর অকাট্য যুক্তিসহ বাধা দেন। অভিষেকের আগের দিন বিদুর ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ধর্ম ও প্রেমের যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হলে তিনি কোনটা বেছে নেবেন। মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্ম বলেন, অবশ্যই ধর্ম। কারণ ধর্ম হলো সূর্যের মতো, প্রেম হলো চন্দ্রের মতো। চন্দ্র সূর্য থেকেই আলো পায়। ফলে চন্দ্র যদি কেউ বেছে নেয় তাহলে সে ধর্মের আলো থেকে বঞ্চিত হয়, আদলে তার প্রেমও ম্লান হয়ে যায়। বলা বাহুল্য ধর্ম মানে সত্য ও সততা। বিদুর তাই বড় ভাই ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি মায়া থাকার পরও তার রাজা হতে বাধা দেয়।

কারণ, একজন অসম্পূর্ণ মানে দৃষ্টিহীন ব্যক্তির কোনোভাবেই রাজা হওয়া উচিত নয়। দেশের অবস্থা ও দেশের মানুষের পরিস্থিতি রাজাকে নিজের চোখে দেখে বিচার করতে হয়। দেশের জন্য উপযোগী মানুষ ও লুকানো শত্রুদের চিনে নিতে হয়। রাজা যদি নিজের চোখে তার আশেপাশের লোকজনের মুখ দেখে তাদের মনের কথা পড়তে পারেন তাহলেই রাষ্ট্রব্যবস্থা কল্যাণময় হয়ে ওঠে। রাজমাতা সত্যবতী বলেন, দেশের এইসব পরিস্থিতির জন্য তো তার সভাসদরা রয়েছেন। তখন বিদুর বলেন, মন্ত্রী ও সভাসদরা তো রাজাকেই অনুসরণ করবেন, রাজা মন্ত্রী ও সভাসদের নয়। যে দেশের রাজা মন্ত্রী ও সভাসদদের অনুসরণ করেন- সে দেশে মন্ত্রী ও সভাসদরা দেশকে এক অনাচারের রাজ্য বানিয়ে তোলে।

স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে কী ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা পাঠককে বলা বাহুল্য। প্লেটো যে বলেছিলেন রাজাকে দার্শনিক হতে হবে- সেটা ওই দৃষ্টিসম্পন্ন হওয়া অর্থেই। আর চোখ থাকলেই তো আর ‘দৃষ্টি’ থাকে না। ফলে কোনো দেশের প্রধানকে যদি তার মন্ত্রী, সভাসদ ও আমলাদের পরামর্শ নিয়ে চলতে হয়, তাহলে তার পরিণতি যা হওয়ার তা-ই হয়। রাজাকে সুরক্ষিত রেখে মন্ত্রী ও তার সভাসদরা দেশকে লুটপাটের একটা আস্তানা করে তোলে। 

কদিন আগে একজন সাবেক উপদেষ্টা বলেছেন, ‘দেশে আইনও আছে, শাসনও আছে; কিন্তু আইনের শাসন নেই।’ কারণও তো একটাই প্রটোকল ইত্যাদি আমলাতান্ত্রিক ফাঁদে রাষ্ট্রের মূল ব্যক্তিকে জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ফলে তিনি একরকম অন্ধের জীবনযাপন করেন। যেভাবে বিভ্রান্ত করে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল প্রয়াত শেখ মুজিবকে। এদেশে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে কেন্দ্রে রেখে গড়ে উঠেছিল অনাচারের এক বিরাট চক্র। ফলে তিনি অনেক অনেক ভালো কাজ করলেও সেটাকে কেউ সামনে আনতে পারেনি। তার আমলকে দুঃশাসনের আমল হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার সামরিক শাসক এরশাদের দুঃশাসন ও অপশাসনও ছিলো ব্যাপক পরিমাণে। তিনি একজন অনির্বাচিত রাষ্ট্রনায়ক তার সরকারও ছিল তা-ই। তার কাছে তাই সুশাসনের আশা ততোটা কেউ করবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু জনগণের নির্বাচিত সরকার যদি স্বৈরাচারী আচরণ করে সেটি কোনোভাবেই সহনীয় হতে পারে না। অথচ আমরা সেটিই পেয়ে আসছি। 

সরকারের কাজ দেশের সুশাসন নিশ্চিত করা। উন্নয়নের জন্য দেশের কৃষক-শ্রমিক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবিরা রয়েছেন। কিন্তু তাদেরকে যদি ন্যায় ও সুশাসন না দেওয়া যায়, তাহলে দেশের যতোটা এগিয়ে যাওয়ার কথা ততোটার এগিয়ে যাওয়া হয় না। একথা সবাই জানেন যে, বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ নয়। এতো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অরাজকতার পরও বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। মজার ব্যাপার এদেশের মানুষ সেই অর্থে রাজনীতিবিদদের পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু মুশকিল হলো রাজনীতিবিদরা জনগণের সঙ্গে সঙ্গে না এলে দেশ তো সেই অগ্রগতিটি পায় না। যা পায়নি এখনো।

উন্নয়নের দাবি প্রতিটি সরকারই করতে পারে। প্রতিটি সরকারের আমলে দেশে কিছু না কিছু উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা কেউ বা কোনো দল এককভাবে ও রাতারাতি করে দেয়নি। তাই উন্নয়নের দোহাই দিলে জনগণ সহজে ভুলবে না। জনগণের চাই সুশাসন ও গণতন্ত্র নিশ্চিতকরণ এবং দুয়ের জন্যই দরকার যেকোনো অব্যবস্থা ও অপসিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সুযোগ দেওয়া। সেটি একে অপরপক্ষকে নয়, নিজেই নিজের আত্মসমালোচনার মধ্যে দিয়ে সেটি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু কেবল সরকারই যে আত্মসমালোচনা নিশ্চিত করবে তা নয়। জনগণের মধ্যে থেকে যে গণদাবী ও গণআন্দোলন তৈরি হয় তার নানান ক্ষেত্রেও আত্মসমালোচনার মারাত্মক অভাব রয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে তারুণ্যের যে উত্থান নিয়ে অনেকেই বিপুল আশার আলো দেখেছিলেন, সেটি শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি পেয়েছে তা এখনো বলার সময় আসেনি। কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় এই তারুণ্যের জোয়ারে আত্মসমালোচনা বলে তেমন কোনো বস্তু ছিলো না। জনগণের স্বপ্নের হাইওয়ে নির্মাণ করার জন্য তারা সাময়িকভাবে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটি দিনের পর দিন বন্ধ করে রেখে আদতে কতটা কল্যাণময় কাজ করেছিলেন- তা প্রতিশ্রুতি, না প্রতারণা ছিল এখন সেই দ্বিধাও কেটে গেছে। আত্মসমালোচনা ও পরিমিতিবোধের অভাবে একটি আন্দোলনকে আমরা মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছি। 

এই তো সেদিন একটি আলোচনায় মুক্তিযুদ্ধের একজন কমান্ডার বলছিলেন, ষোল ডিসেম্বর যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল, মাত্র একমাসের ব্যবধানে সেইসব তরুণের গায়ে লাগানো হয়েছিল ‘হাইজ্যাকারে’র ছাপ। আত্মসমালোচার মাধ্যমেই প্রতিবাদ প্রকৃত ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা তো সবাই জানেন, একটি লোককে সবাই সমালোচনা করলো, কিন্তু সেই সমালোচনা মধ্যে যদি বাস্তব কিছু থেকে থাকে, এবং সে অনুযায়ী যদি তিনি নিজের সমালেচনা নিজে না করেন, তাহলে তার কোনো বদল হয় না। একই কথা রাজনীতির ক্ষেত্রেও। একদল তো অন্যদলের সমালোচনা করবেই। ভিন্ন দলের লোক হয়ে অনেক কঠিন কথা বলা সহজ, কিন্তু দলের ভেতরে থেকে কেউ যদি সঠিক ও যুক্তিসংগত সমালোচনা করেন এবং সেটি যদি গ্রহণযোগ্যতা পায়, তাতে আসলে দলেরই উপকার হয়। দলের উপকারে দেশের উপকার হয়।

ইসলাম ধর্মেও বলা হয়েছে, সবচেয়ে বড় বীর সে-ই- যে জালিম বা অপশাসকের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারণ করে ও প্রতিবাদ করে। আরও বলা হয়েছে, সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হলো নিজের নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। নিজের ভেতরের মন্দ কাজের কোনো তাড়না তৈরি হলে তাকে রোধ করাই সবচেয়ে দরকারি কাজের একটি। তাই প্রতিবাদ ও আত্মসমালোচনা ছাড়া কোনো মানুষ নিজের ও নিজের কাজে কোনো মহত্ব আরোপ করতে পারে না। আর কোনো কিছুর সামনে কেবল নামমাত্র ‘মহান’, ‘মাননীয়’, ‘সম্মানিত’ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়ে সেগুলোকে কখনো মহান করা যায় না। অথচ এই আত্মপ্রতারণা আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হয়ে আছে। আর এর ফলেই এদেশে কোনো দলই সুশাসন নিশ্চিত করতে পারছে না। যতোদিন সুশাসন নিশ্চিত করা না হবে, ততোদিন উন্নয়নের হাজারও তালিকা, গ্রাফ বা চার্ট তৈরি করলেও রাজনীতিবিদদের প্রতি কখনোই জনগণের বিশ্বাস ফিরে আসবে না।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //