লেখালেখির সুবাদে- দেশ ও মানুষকে ভালোবাসেন, সমাজ ও জনগণের মুক্তি চান, এমন বন্ধুবান্ধব প্রায়শই আমাকে বলেন, ‘আপনারা কলমযোদ্ধারা দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য অনেক লেখালেখি করেন বটে। কিন্তু কীভাবে মানুষের মুক্তি আসবে, কী কী কারণে রাষ্ট্র ও সমাজের মৌলিক পরিবর্তনই হচ্ছে না, কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না, এ বিষয়ে এমন কিছু ইনক্লুসিভ লেখালেখি হওয়া জরুরি।
যার মাধ্যমে মানুষ একটি পরিষ্কার দিকনির্দেশনা পেতে পারে।’ সচেতন ব্যক্তিরা দেশ ও সমাজ নিয়ে কম চিন্তা করেন না, কিন্তু কোনো কূলকিনারা পান না। কারণ দেশের শাসক ও শাসিত সকলের বড় রোগ হলো খালি তত্ত্বচর্চা। আমলা বুর্জোয়া শাসকরা বিপ্লবী তত্ত্ব বোঝেন না- তারা ‘প্রবৃদ্ধি’, ‘উন্নয়ন’, ‘মধ্যম আয়’ ও ‘উন্নত আয়ের’ তত্ত্ব চর্চা করেন, উদীয়মান ব্যাঘ্রের তত্ত্ব চর্চা করেন। উন্নয়ন কাদের হচ্ছে, মধ্যম আয়ের মহোৎসব কারা করছে এসব প্রশ্নের ধারেকাছেও না গিয়ে শাসকশ্রেণি শুধু নিজেদের তত্ত্বই চর্চা করেন।
এর বিপরীতে যারা শাসকদের ‘তত্ত্বের’ শুভংকরের ফাঁকটি বোঝেন তারাও একইভাবে ওই তত্ত্ব চর্চা করেন। দক্ষিণপন্থিরা চর্চা করেন ক্ষমতাসীনদের দূর্নীতির তত্ত্ব, নির্বাচনের প্রহসনের তত্ত্ব, নিজেদের ভালোমানুষির তত্ত্ব, আন্দোলন জোরদার করার তত্ত্ব। তত্ত্ব চর্চা করে কোনো রকমে দল টিকিয়ে রাখেন। দল না থাকলে তো রাজনীতির ব্যবসায় দেউলিয়া হওয়া। আর বামপন্থিরা চর্চা করেন মার্সসবাদী তত্ত্ব, লেনিনবাদী ও মাওবাদী তত্ত্ব, উপনিবেশ-নয়া উপনিবেশ তত্ত্ব, সমাজতন্ত্র, কমিউনিজমের তত্ত্ব। এমনিতেই মার্কস-লেনিন-মাওয়ের চিন্তা যখন তত্ত্ব হয়ে যায় তখন তা থাকে বিমূর্ত অবস্থায়। তদুপরি সেই বিমূর্ত তত্ত্বকে যখন ‘ইজমে’ পরিণত করা হয় তখন তা পরিণত হয় বাইবেল-কোরআনের মতো চিরন্তন ধর্মতত্ত্বের মতো। এই রূপ ইজম দিয়ে বেশুমার তত্ত্বচর্চা করা যায়, কিন্তু সমাজ পরিবর্তন করা যায় না। সমাজে ব্যাপকভাবে আরও আছে চিরায়ত ধর্মতত্ত্বের চর্চা।
কিন্তু কারও মধ্যেই ইতিহাস চর্চা নেই। দুনিয়ার, বিশেষত উপমহাদেশ ও নিজ দেশের ইতিহাসচর্চা কেউ করেন না। আবার কোনো কোনো বাম তথাকথিত ইতিহাস চর্চা করেন এভাবে- তারা উপমহাদেশের প্রাচীনকালের (আর্যভারতের) ইতিহাস পড়েন, কিন্তু মধ্যযুগের ইতিহাস পাঠে তাদের আগ্রহ নেই। যারা মধ্যযুগের মুসলমানদের ইতিহাস পড়েন তারা আর্যভারতের ইতিহাস ছুঁয়ে দেখেন না। যারা হিন্দুর ইতিহাস পড়েন তারা মুসলমানের ইতিহাস পড়েন না। যারা মুসলমানের ইতিহাস পড়েন তারা হিন্দুর ইতিহাসকে মনে করেন কাফেরের ইতিহাস, ওদিকে ফিরে তাকান না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বামপন্থিদের অধ্যয়ন তালিকার এক পুস্তিকা দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। তাদের ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়ার পাঠ্যসূচিতে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ব্রিটিশ যুগের ইতিহাস পাঠের নির্দেশনা আছে, কিন্তু ভারতবর্ষে প্রায় সাড়ে সাতশ বছরের মুসলিম যুগের ইতিহাস পাঠের কথা তালিকায় নেই। তাদের মতে মুসলমানের ইতিহাস হলো ‘মৌলাবাদীদের’ ইতিহাস, যা পড়লে আর বামপন্থি, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী হওয়া যাবে না। প্রগতিবাদীদের কাছে একাত্তরের ইতিহাস ছাড়া বাংলাদেশের যেন আর কোনো ইতিহাস নেই, ৪৭-এর ইতিহাস থাকলেও তা মিথ্যা, ঝুটা, প্রতিক্রিয়াশীল। মৌলবাদী পাকিস্তানের ইতিহাস, দেশভাগের ইতিহাস? জিন্নাহর ইতিহাস। এসব ভারতবর্ষের ইতিহাস নয়। গান্ধী-নেহরুর ইতিহাস নয়, তাই বাংলাদেশেরও ইতিহাস নয়। এভাবে ইতিহাস নিয়ে চরম মূর্খামি আমাদের বহু আগেই ঘটে গেছে।
এর ফলে কী হয়েছে? বাংলাদেশের (পূর্ববাংলার) হাজার বছরের ইতিহাস কখন কীভাবে অগ্রসর হয়েছে, কখন কীভাবে মোড় ঘুরেছে, তার পর আবার কীভাবে নতুন করে মোড় নিয়েছে সেই চর্চা আমরা করিনি। ইতিহাস চর্চা হলো ইতিহাসের পর্যালোচনা। ইতিহাসের বাঁকগুলো জ্যামিতির মতো স্বতঃসিদ্ধভাবে বুঝতে পারার মধ্যেই আমাদের মুক্তির সব বিষয় অঙ্কের মতো বোঝা যায়। তত্ত্ব বিমূর্ত। গতিমান ইতিহাস ও ইতিহাসের বাঁকগুলো হলো মূর্ত। তাহলে আসুন। ইতিহাসের বাঁকগুলো আমরা আবারও বোঝার চেষ্টা করি।
উপমহাদেশে প্রায় সাড়ে সাতশ বছরের (প্রায় এক হাজার বছরের) মুসলিম শাসনের কাল ছিল, বলতে গেলে এক বিশাল বড় কাল। ভারতবর্ষে বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য ও শক-হুনদের কাল বাদ দিলে ব্রাহ্মণ্য শাসনের কাল মুসলিম শাসনের কাল থেকে খুব বেশি নয়। এক হাজার বছরের কিছু অধিক কাল, আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের বর্ণবাদী ধর্ম ও সংস্কৃতি দিয়ে গোটা ভারতবর্ষকে (পূর্ববঙ্গ বাদে) যেভাবে প্রভাবিত করেছিল, সাতশ বছরে মুসলমানরা তাদের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের ধর্ম, সংস্কৃতি দিয়ে কম প্রভাবিত করেনি।
মুসলমানের ধর্ম ও সংস্কৃতি (ইসলাম) যে চেহারাই ভারতবর্ষে এসে থাকুক; তা দিয়েই তারা প্রায় দেড় হাজার বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদী অচলায়তনকে বহুলাংশে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছিল। শঙ্করাচার্য, রামানুজ, শ্রীচৈতন্য, রামমোহন, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদের সৃষ্টি নন, ইসলামেরও সৃষ্টি।
আর সেই ইসলাম সর্বপ্রথম দক্ষিণ ভারত হয়ে প্রবেশ করেছিল পূর্ববঙ্গে। পূর্ববাংলার ইতিহাস কখনোই ব্রাহ্মণ্যবাদের ইতিহাস ছিল না। ব্রিটিশ আমলের আগ পর্যন্ত প্রায় হাজার বছর ছিল আর্য-ব্রাহ্মণ্যবাদমুক্ত। সে কারণে মাঝখানে ব্রিটিশ ভারতের দুইশ বছর এ ভূখণ্ড ব্রাহ্মণ্যবাদী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি দ্বারা দখলকৃত হলেও এবং একাত্তরের পর এখনো সেই ‘দখলদারিত্ব’ বহাল থাকলেও ভূখণ্ডের জনগোষ্ঠী সর্বদা মুসলিম ঐতিহ্যের দ্বারা প্রভাবিত ও লালিত হয়ে অন্তরের অন্তস্তলে তাদের স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে চলেছে। যা ব্রাহ্মণ্যবাদী ইতিহাস-সংস্কৃতির আগ্রাসনের মধ্যেও আজো দৃঢ়ভাবে অনড়। পূর্ববাংলার এই ইতিহাস মুষ্টিমেয় সংখ্যক ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রভাবিত রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও পেটিবুর্জোয়াদের তৈরি ইতিহাস পাঠ করে বোঝা যাবে না। আবার অর্থডক্স মুসলমানদের তৈরি ইতিহাস পাঠ করেও বোঝা যাবে না। তার জন্য পাঠ করতে হবে ভূখণ্ডের আশিভাগ কৃষকসহ বাদবাকি জনগণের ইতিহাস। আজকেও বাংলাদেশের সত্তর-আশি ভাগ জনগণ যে ভারতবিরোধী সেটি ভারতের ভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠীর বিরোধী নয়, তারা ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী। এই ইতিহাস না বুঝলে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি বোঝা অসম্ভব। এই ইতিহাস না বোঝার কারণেই এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থিরা সাতচল্লিশের ইতিহাস, ৪৭-এর বদৌলতে এ ভূখণ্ডের সকল হিন্দু জমিদাররা ভারতে চলে যাওয়ার ফলে পূর্ববাংলায় যে একটা নীরব ভূমি বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল, জমিদারদের দাসপ্রজা কৃষকরা যে জমির মালিক হয়ে স্বাধীন কৃষক হয়ে গিয়েছিল, সেই ইতিহাস এ ভূখণ্ডে বাম প্রগতিবাদীরা বোঝেননি। তারা ৪৭-কে বুঝেছেন শুধু একটি ‘পাপ’ হিসেবে। তাই তারা কৃষকদের কাছে গিয়েছেন ৪৭-এর পাপমোচনের রাজনীতি নিয়ে। বাস্তব রাজনীতিটা বুঝলে এবং কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনসহ গ্রামটা সঠিক রণনীতি অনুযায়ী পরিচালনা করলে ইতিহাস অন্যরকম হতো। কী রকম হতো?
দেশের স্বাধিকারও অর্জিত হতো, স্বাধীন কৃষকরা সচ্ছল ও সমৃদ্ধিশালী হতো। জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটত। দেশ আধুনিক কৃষি ও শিল্পোন্নত দেশে রূপান্তর হতো। বাস্তব রাজনীতিটা না বোঝার কারণে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ‘নাকখত’ দেওয়া যে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে তাতে আমলা-বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রই কেবল তার মতো করে স্বাধীন হয়েছে, জনগণ স্বাধীন হয়নি। সাতচল্লিশের বদৌলতে হওয়া ৮৫ ভাগ স্বাধীন কৃষক নতুন করে পরাধীন হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও বহুজাতিক কোম্পানির শেকলে আবদ্ধ হয়েছে। জাতীয় পুঁজির বিকাশ না হয়ে বাড়বাড়ন্ত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদের দালাল রাজনীতিক ও আমলাগোষ্ঠীর লুটেরা পুঁজির। যে লুটেরা পুঁজির পরোক্ষ বেনিফিশিয়ারি হয়েছে জাতির ‘আত্মা’ জ্ঞানী-গুণী-মনীষীরাও।
রইস উদ্দিন আরিফ
লেখক ও গবেষক
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh