সীতাকুণ্ডে আগুন : দায় কার

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে শত শত কোটি টাকার সম্পদ আর জীবন। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিজেরাই তাদের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন।

বর্তমান সময়ে এমন নজির পাওয়া সত্যিই কঠিন। ৯ জন অগ্নিনির্বাপক কর্মীর জীবনের বিনিময়ে নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন। ভাবতেই খুব অবাক লাগে এখনো এদেশে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আছে যারা নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ মেনে জাতীয় স্বার্থে কর্তব্য-কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দেশবাসী এসব কর্মীকে স্যালুট জানায়। আশা করা যায় এসব কর্মী আগামীদিনের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে যথাযথ সম্মান জানাবে এবং তাদের আগামী দিনগুলো শঙ্কামুক্ত রাখার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। 

বিএম ডিপো একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দেশের সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মুনাফাকে একমাত্র নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবস্থাপনায় বেশকিছু ত্রুটি জেনে-বুঝেই পাশ কাটিয়ে রেখে দেওয়া হয়ে থাকে। তবে ব্যবস্থাপনার এসব ত্রুটি যখন জীবন সংশয়ী হয়ে ওঠে তখন তা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে যায়। এসব অব্যবস্থার দায় যত না প্রতিষ্ঠানের তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি তাদের, যারা এসব বিষয় দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত। সরকার বিএম ডিপোর ৮ জনের নামে মামলা করেছে। সাধারণ মানুষ মনে করে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ মামলায় সম্পৃক্ত করা জরুরি। দায়িত্ব অবহেলার শাস্তি প্রদানের সংস্কৃতি চালু করা না হলে এমন ঘটনা প্রতিবার হবে, বারবার হবে। ৪৪ জন মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার দায় এককভাবে ডিপো কর্মচারীর উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। 

সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্বে অবহেলার চিত্র সর্বত্র। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতকেও এ গোষ্ঠী বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি। সরকারি নীতিমালা না মেনেও দেশে একের পর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক, মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা চালু করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আর যেকোনো প্রকার দুর্ঘটনার পরে সাধারণ মানুষকে প্রতারণার দায় এককভাবে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের উপর চাপিয়ে দিয়ে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্তরা দায় এড়িয়ে গেছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অনৈতিকভাবে অনুমোদন প্রদানকারী এ গোষ্ঠীই আবার কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিশন করেন, অভিযান পরিচালনা করেন, প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নোটিশ জারি করেন, জরিমানা করেন। কিন্তু চলমান প্রতিটি অব্যবস্থাপনার পেছনের কারণ হিসেবে নিজেদের ব্যর্থতার কথা একবারও মনে করেন না। এধারা কোনোভাবেই চলমান রাখা যেতে পারে না। দেশ ও জাতির স্বার্থে এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। 

সরকারি কর্মচারীরা নিজেদের রাজার প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। রাজার সেবা করাই যেন তাদের একমাত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখানে জনগণের কোনো জায়গা নেই। জনগণের অবস্থা ‘যা কিছু হারায় কেষ্টা বেটাই চোর’। সেবার কাজটা খুব ভালোভাবে সম্পন্ন কারণে সরকার তার কর্মচারীদের জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা থেকে দূরে সরিয়ে রেখে পুরস্কৃত করে। আর সরকারের পরীক্ষিত সৈনিকেরা ঠিকই জানেন কাকে রাখবে আর কাকে মারতে হবে। তাই তো বিএম ডিপোর অগ্নিকাণ্ড, ৪৪ জনের জীবন, কোটি কোটি টাকার সম্পদ পুড়ে যাওয়ার সব দায় এখন প্রতিষ্ঠানের। সেখানে তথ্য গোপন করে বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্য রাখার দায়ও প্রতিষ্ঠান মালিকের। কিন্তু তিনি তো সরকারি দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী, তিনি বাঁচলে তবেই না দল বাঁচবে। ফলে প্রতিষ্ঠানের মালিকের পক্ষেও দায় এড়ানো একটা সময়ে সহজ হবে। 

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার চাইতে রাজার প্রতিনিধিদের একমাত্র দায়িত্ব পড়ে রাজাকে তুষ্ট করা। বিএম ডিপোসহ অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই অবস্থা প্রায় একই। সাভারে ভবন ধসে যেতে দেখেছি, গার্মেন্টসে আগুন লেগে মানুষ পুড়তে দেখেছি, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন পুড়তে দেখেছি। এসব ঘটনায় সাধারণ শ্রমিকেরা শুধু জীবন দিয়েছে মাত্র। অনুদান ঘোষণা হয়েছে, অনুষ্ঠান করে চেক দেওয়া হয়েছে তারপর সব ঠান্ডা। নতুন একটা ঘটনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সকলে। তদন্ত প্রতিবেদনে কী থাকে তাও জনগণ কোনোদিন জানতে পারে না। প্রতিকারের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তাও জনগণ জানে না। 

বিএম ডিপোর আগুন দেশের মানুষকে দেখাতে গিয়ে নয়নেরা জীবন দিয়ে দিয়েছে। নয়নদের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোমলমতি একটা জীবন অকালে ঝরে গিয়েছে। কিন্তু নয়নদের এ কাজে মানবতার জয় হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ দুর্ঘটনাকবলিত বিপন্নদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ছুটে গেছে। নয়ন যেন মৃত্যু দিয়ে জানিয়ে গেছে ‘মানুষ বড় দুঃখে আছে, মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি তার পাশে দাঁড়াও’। নয়নের এই আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক জতুগৃহে আবারো দেখা গেছে বিপদের সময়ে মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়ানোর মানবতা। সাধারণ মানুষ যার যার মতো করেই সামান্য সম্বল নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তরুণ সমাজ দলে দলে ওষুধের, রক্তের প্রয়োজন মেটাতে প্লাকার্ড হাতে ঘুরে বেরিয়েছে।

অতীতেও দেশবাসী অনেকবার এমন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে মানবতা জাগ্রত হওয়ার এ চিত্র সব সময় দেখা যায় না। সে কারণে অনেকেই তরুণ প্রজন্মের মানবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন। কিন্তু সত্যি বলতে রাজনীতির কারণে তরুণ সমাজ কিছুটা বিভ্রান্ত হলেও প্রয়োজনের সময়ে তারা যে মানবিক তার প্রমাণ অসংখ্য। জাতি হয়তো ভুলে যাবে, সমাজ হয়তো ভুলে যাবে, পরিবার হয়তো আফসোস করবে কিন্তু তারপরও নয়নরা জাতীয় বীর হিসেবে বেঁচে থাকবে। ভুলে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অতীত ইতিহাস খুব একটা সন্তোষজনক নয়। আমরা হয়তো ট্র্যাজেডির কথা স্মরণে রেখেছি কিন্তু মুক্তির নায়কদের কথা ভুলে গিয়েছি। বিএম ডিপোর আগুনেও ব্যতিক্রম কিছু হবে এমনটা বিশ্বাস হয় না। 

বিএম ডিপোর মৃত্যুর মিছিল আরো লম্বা হতে পারে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকে শঙ্কামুক্ত নয়। রানা, তাজরীন কিংবা বিএমের ঘটনা একটি সত্যকেই প্রমাণ করে; বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের জীবনের মূল্য সবচেয়ে কম। সে কারণে এদের জীবন রক্ষার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। যদিও দেশে আইনের কোনো অভাব নেই। নতুন নতুন আইনের পাশাপাশি ব্রিটিশ আমলের অনেক আইন এখনো বলবৎ আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। এসব মৃত্যু যেন দুর্ভাগ্যজনক, কষ্টদায়ক কিন্তু বিচার্য নয়। দুর্ঘটনা ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্তরা দোষীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য অঙ্গীকারের ফুলঝুরি ছড়িয়ে দায়মুক্ত হয়ে যান। আইন প্রয়োগ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। জনগণ বেশি সোচ্চার হলে সরকার হয়তো ২/১ জনকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয় কিন্তু তারা কখন জামিনে মুক্ত হয়ে আবার নতুন করে কুকর্মে নিবেদিত হয়ে যায় সাধারণ জনগণ তা থাকে অজ্ঞাত। যেহেতু দেশের সাধারণ মানুষ খুব সহজেই অতীত ভুলে যায় ফলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্ষমতাবানরা এই চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের শতভাগ সুবিধা ভোগ করেন। 

রানা প্লাজা থেকে তাজরীন গার্মেন্টস হয়ে নিমতলা সেখান থেকে বিএম ডিপো। দীর্ঘ এ দুঃসহ পথ পরিক্রমায় শ্রমজীবী মানুষগুলোর ন্যূনতম জীবন রক্ষার ব্যবস্থা হয়নি কখনো। কিন্তু এভাবে তো দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলতে পারে না। শুধু দায়িত্ব অবহেলা করে এবং অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এভাবে মানুষকে মারা চলতে পারে না। হয় সরকারি যত নীতিমালা আছে তা বাতিল করা হোক, না হলে তা কঠোরভাবে প্রয়োগের ব্যবস্থা করা হোক।

দেশের সাধারণ মানুষ আশা করে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্তরা শ্রমজীবী মানুষদের জীবন রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কোনো দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য আস্ফালনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন না। বিএম ডিপোর আগুন থেকে দায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।


লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //