ক্ষমতার লিগ্যাসিতেও আরএসএসের পাশে বসা নয়

‘কানেক্টিভিটি’ শব্দটার অর্থই বদলে গেছে। এখন এর অর্থ হয়ে গেছে, বিনা পয়সায় বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারত করিডোর নেবে। ভারতের দুই অংশকে আরামে কানেক্ট করে নিবে। বাংলাদেশের বাজার নষ্ট করবে। তাই এটা ওয়ানওয়ে স্বার্থ আদায়ের শব্দ। ফলে এর সঙ্গে মিলে আবার কোথাও ‘বাংলাদেশ-ভারত ডায়ালগ’ জাতীয় কথা কানে আসলেই মন সতর্ক হয়ে যায়।

বাংলাদেশের স্বার্থের দিক থেকে তাই ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ডায়ালগ বা কানেক্টিভিটি ধরনের শব্দগুলো ছলচাতুরির শব্দ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ঘাড়ে চড়ে চাপ দিয়ে বিনা পয়সায় ভারতের একচেটিয়া বাণিজ্যিক স্বার্থ আদায়ই এর লক্ষ্য।

এমনিতে নেহেরু আমল থেকেই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির মূল বৈশিষ্ট্য হলো কলোনি সম্পর্ক করা। যেন পররাষ্ট্রনীতিতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মানেই তা কলোনি সম্পর্ক। বিপরীতে উভয়ের জন্য লাভজনক স্বার্থের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বলে যেন কিছু নাই। অর্থাৎ কে কত চালাক ও অপরের ওপর প্রতারণায় দক্ষ, পররাষ্ট্রনীতি যেন এরই কারবার। 

কলোনি আমলে অধস্তন সম্পর্ক বলতে যা বুঝাত, তাই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির বুঝ। একই ধারণা অনুসারে, একালেও ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হতে পারে একটাই- সেটা পুরনো স্টাইলের এক কলোনিদখল সম্পর্ক; আর যেখানে ভারত হবে কলোনি মাস্টার। আর যাকে দখল করা সে হবে স্লেভ।

এর সবচেয়ে ভালো ও আদর্শ উদাহরণ হলো নেপালের সঙ্গে ভারতের ১৯৫০ সালে করা চুক্তি। এমনকি একালে ভুটানের সঙ্গে ভারতের পুনঃলিখিত নতুন চুক্তিটিও কমবেশি তাই। যেমন নেপালের সঙ্গে ১৯৫০ সালের চুক্তির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, পাহাড়ি বলে নেপালে হাইড্রোপাওয়ার বা জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা অনেক; কিন্তু নেপাল সেই নিজ-উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভারত বাদে তৃতীয় দেশকে বিক্রি করতে পারবে না। এটা ওই চুক্তির অংশ। বরং ভারতেরই কোনো কোম্পানিকে এজেন্সি দিতে হবে আগে, এরপর সে নেপালের বিদ্যুৎ (ধরা যাক বাংলাদেশকে) বিক্রি করে কমিশন খাবে। নেপালের রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতিতে ২০১৫ সালে রাজতন্ত্র ভেঙে জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে রিপাবলিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের পেছনের প্রধান কারণ ছিল এটাই।

সেকালের নেপালকে এমন কলোনি চুক্তি করাতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে নেহেরুর অবস্থান ছিল আরও কড়া। ব্রিটিশ ভাইসরয় ভারত ত্যাগের আগে কলোনিদখলদার ব্রিটিশদের প্রতিনিধিত্বের ক্ষমতা যেন নেহেরুকেই হস্তান্তর করে গেছিলেন। এই অনুমানের ওপরে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতি দাঁড় করিয়েছিলেন। আর নেপালকে অধীনস্ত বানিয়ে ভারতকে এজেন্সি না দিলে নেপাল কোনো উৎপাদন বা বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যকর করতে পারবে না- এমন বাধ্য করার পেছনে ভারতের সাফাই হল নেপাল ল্যান্ডলকড দেশ; ভারতের ওপর দিয়ে তাকে ঢুকতে বের হতে হয়, তাই নেপালকে এর কাফফারা দিতেই হবে। 

তাহলে একই যুক্তিতে আসামসহ নর্থ-ইস্টকে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে সব ধরনের করিডোর দিতে আমরা বাধ্য হব কেন? যেখানে আবার নর্থ-ইস্ট ঠিক একই অর্থে ল্যান্ডলকড ভূখণ্ড নয়। বাংলাদেশের বাইরে দিয়ে, কলকাতার সঙ্গে নর্থ-ইস্ট নিজ শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে সংযুক্ত। তবু ভারতকে আমাদের নিজ রাজস্বের পয়সায় অবকাঠামো রাস্তা গড়ে সেটা আবার বিনা পয়সায় ভারতকেই দিতে হবে। এই হলো আবদার; আর এরই নাম হচ্ছে ‘কানেক্টিভিটি’ আর সঙ্গে ‘বাংলাদেশ-ভারত ডায়লগ’ জাতীয় প্রতারণামূলক শব্দ।

এমন প্রতারণামূলক ডায়লগ আবার শুরু হয়েছে ভারতের সিমলায়। আর এটার নাকি ফরমাল নাম ‘ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ ডায়ালগ’। নাম যাই থাক মুল উদ্দেশ্য, বিনা পয়সায় করিডোর নেয়াসহ বাংলাদেশের বাজারে অবাধ প্রবেশ ও আরো কী কী নেয়া যায় এরই ফাঁক ফোকর বের করে ডিল করা। 

সবার আগে এবছর বাংলাদেশের দিক থেকে এই কথিত ‘ডায়লগ’ করতে রাজি হওয়া ভারতকে আমাদের বাঁ হাতে ফুল দেবার মতো ঘটনা হিসাবে ঘটেছে। কেন? কারণ, একালে এর শুরু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের টিকা বিপর্যয়ে ফেলে দেয়া থেকে। এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পেতে এবং অবকাঠামো বিনিয়োগের আরো অর্থ পেতে চীনের সঙ্গে গভীর কমিটমেন্টে জড়িয়ে যাওয়া ছাড়া সরকার পথ ছিল না। কাজেই সরকার এখন ভারতের দিকে ন্যূনতম তাকানোর অবস্থাতেই নাই। এরপরেও পূর্ণমন্ত্রীর বদলে একজন প্রতিমন্ত্রীকে পাঠাতে রাজি হয়েছে এ জন্য ভারতেরই শুকরিয়া আদায় করা উচিত। কিন্তু ভারত এতে আবার মোচড় দিয়েছে যে দুই ক্ষমতাসীন সরকারের রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিও এখানে পাঠানো হবে। আর এসব তুচ্ছ বিষয় মনে করে বাংলাদেশ সরকার আপত্তি করার তেমন কিছু দেখে নাই; কিন্তু ভারতের চাতুরিটা হল, এখানে দল বলতে বিজেপির বদলে তারা খোদ আরএসএস-কে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইসলাম বিদ্বেষ আর ঘৃণা যে দলের প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা, যা বেচে ভোট জোগাড়-সেই আরএসএস এভাবে নিজেকে এই সুযোগে জাতে তুলে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের পাসে বসার জায়গা করে নিয়েছে।

এটা খুবই খারাপ ইঙ্গিত তৈরি করে দিয়েছে। প্রথম কথা দল হিসাবে আওয়ামী লীগ অন্তত নিজেকে আরএসএসের সঙ্গে এক কাতারে বসাতেই পারে না। আরএসএস আওয়ামী লীগের তুল্য দল নয়। ভারতের সমাজ থেকে ইসলাম ও মুসলমানদের যে দল অবলীলায় এথনিক ক্লিনজিং করতে চায়, বা অনুমোদন দেয় আওয়ামী লীগ তার কাতারে নিজেকে বসাতে পারে না। এথনিক ক্লিনজিং আর আধুনিক রাষ্ট্র একসঙ্গে চলতে বা কাজ করতে পারে না। তাতে বাংলাদেশের মানুষের চোখে আওয়ামী লীগের যত দোষ-ত্রুটি বা খামতিই থাকুক না কেন!

দ্বিতীয় অপরাধ হলো, সিমলা সভা থেকে হুমকি দেয়া হয়েছে গত অক্টোবরে কুমিল্লায় দুর্গাপূজার ঘটনাকে তারা আলোচনার বিষয়বস্ত বানাবে। মানে যেন বাংলাদেশের হিন্দুদের গার্ডিয়ান হলো ভারত! আবার মজার কথা হলো এ নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্ন মতো আছে। এমজি আকবর এটাকে ‘এও হয় ও-ও’ হয় বলে পাশ কাটাতে চেয়েছেন। আরএসএস এর মুখপাত্র-পত্রিকার সম্পাদক যিনি এইস্যুতে আগে থেকেই ক্ষুব্ধ, তিনিও ছিলেন।

এদিকে বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্তের মতো শ্রীরাধা দত্ত, যিনি বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের থিঙ্কট্যাঙ্কের সিনিয়র ফেলো, তিনি বলেন ‘সংলাপে আরএসএসের থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কিছু ঘটনার পটভূমিতে’। যদিও তাদের সকলের উপর ওজনের দিক থেকে এগিয়ে থাকা ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাম মাধব; যিনি আরএসএস এর কোনো এক কমিটির নেতা ও জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য। এই কিছুদিন আগেও তিনি বিজেপির সেক্রেটারি পদে ছিলেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘এই প্ল্যাটফর্মে দুই দেশের একান্ত নিজস্ব বা অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় না। কাজেই কুমিল্লার ঘটনা সিমলাতে কোনো ছায়াপাত করবে বলে তিনি মনে করেন না।’

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ভারতীয়দের মধ্যেও কোনো ‘সমন্বয়ই’ নাই। আর এই সুযোগে শ্রীরাধা ওভার এক্ট করেছেন। সবাই জানে বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন থিঙ্কট্যাঙ্ক খোদ আসএসএসেরই প্রতিষ্ঠান; আর মোদির বর্তমান সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল এই প্রতিষ্ঠানেরই মূল কর্তা ও নেতা।

তাহলে ভারত যদি সিমলাতে কুমিল্লা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করতে পারে তাহলে আমরা ভারতের হিজাব ইস্যু নিয়ে ওই একই আসরে কথা বলতে পারব না কেন? এসব দিকে বাংলাদেশ সরকারের কড়া দৃষ্টি থাকা উচিত ছিল। আমাদের নিজেকে অপমানিত হতে দেওয়ার তো কিছু নাই।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //