মোদি ‘সেক্যুলারদের ইসলামফোবিক’ করেছে

নয়াদিল্লি মিউনিসিপালিটির একটা পাড়া-মহল্লার নাম জাহাঙ্গীরপুরী। ঘটনা-সংক্ষেপ হলো, যেমন দুনিয়ার সব মেট্রোসিটিতেই হয়, তেমনি দিল্লিতেও প্রায় সাতশর ওপরে অবৈধ বসতি আছে। আর তারা আছে বলেই শহরের এলিটরা স্বল্প মজুরিতে মেট্রোসিটি চালাতে শ্রমিক পাচ্ছে। এসব অবৈধ বসতিরই একটা আবার মুসলমান অধ্যুসিত, যা স্থানীয় বিজেপি সভাপতির সিদ্ধান্তে দিল্লি মিউনিসিপালিটি হঠাৎ করে বিনা নোটিশে বুলডোজার নিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

গত মার্চ ২০২২ সালে ভারতে পাঁচ রাজ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর আগে থেকেই মোদির বিজেপি তটস্থ হয়ে যায় যে, ভারতের অর্থনৈতিক খারাপ অবস্থায় মানুষ যতই ক্ষুব্ধ থাকুক না কেন নির্বাচনে কোনোভাবেই রাজ্য হারানো যাবে না। আর তা থেকেই সরাসরি মুসলমান নিগৃহীত করা বা হত্যার উন্মাদনায় হিন্দুত্ব জাগিয়ে হিন্দু-ভোটে নিজ বাক্স ভর্তি করতেই হবে। এরই সর্বশেষ ঘটনা হলো জাহাঙ্গীরপুরী বসতি ‘বুলডোজ’ করে দেয়া।

সাবেক জাস্টিস এ পি শাহ, যিনি মাদ্রাজ ও দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এক সময়, তিনি দ্য ওয়াইর (ডওজঊ) ওয়েব মিডিয়ায় এক সাক্ষাৎকারে কঠোরভাবে জাহাঙ্গীরপুরী ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ‘এই বুলডোজ তৎপরতা চালিয়ে দিল্লি মিউনিসিপালিটি সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ অমান্য করেছে যা মারাত্মক অপরাধ। আদালতের এখন উচিত হবে এই অমান্যকারীদের জেলে ঢোকানো।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমি দেখছি, ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক পরিষ্কার নিরন্তর আক্রমণ’ শুরু হয়েছে। 

ভারতের রাষ্ট্র-রাজনীতির গোড়ায় বিজেপি-আরএসএসের তৎপরতায় এখন যে এক মস্ত ভাঙন ধরে গেছে সেটা মোদির এই সর্বশেষ উদ্যোগ থেকে অনেকেই আর স্বীকার না করে পারছেন না। তাই জাহাঙ্গীরপুরের ঘটনায় এপি শাহের বক্তব্যের মতো মতামত ভারতের অনেক মিডিয়াতেই তা প্রতিফলিত। তেমনই আরেকটা হলো দ্য প্রিন্টের সম্পাদকম-লীর সভাপতি শেখর গুপ্তার রেগুলার কলাম। তিনি এক অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করেছেন, ‘সেক্যুলার-ইসলামফোবিয়া’। তিনি বলতে চেয়েছেন মোদির এই নিরন্তর মুসলমান কোপানো তৎপরতায় এবার তথাকথিত সেক্যুলারদের মধ্যেই এক নয়া ইসলামফোবিয়া দেখা যাচ্ছে। কী সেটা?

জনগণের কোনো অংশ নিগৃহীত হলে দেশের বিরোধী মত এর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়- এটা সবদেশেই একটা কমন ফেনোমেনা। কিন্তু শেখর গুপ্তা বলছেন ভারতের কথিত সেকু্যুলাররা এখন মুসলমান নিগৃহীত হলে এ নিয়ে কথা বলা বন্ধ বা স্বর নামিয়ে ফেলা- শুরু করেছে। আর এটাকেই তিনি কথিত সেক্যুলারদের ইসলামফোবিয়া বলছেন; কিন্তু কেন এমন হচ্ছে?

এর মূল কারণ হলো, ভারতের রাজনীতি মূলত একেবারেই নির্বাচনকেন্দ্রিক। এদিকে যেন, মুসলমানেরাই হিন্দু ভোটারদের সব দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী। তাই ভারতে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম হচ্ছে না মুসলমানদের জন্য ইত্যাদি বিজেপি-আরএসএস তাদের বয়ানে হাজির করে চলছে। আর এতে মুসলমানরা যেন ভারতের কেউ নয়, নাগরিক নয়, অস্তিত্বহীন- এটা ধরে নেওয়ার একটা পরিবেশ মোদি-শাহ তৈরি করে ফেলেছে। আর এর সামনে মোদির বাইরে অন্য কোনো রাজনীতি অকেজো শুধু নয়, তাদের নিজ অস্তিত্ব টিকানোই সংকটে পড়েছে।

এ কারণে, মুসলমানরা যতই নিগৃহীত হোক মোদিবিরোধী দল বা ব্যক্তির পক্ষে এ নিয়ে কিছু বলা যে পপুলার হিন্দুত্বের-উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে এর বিরুদ্ধে যাওয়া হবে। অতএব, তারা আত্মরক্ষার পথ ধরেছে। এটাকেই শেখর গুপ্তা বলছেন ‘সেক্যুলার ইসলাম-ফোবিয়া’। মুসলমানদের থেকে নিজের দূরত্ব রচনা করে চলা। 

হিন্দুত্ববাদের আরেক টার্গেট বিচারক

হিন্দুত্ববাদের আরেক টার্গেট এখন রাজ্যগুলোর হাইকোর্ট আর সাথে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরাও। উচ্চ-আদালতগুলো এখন আর লাল-সালু টানিয়ে পরচুলা পরা ভাব ধরে এজলাস বসিয়ে নিজেদের চিন্তার আধিপত্য বা সুপ্রিমেসি খাড়া করতে পারছে না। যেন তারাই ভারত রাষ্ট্রকে বোঝার ও ব্যাখ্যার একমাত্র এজেন্ট ও অথরিটি বলতে যে ভাবটা এতদিন ছিল তাতে টান পড়েছে। ফলে কনস্টিটিউশন ব্যাখ্যার পাহারাদাররা হিন্দুত্ববাদের আক্রমণে এখন দিশেহারা। যেমন, হিন্দুত্ববাদ একটা জীবনধারা (ওয়ে অব লাইফ) কিনা এটা এখন আদালতের বিচার্য বিষয় এবং ওই বিচারক রায় দিয়েছেন হিন্দুত্ববাদকে একটা জীবনধারা বলে জায়গা দিতে হবে।

এর মানে হলো, একটা মডার্ন রিপাবলিক রাষ্ট্রের আদালতে-কী বিচারের বিষয় হতে পারে আর কী না, তা নিয়ে ফান্ডামেন্টাল বোঝাবুঝির সংকট ও দুর্বলতা এখন আবির্ভূত। 

সম্প্রতি আরেক আদালতের বিচার্য বিষয়, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে তর্ক। দিল্লির জওহর লাল নেহেরু ইউনির্ভাসিটি বা জেএনইউ বহুদিন থেকেই বিজেপির চোখে কংগ্রেস-প্রগতিবাদীদের আখড়া। আর বিপরীতে কথিত সেক্যুলারদের চোখে এটা যেন তাদের মক্কা! এমনকি ভারতের সব অগ্রসর ধারণার আবাস যেন সেখানে! এখানকার এক মুসলমান গবেষক ছাত্র দীর্ঘদিন ধরে মোদি-শাহের টার্গেট। তিনি গান্ধীর সাথে তুলনা করে সেকালের সাভারকার বা সমতুল্য হিন্দু মহাসভার নেতাদের সমালোচনা করেছেন। আর এটাই নাকি এখন আদালতের বিচার্য বিষয়! আর তাতে ওই ছাত্রের জামিন বাতিল হবার দশা! অর্থাৎ ভারতের হাইকোর্টের ধারণা ভারতের সমাজের যে কোনো তর্ক তাদের সামনে কেউ তুলে ধরলে তারা সব কিছুর মধ্যেই তাদের বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন!

‘লিগ্যাল তর্ক’ বলে একটা ধারণা আছে। তবে সবকিছুই লিগ্যাল তর্ক নয়। স্পষ্ট করে বললে, কোনো তর্কের মধ্যে কিছু আইনি দিক যদি থাকে, তবে কেবল সেটা আদালতে আইনি দিকের মীমাংসায় তর্ক হতে পারে।

এর ওপরে আদালত এমন যে কোনো তর্ক তাদের সামনে আনলে তাকে প্রথমত খেয়াল করতে হয়- যেসব তর্ক সামাজিকভাবে মীমাংসিত হতে হবে আদালত তা আমল না করে সমাজে অবশ্যই ফেরত পাঠিয়ে দেবে। কথা একটা সমাজে বিভিন্ন ইস্যুতে অনেক মতামত পাশাপাশি থাকবেই। যেমন কোনো রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্য তিন চারটি হবে এটাই স্বাভাবিক; কিন্তু সেগুলো একটা ভাষ্যে আনা আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। বরং এখানে আদালতের কাজ একটাই, ভাষ্য বয়ানগুলো পাশাপাশি থাকতে পারছে কিনা, সেটা দেখা। আরো স্পষ্ট করে বললে, ‘নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ’ হয়েছে কিনা- এটাই মূলত আদালতে বিচার্য হতে পারে- লিগাল তর্ক বলতে এতটুকু অংশকেই বুঝতে হবে। বাকি সবকিছুর তর্ক আদালত সামাজিকভাবে ফয়সালা করার জন্য সমাজে-একাডেমিক আসরসহ নানা কোণে- ঠেলে ফেরত পাঠিয়ে দিবেন। অথচ এসব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণার অভাব মনে হচ্ছে। আর এই সুযোগে এখন বিজেপি-আরএসএস চাইছে আর কিছু বিচারকদেরও বিচার্য বিষয় করতে উসখুস করে ওঠা- এসব এখন ভারতের নতুন ফেনোমেনা হয়ে উঠে আসছে।

অবস্থা কেন এমন হলো

ভারতে এমন অবস্থা হবার পেছনে আছে, ভারতের রাষ্ট্রগঠনের বা ফান্ডামেন্টাল ধারণায় ত্রুটি। ভারত হিন্দু- জাতির এক ‘জাতিরাষ্ট্র’ হবে নাকি নাগরিক অধিকারভিত্তিক সবার জন্য রাজনৈতিক সাম্যের রাষ্ট্র হবে, এ নিয়ে চিন্তায় অপরিষ্কার থাকা- এই সমস্যা ভারতে কখনো সমাধান করা হয়নি। বরং হিন্দু-জাতির এক ‘জাতিরাষ্ট্র’ হতেই হবে এ নিয়ে কংগ্রেস-বিজেপি কিংবা প্রগতিবাদের মধ্যে কিন্তু কোনো তর্ক-বিবাদ নেই। বিবাদ এতটুকুই যে এই হিন্দু জাতিরাষ্ট্রকে তারা সেক্যুলার নামে উদ্ভট জামা গায়ে চড়িয়ে ‘হিন্দু-জাতি’ পরিচয়টা লুকাবে নাকি আরো প্রকাশ্যে হিন্দুত্বের কথা বলে এর সাহায্যে মুসলমানদের অস্তিত্বহীন করবে। প্রায় ৭৫ বছর পার হয়ে গেলেও এনিয়ে কেউই তাদের আজীবন ধরে বুঝতেই রাজি না যে তাদের কথিত সেক্যুলার ধারণাটাই ভুয়া। ইতিবাচকভাবে বললে, সেক্যুলারের একটাই অর্থ হতে পারে ‘রাজনৈতিক সাম্য’। মানে ধর্ম নির্বিশেষে সকলেই সমান নাগরিক আর নাগরিক অধিকারে তারা বৈষম্যহীনভাবে সকলেই অধিকারে সমান- এই নীতি। 

কিন্তু আসলে কংগ্রেস-বিজেপি কিংবা প্রগতিবাদিরা জেনে না জেনে মনে মনে সমাজে এক হিন্দু-আধিপত্য দেখতে চেয়ে গেছে। এমন চিন্তাগত অবস্থার (১৮১৫ সাল থেকে) আদি উৎগাতার নাম রাজা রামমোহন রায়। পরবর্তীতে বঙ্কিম চন্দ্র চট্টপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ থেকে শুরু করে উনিশ শতকের সাভারকার, গান্ধী হয়ে একালের মোহন ভাগবত ইত্যাদি অগুনতি!

আবার লক্ষ্যণীয় একালে রাহুল গান্ধী এবার পরিষ্কার করেই বলছেন তারা তো হিন্দু জাতিবাদী ‘হিন্দুইজম’ অনুশীলন করেন। আর এটা ‘হিন্দুত্ববাদ’ নন। প্রথমটা নাকি শান্তির হিন্দুইজম আর পরেরটা মানে হিন্দুত্ববাদ হচ্ছে- বলপ্রয়োগ ও আধিপত্যের হিন্দুইজম।


লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //