স্বপ্নের পদ্মা সেতু: সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার আত্মবিশ্বাস

স্বপ্নের, গৌরবের, অহংকার আর আত্মমর্যাদার প্রতীক, অপমানের প্রতিশোধ, উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি, সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত সৃষ্টিকারী প্রভৃতি কত বিশেষণেই না পদ্মা সেতু বিশেষায়িত হচ্ছে। এটা কার না জানা যে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জনগণের কাছে বিশেষ কিছুই।

বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে এর গরিমা বাইরেও পরিদৃপ্ত। পাকিস্তানি পত্রিকা লিখেছে, ‘দেশের উন্নয়নের মূর্তিমান প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ ‘বিশ্বের গভীরতম ভিত্তি সেতু’ নির্মাণ করে ‘আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতা’র পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলায়ও পদ্মা সেতুর জয়জয়কার। 

দেশবাসী নিশ্চয়ই এখন বিশ্বব্যাংক এবং বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞ যারা এই সেতুর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিল বা ষড়যন্ত্র করেছিল, তাদের মন্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করবে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ গোনা শেষ হতে যাচ্ছে। এই সেতু নিয়ে এতটা উচ্ছ্বাসের কারণ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে কিংবা প্রকৃতিকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনার গল্প। 

পদ্মা নদীর অপর নাম কীর্তিনাশা। মিথের মতো একটা গল্প হয়তো অনেকেই শুনেছেন যে, প্রয়াত মায়ের স্মৃতিতে রাজা পদ্মাপারে এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছেন। নির্মাণ শেষে তা দেখে মনে মনে বললেন, মা তোমার ঋণ আমি আজ শোধ করলাম। যুগ যুগ থাকবে তোমার স্মৃতি। যে-ই না তা বললেন, উন্মত্ত পদ্মা পাড় ভাঙতে লাগল। গ্রাস করে নিল স্মৃতিসৌধ। তাই বাঙালি মনে করত মায়ের ঋণ যেমন মানুষ শোধ করতে পারে না, পদ্মা নদীকেও কেউ শাসন করতে পারে না। এই না পারাকে পারার মধ্যে নিয়ে আসার ভেতর দিয়েই এগিয়ে চলছে মানুষের সংগ্রাম। উল্লেখিত মিথের এই অংশকে গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর’ বাঙালিকে এ কথা আবারও বলে দিয়ে গেল পদ্মা সেতু।

পদ্মা সেতু নির্মাণে ছিল দুটো বাধা। মনুষ্য সৃষ্ট ও প্রকৃতি সৃষ্ট। সেতু হোক, এই আকাঙ্ক্ষা দেশবাসীর মনে সুদীর্ঘকাল ধরে স্বপ্ন হিসেবে থাকলেও আমাদের মতো দেশের জন্য অর্থের সংস্থান করা ছিল কঠিন বিষয়। সব ধরনের সম্ভাব্যতা যাচাই করার পর যখন বিশ্বব্যাংক আমাদের ঋণ মঞ্জুরি করে, তখন দেশবাসী মনে করে সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে। কিন্তু শুরু হয় রাজনীতি এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু ঠিকই বলেছিলেন, বিজয় আমরা ছিনিয়ে আনতে পারি কিন্তু ধরে রাখতে পারি না। পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়েও শুরু হয়ে যায় ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। এক পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রদান বন্ধ করে দেয়। ২০১৭ সালে কানাডার আদালত যদি দুর্নীতির মামলা খারিজ করে না দিত, তবে এখনো ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’ প্রবাদের মতো দুর্নীতি নিয়ে জিগির চলতেই থাকত। বিশ্বব্যাংক কেটে পড়ায় এমন প্রচার জোরেশোরে তোলা হয় যে, ‘দুর্নীতিবাজ’ হাসিনা সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না। প্রচার এতটাই জোরদার ছিল যে, দেশবাসীও এমনটাই মনে করতে থাকে যে, পদ্মা সেতু আর হবে না।

কিন্তু বাঙালিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে নাÑ পিতার এই কথা বাস্তবে রূপ দিতে এগিয়ে আসেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারী ও নিন্দুকদের দিকে ছাই ছুড়ে দিয়ে আর দেশবাসীকে বিস্মিত করে দিয়ে তিনি বলেন, সেতু হবে নিজস্ব অর্থায়নে। এই কথা নিয়ে চলল বিশেষজ্ঞসহ ওই চিরচেনা মহলের টিটকারি, মশকারা। নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সময়ে নিঃসন্দেহে বিশেষভাবে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতিজ্ঞায় অটল প্রধানমন্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ যখন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে তখন তিনি নেই। উদ্বোধন উৎসব সামনে রেখে এই কলামের ভেতর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অটলতার পাশে আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ যারা তখন দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাব।

মনুষ্য সৃষ্ট বাধা দুর করা ছাড়াও প্রকৃতি সৃষ্ট বাধাকে দূর করতে হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ, নদী শাসন, মূল সেতু নির্মাণ, রেল সেতু সংযোগ প্রভৃতি সবকিছুই ছিল জটিল ও কঠিন চ্যালেঞ্জ। মাটির তল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না খবরটি যখন প্রকাশ পায় তখন মনে হচ্ছিল, কাজ কি বন্ধ হয়ে যাবে? কিন্তু না! কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটি তৈরি করা হলো। বিশ্বের যে কোনো সেতুর জন্য তা ছিল কঠিনতম গভীরতম পাইল। যত ধরনের দুর্যোগ হয় সব মাথায় রেখে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা এমনই যে, তিনি কেবল নিজস্ব অর্থায়নে আয়োজনেই অটলতা দেখাননি, নিজস্ব টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক জামিলুর রেজাসহ ১১ সদস্যের প্যানেলকে এ কাজে যুক্ত করেছিলেন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন জামিলুর রেজা চৌধুরীরও আজ আমাদের মাঝে নেই। তিনিসহ সেতু নির্মাণের কাজে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ার ও কর্মীসহ যারাই কাজ করে জাতির স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের সকলের প্রতিও জাতি কৃতজ্ঞতা ও অভিনন্দন জানাই।

প্রবাদ বলে, যারে দেখতে নারী তার চলন বাঁকা। আর দুর্জনের কখনো ছলের অভাব হয় না। তাই পদ্মা সেতু নির্মাণের পুরোটা সময় কেটেছে সরকারের প্রতি সমালোচকদের নানা তির্যক বাক্যবাণ ছোড়ার প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। সময় বেশি যাচ্ছে এবং লুটপাটের জন্য খরচ বাড়ানো হচ্ছে শুরু হয় ইত্যাদি বলা। নিন্দুক আর ষড়যন্ত্রকারীদের এই অপবাদ শক্ত অবস্থান নিয়ে শক্ত ভাষায় মোকাবেলা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেষ পর্যন্ত সমালোচনার আগুনে পানি ঢেলে দেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী।

তিনি বলেন, প্রাক্কলিত ব্যয় বেশি হয়েছে সঙ্গত কারণে। বিশ্ব ব্যাংক-জাইকা-এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক যখন যুক্ত ছিল, তখন কথা ছিল কাস্টম শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধ করবে তারা। তাই ব্যয় কম দেখানো হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নের পর তা সরকারের কাছ থেকে নেবে ঠিকাদার। রেল যুক্ত হয়েছে। অধিগ্রহণে বেশি টাকা লেগেছে। বাড়ি করার অভিজ্ঞতা যাদের আছে তারাই জানেন, যা ব্যয় ধরে দেন ইঞ্জিনিয়াররা খাতায় পত্রে, তার চাইতে খরচ ও সময় বেশিই লাগে। নিন্দুক ও ষড়যন্ত্রকারীদের সমালোচনার করার আগে সুই আর ঝাঁঝরির প্রবাদটা মনে রাখা দরকার।

এক পর্যায়ে সমালোচনা শুরু হলো এই বলে যে, পদ্মা সেতুর ডিজাইনে ভুল আছে। সেতু ভেঙে পড়বে। ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্রদলের সভায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া বললেন, ‘পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না। অনেক রিস্ক আছে।’ ১২ জানুয়ারি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বললেন, ‘নেত্রী ভুল বলেননি। সেতু টিকবে না। একটা ভ্রান্ত ও ভুল ডিজাইন। পিলার ধসে পড়বে।’ পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হওয়ার তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার শুরু হলো, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হয়েছে, এটা ভুয়া। চীন থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এই প্রচারও যে ভুল, তা ইতোমধ্যে সরকারি ভাষ্যে সুস্পষ্ট।

তবে একটা কথা বিবেচনাযোগ্য। সেতু হওয়ায় দুই পারের খেটে খাওয়া মানুষেরা কষ্টে পড়তে পারে। এটা হতে পারে। তবে পদ্মা সেতু দেখতে গিয়ে পদ্মা পারে ঘুরাঘুরি করেছি। দেখলাম, নতুন নতুন হোটেল, রিসোর্ট কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। জমি কেনা-বেচা বাড়ছে। কতটুকু কী কষ্ট হয়, তা সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেখার বিষয়। পদ্মা সেতুকে বিচ্ছিন্ন উন্নয়ন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটা ভাত-কাপড়-বাসস্থান প্রভৃতি অর্থাৎ মৌলিক অধিকার রক্ষার সঙ্গে যুক্ত। তাই উন্নয়নের জন্য যাতে মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা না বাড়ে, তার প্রতি সরকার নজর রাখবে বলেই বিশ্বাস।

বন্যার সময় সেতু নিয়ে আনন্দ উৎসব করা হচ্ছে বলে উষ্মা প্রকাশ করা হচ্ছে। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়ার দিনে কেক কাটার উৎসবের কথা মনে হয় তারা ভুলে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছিল, তাই বলে কি মানুষ ষোলোই ডিসেম্বরের পর বিজয় দিবস পালন করেনি? বাঙালি সংগ্রাম আর রক্ত দিয়ে শিখেছে, শোককে পরিণত করতে হয় শক্তিতে। ষাটের দশকে আমরা বন্যার ত্রাণও করেছি, সরকারবিরোধী মিছিল-মিটিংও করেছি। ঐতিহ্য ধারণ করে সিলেটে ত্রাণ কাজও চলবে, পদ্মা সেতুর সমাবেশও হবে। 

বাস্তবেই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ভেতর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিজের কথা প্রমাণ করলেন। কথাটি হলো; আমরাও পারি আমরাও পারব। বাঙালি আসলেই অনেক পারে। কিন্তু আত্মবিশ্বাসটাই অর্জন ও সাফল্যের প্রধান চাবিকাঠি। সেই কাঠিটিই পদ্মা সেতুর ভেতর দিয়ে আবারও জাগ্রত করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দুর্নীতিমুক্ত, আইনের শাসনযুক্ত, গণতান্ত্রিক, মানবিক জনকল্যাণমূলক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে আত্মবিশ্বাসের এই চাবিকাঠিটিই একান্ত প্রয়োজন। সমৃদ্ধির পথে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে নব নব সাফল্য ও অর্জনের জন্য পদ্মা সেতু সেই আত্মবিশ্বাসটাকেই সর্বোচ্চ পর্যায়ে জাগ্রত করে দিয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //