সুনামগঞ্জ-সিলেট কেন ডুবল

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার অভিজ্ঞতা হলো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জবাসীর। এ সময়ে যারা প্রবীণ, তারাও এমন ভয়াবহ বন্যার কথা মনে করতে পারেন না। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে জেলার সবচেয়ে উঁচু স্থানটিও। এর আগে বন্যায় যাদের বসতঘরে পানি ওঠেনি, তারাও এবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। পানি উঠে গেছে উঁচু সড়কে। ফলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে কোমর বা বুকসমান পানি পেরিয়ে, সাঁতরে অথবা নৌকাই ভরসা। শহরের ভেতরেই হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি।

কেন এই পরিণতি : গণমাধ্যমের খবর মতে, ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে তিন দিনে আড়াই হাজার মিলিমিটারের মতো বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল চেরাপুঞ্জিতে ১৬ ও ১৭ জুন ২৪ ঘণ্টায় ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যা ১২২ বছরের মধ্যে এক দিনে তৃতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। আর উজানে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে তার পানি যে ভাটিতে অর্থাৎ বাংলাদেশে নেমে আসবে, এটিই স্বাভাবিক; কিন্তু সেই অতিরিক্ত পানি ধরে রাখার কথা যে নদী, হাওর ও জলাশয়ের সেগুলোর ধারণক্ষমতা কি আগের মতো আছে?

সুনামগঞ্জ এলাকার নদীগুলো নানা কারণে ভরাট হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় নদী দখল হয়েছে। নদীর যে স্বাভাবিক গতিপথ তা রুদ্ধ হয়েছে। নদীর জায়গা সংকুচিত হয়েছে। আবার প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে পলি পড়ে নদীর গভীরতা কমেছে; কিন্তু এর প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য নদীগুলো যেভাবে খনন করার কথা ছিল, তা হয়নি। নদীগুলো নাব্য, গভীর থাকলে, তার প্রশস্ততা ঠিক থাকলে সে অতিবৃষ্টি ও বন্যার অতিরিক্ত পানি ধরে রাখতে পারত। তাহলে এখন লাখ লাখ মানুষকে বানভাসি হতে হতো না। বৃষ্টির পানিতে নদী ও জলাশয়গুলো থই থই করত। মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে যেত না। হাওরের বাঁধ ভেঙে ফসলের জমি তলিয়ে যেত না।

কথা উঠছে, কিশোরগঞ্জের হাওরের ভেতর দিয়ে নির্মিত বহুল আলোচিত অলওয়েদার সড়ক নিয়ে। কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের তিনটি উপজেলার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ সহজ করতে প্রায় ৩০ কিলোমিটারের দীর্ঘ যে অলওয়েদার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছিল; এটি ওই অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ সহজ করলেও সুবিধা দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলা হচ্ছে, এ সড়কের কারণেই এবারের বন্যার পানি হাওর থেকে দ্রুত নদীতে নামতে পারছে না।

সুতরাং প্রকৃতির নিয়মে অতি বৃষ্টির ফলে বন্যা হলে সেই বন্যার পানি নদী, হাওর ও জলাশয়গুলো ধরে রাখতে পারছে কিনা; শেষ পর্যন্ত সেই বিপুল পানি বিভিন্ন জেলার উপর দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পড়তে পারছে কিনা; না-কি স্বাভাবিকের বেশি বৃষ্টি হলেই কিংবা উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে এলে, সেই পানি নদী ও জলাশয় উপচে জনপদ ডুবিয়ে দিচ্ছে সেই ভাবনাটি জরুরি।

বছরের এই সময়টায় ভারী বৃষ্টি এবং তার ফলে বন্যা খুব অস্বাভাবিক নয়; কিন্তু সুনামগঞ্জের কোন কোন পয়েন্ট দিয়ে পানি ঢুকতে পারে এবং কোন কোন এলাকা দিয়ে পানি বের করে দেওয়া যাবে, সেটি কি চিহ্নিত করা আছে? যদি থাকে তাহলে ওই এলাকার মানুষকে কেন আগেভাগে প্রস্তুত করা গেল না? কেন বন্যার পানিতে মানুষকে বন্দি হতে হলো। যে বাংলাদেশকে বলা হয় দুর্যোগ মোকাবেলায় রোল মডেল, সেই দেশের লাখ লাখ মানুষ কেন পানিবন্দি হয়ে পড়বে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে হাহাকার করবে? স্থানীয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্টরা কেন মানুষকে আগেভাগে নিরাপদে সরিয়ে নিতে ব্যর্থ হলেন? তারা কেন এত বড় একটি বিপদ আগেভাগে টের পেলেন না? এটি আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা নয় কি?

কিছু দিন আগেও দেখা গেছে, পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙে কৃষকের স্বপ্নের ফসল তলিয়ে গেছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় রোল মডেল যে দেশ, সেই দেশের বেড়িবাঁধ কেন পানির তোড়ে ভেঙে যাবে? কী বাঁধ বানানো হলো? কত টাকা বরাদ্দ ছিল, কত টাকার কাজ হয়েছে, ঠিকমতো কাজ না করে কেউ কি টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে গেছেন? বাঁধ নির্মাণের পর সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কেন হয়নি? স্থানীয় মানুষজনকে কি এ সব কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল?

সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের অভিযোগ, নানা জায়গায় অপ্রয়োজনে বাঁধ হলেও প্রয়োজনীয় জায়গায় তা নির্মাণ করা হয়নি। আবার বাঁধ নির্মাণে অনিয়মেরও শেষ নেই। ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল কিংবা ভারী বৃষ্টির পানির তোড়ে বাঁধগুলো ঝুঁকিতে পড়ে। আরেকটি বড় অভিযোগ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে হাওরে বাঁধ নির্মাণের জন্য পিআইসি গঠন করা হয়। যে কারণে নিম্নমানের বাঁধ নির্মাণ করা হলেও তার কোনো জবাবদিহিতা নেই। আবার প্রয়োজনীয় অনেক স্থানে বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ রাখা হয়নি। পাড় থেকেই মাটি কেটে বাঁধে ফেলাতেও কিছু বাঁধ ঝুঁকিতে পড়েছে। অন্যদিকে নদী খননের বাজেট কোথায় ও কতটুকু খরচ করা হয়েছে? কী কাজ হয়েছে? সেই কাজের ফলাফল কী?- তা নিয়েও স্থানীয়দের মনে প্রশ্নের শেষ নেই।

মূলত আমাদের সমস্ত উন্নয়ন সড়ককেন্দ্রিক। মানুষও দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে যেতে চায়। দ্রুত পণ্য পাঠাতে চায়। যে কারণে দিগন্ত বিস্তৃত জলের আধার যে হাওরের ধর্মই হলো ‘বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও’ (বর্ষাকালে নৌকা, শুকনো মৌসুমে পা), সেই হাওরের বুকে সারা বছর গাড়ি চলাচল এবং মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের নামে হাওরের বুক চিরে বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। হাওরে দ্রুতগামী ও নিরাপদ নৌযান চালুর বদলে পানির উপরে বিশাল সড়ক নির্মাণ করলে তাতে স্থানীয় মানুষও খুশি হয়। হাজার হাজার মানুষ সেই সড়কে গিয়ে সেলফি তোলে; কিন্তু যখন বন্যার পানি এসে ধাক্কা দেয়, তখন সেই সড়কের বাধায় বন্যার পানি নামতে না পেরে মানুষের বাড়ি-ঘর ডুবে যায়, তখন সেই মানুষেরাই আবার ওই সড়কের সমালোচনা করে। 

সুনামগঞ্জের মানুষ যখন স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্ত হলো, তখন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, বন্যার পানি অপসারণে প্রয়োজনে রাস্তা কেটে ফেলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি জানান। অর্থাৎ যেসব রাস্তার কারণে পানি নেমে যেতে পারছে না, সেসব রাস্তা তাৎক্ষণিকভাবে কাটার ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হলো, এখন কেন রাস্তা কেটে ফেলার কথা বলছেন? রাস্তা বানানোর সময় কেন এটি মাথায় ছিল না যে, এই রাস্তা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করবে? এখন কেন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে বলতে হচ্ছে যে, ভবিষ্যতে হাওরের ভেতর দিয়ে, অর্থাৎ পানির প্রবাহ ব্যাহত করে কোনো সড়ক হবে না। প্রয়োজনে উড়াল সড়ক নির্মাণ করতে হবে। কেন হাওরের বুক চিরে দৃষ্টিনন্দন অলওয়েদার সড়ক বানানোর আগে এর দীর্ঘমেয়াদি কুফল সম্পর্কে নীতিনির্ধারকরা চিন্তা করলেন না? পরিবেশবাদীরা কি তাদেরকে সতর্ক করেননি?

পরিশেষে সিলেট-সুনামগঞ্জ থেকে পানি নেমে যাবে। মানুষের এই দুর্দশাও কেটে যাবে। ঘরহারা মানুষেরা নিজেদের ঘরে ফিরবে। ভেঙে যাওয়া ঘর সংস্কার করবে। নতুন আবাস বানাবে। যাদের বুকশেলফ ডুবে গেছে, তারা নতুন বই কিনবে। আমরাও এই দুঃসময় ভুলে যাব; কিন্তু তারপর আবারও ভুল পরিকল্পনা নিয়ে উন্নয়নের নামে নদী ও পরিবেশবিধ্বংসী অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। সমস্ত উন্নয়ন আবারও সড়ককেন্দ্রিক হবে। নদী হাওর পুকুর জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল সুরক্ষা আমাদের উন্নয়নভাবনা থেকে হাওয়া হয়ে যাবে। নদী ভরাট ও দখল করে গড়ে তোলা হবে বড় বড় কল-কারখানা, যেখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে; দেশের প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বাড়বে। কেননা আমাদের উন্নয়নের মানদণ্ড জিডিপি, মাথাপিছু আয়। নদী, পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতি সেখানে বিবেচ্য নয়।

সুতরাং সুনামগঞ্জের এই বিপদ কেটে গেলে আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে সত্যিই কেন এই জনপদের মানুষ বিপন্ন হলো? বন্যা প্রাকৃতিক। অতি বৃষ্টি হলে বন্যা হবে এটিই স্বাভাবিক; কিন্তু প্রকৃতির সেই স্বাভাবিক ঘটনায় মানুষ কেন বিপন্ন হবে, সেখানে মানুষের নিজের দায় কতটুকু তার নির্মোহ বিশ্লেষণ ছাড়া ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে না বা ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের ভেতরে রাখা যাবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //