সেই ছোটবেলায় পঞ্চম শ্রেণির
বাংলা পাঠ্য বইয়ে কবি কাজী কাদের নেওয়াজের 'শিক্ষকের মর্যাদা' কবিতায় পড়েছিলাম-
বাদশাহ আলমগীর
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী
দিল্লীর ;
একদা প্রভাতে গিয়া,
দেখেন বাদশাহ-শাহাজাদা এক পাত্র
হস্তে নিয়া;
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে;
পুলকিত হৃদয় আনত-নয়নে।
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া
নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্
সঞ্চারি অঙ্গুলি।
যার মর্মার্থ হলো- দিল্লীর বাদশাহ আলমগীরের পুত্রকে পড়াতেন এক মৌলভী। একদিন সকাল বেলা গিয়ে বাদশাহ দেখতে পেলেন তার পুত্র শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছে আর শিক্ষক নিজ হাতে পায়ের ধুলোবালি পরিস্কার করছেন।
বাদশাহকে দেখে শিক্ষক ভাবলেন
বাদশাহ'র পুত্রের দ্বারা পায়ে পানি ঢেলে নিয়েছি! তাই আজ হয়তো রক্ষা নেই আর। মানসম্মান
বুঝি আজ চলে যাবে সব। কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিল শিক্ষকের।
এমন সময় শিক্ষক হঠাৎ আনমনে
বলে উঠলেন-
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার,
মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা
শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি
বোঝাব শাহানশাহে।
না, বাদশাহ শিক্ষককে ডেকে পাঠালেও
তা আর শোনাতে হয়নি বাদশাহকে। বরং-
শিক্ষককে ডাকি বাদশাহ কহেন,
”শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য
কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখিয়াছে বেয়াদবি আর গুরুজনে
অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং
সকাল বেলা”
শিক্ষক কহেন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে
পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন
নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, ”সেদিন প্রভাতে
দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন
প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে
ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া
সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”
দিল্লীর বাদশাহ মনে ব্যথা পেয়েছিলেন
এই ভেবে যে তার পুত্র নিজ হাত দিয়ে শিক্ষকের পা ধুয়েমুছে না দিয়ে কেবল পায়ে পানি ঢেলে
দিয়ে বেয়াদবি করেছিলেন। বাদশাহ আশা করেছিলেন তার পুত্র শুধু পানি ঢেলে দেওয়া নয়, নিজ
হাতে শিক্ষকের পায়ের ধুলোবালিও ধুয়েমুছে দিবেন। এতে করে জাগ্রত হবে তার পুত্রের মানবিক
মুল্যবোধ, নৈতিকতা ও স্বদেশ প্রেম। হবে আদর্শ মানুষ। দিল্লীর বাদশাহ হয়েও তিনি হয়তো
উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যে ছাত্র শিক্ষককে মর্যাদা দিতে জানে না, সে কখনো পরিবার,
সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকামী মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারে না।
শিক্ষকের প্রতি বাদশার এমন
সম্মান প্রদর্শন দেখে শিক্ষক উচ্ছ্বাস নিয়ে
বলে উঠলেন-
'উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষককে আজি
দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন
উচ্চরবে-
আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর
শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ
আলমগীর।'
কবিতাটির শিক্ষনীয় দিক হলো
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আর শিক্ষকরা সেই মেরুদণ্ডের স্রষ্টা। নৈতিকতার বিচারে শিক্ষকরা
সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। তারাই মানুষ গড়ার কারিগর। সমাজের বিবেক। দুনিয়ায় যারাই মহৎ
বা উচ্চতর পদে সমাসীন হয়েছেন তারা কোনো না কোনো শিক্ষকের নিকট জ্ঞানার্জন করেছেন।
শিক্ষিত জন মাত্রই আমরা শিক্ষকের
নিকট ঋণী, যেমনটি ঋণী আমরা আমাদের মা-বাবার নিকট। বছর কয়েক আগের কথা। কোনো এক পাঠ্য
বইয়ের প্রশ্নে দেখেছিলাম মা-বাবার চেয়ে উত্তম অভিভাবক কে? মা-বাবার চেয়ে উত্তম অভিভাবক!
তিনি আবার কে? জবাব জানা না থাকায় কৌতূহলটা বেশ বাড়লো আমার। অবশেষে ভিতরে খুঁজে পেলাম
জবাব- শিক্ষক।
উত্তর যথার্থ। কারণ মা-বাবা
সন্তান জন্ম দিলেও সেই সন্তানকে যথাযথভাবে পাঠদানের পাশাপাশি স্বপ্ন দেখানোর মাধ্যমে
মনের সুপ্ত প্রতিভা জাগ্রত ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে তাদেরকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে
গড়ে তোলেন শিক্ষকরা। কার্পণ্য করেন না নিজে স্বল্প মাইনে ও সিকি বোনাসভুক্ত শিক্ষক
হলেও তার শিক্ষার্থীদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। সে জন্যই তো তারা মা-বাবার চেয়ে
উত্তম অভিভাবক। শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয়। কারণ একজন শিক্ষকের ছাত্রই রাষ্ট্রপ্রধান থেকে
শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে দায়িত্বে থাকেন।
আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন
তিনি তার সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে
স্কুলের প্রধান শিক্ষক বরাবর যে চিঠিটি লিখেছিলেন তা আজো শিক্ষকদের জন্য শুধু শিক্ষাদানের
পথ-নির্দেশিকাই নয়, অভিভাবকদের জন্যও অনুসরণীয় বলা যেতে পারে।
শিক্ষকের মর্যাদা ও সম্মান
নিয়ে এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে হাজারো। কিন্তু এখন আর তেমনটি দেখা যায় না। অতীতে যারা স্কুলে
পড়েছি তাদের মধ্যে শিক্ষকের বেতের মার, নীলডাউন (বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের শাস্তিবিশেষ)
হইনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পড়া না হলে ইচ্ছেমত মারতেন বেত দিয়ে, তারপরেও শিক্ষার্থীদের
কোনো অভিযোগ ছিল না, তেড়ে আসতেন না অভিভাবক শিক্ষককে মারতে। গুণতে হতো না জরিমানা, শুনতে হতো না মিথ্যে অপবাদ,
করতো না শিক্ষকের বিরুদ্ধে মানববন্ধন। কারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে স্নেহ-ভালবাসার
বন্ধন ছিল অটুট। এখনো মনে হয় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের দেখলে তাদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম
করি। একইভাবে শ্রদ্ধা করি ও স্যার বলে ডাকি আমার সন্তানদের শিক্ষকদেরও।
কিন্তু এখন ঘটছে ঠিক তার উল্টো।
ছড়ি ঘুরাচ্ছে শিক্ষকদের ওপর। শিক্ষককে পিটিয়ে মারছে তারই ছাত্র। আবার এক শিক্ষক আরেক
শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রকে লেলিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে সমাজে।
কখনো শিক্ষকগণ অভিভাবকদের হাতে,
কখনোবা কমিটির সদস্যদের হাতে। কখনোবা অপমানিত,
লাঞ্ছিত এমনকি শারীরিকভাবেও হামলার শিকার হচ্ছেন নিজ শিক্ষার্থীদের হাতেও। শিক্ষককে
পানিতে চুবানো, কান ধরে উঠবস করানো, গলায় জুতার মালা পরানো এবং সবশেষ স্টাম্প দিয়ে
মেরে হত্যায় গিয়ে ঠেকেছে শিক্ষকদের মর্যাদা। শিক্ষক নির্যাতনের এমন সব অমানবিক চিত্র
পত্রিকার পাতায় প্রায়ই চোখে পড়ছে।
গত ২০১৯ সালেও ৩ সেপ্টেম্বর
রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ফেল করায় কয়েকজন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের
অধ্যক্ষকে লাঞ্ছিত করার পর ক্যাম্পাসের পুকুরে ফেলে দেওয়া, গত ১৩ জুন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে
ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় চার শিক্ষিকার গায়ে গোবর ও কাদা মিশ্রিত ময়লা পানি
বখাটেদের ছুঁড়ে মারা, চলতি মাসে নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত
অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো, শাসন করায় আশুলিয়ার হাজী ইউনুস
আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমারকে ওই বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী
আশরাফুল আহসান জিতুর স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর অতঃপর মৃত্যু- এমন খবরগুলো দেশের শিক্ষকসমাজকে মর্মাহত
করেছে, ঘটিয়েছে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। ব্যথিত করেছে দেশের সাধারণ মানুষকেও।
অতীতে যেখানে শিক্ষকদের সম্মান করাই ছিল আমাদের সমাজের রীতি সেখানে সম্মানতো দূরের কথা আজ একজন শিক্ষক তার সমাজেই শুধু নন, তার বিদ্যালয়ে এমনকি শ্রেণিকক্ষেও ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়, তটস্থ থাকেন অজানা ভয়ে। না জানি কখন কী হয়! শিক্ষকদের সম্বল বলতে ওই সম্মানটুকুই। তাও যদি হারিয়ে ফেলেন, তবে আর বাকিটা থাকলো কী! সম্মান হারানোর শঙ্কা নিয়ে একজন শিক্ষক কিভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করবেন তা ভাবার সময় এসেছে। নইলে মেধাবীরা যে এ পেশায় আসতে অনুৎসাহবোধ করবেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। যার সুদূরপ্রসারি ফল হবে নেতিবাচক।
শিক্ষকরা সমাজের বিবেক। শিক্ষকরা
হচ্ছেন দেশ গড়ার প্রধান নিয়ামক শক্তি। তাই শিক্ষকদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত
করা আমাদের সবার দায়িত্ব। দেশব্যাপী শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা, শিক্ষকদের
জীবনমান উন্নত করার ব্যাপারে বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, আদর্শ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর
মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি এবং শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট
হওয়া এখন সময়ের দাবি।
যাই হোক, শিক্ষকদের অপমান আর
অপদস্তের হাত থেকে বাঁচানো বা মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুশিক্ষিত ও নৈতিক মূল্যবোধ
সম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার মতো নিশ্চিত করতে হবে শিক্ষকদের মর্যাদা। কারণ বাংলাদেশ
ইতোমধ্যেই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে। আর এর পিছনে রয়েছে শিক্ষার অবদান। এখন
স্বপ্ন স্বপ্নোন্নত অর্থনীতির দেশ থেকে উন্নত অর্থনীতির দিকে টেক অফ করা এবং তা নির্ভর
করবে অনেকটা শিক্ষার ওপর। এ জন্য প্রয়োজন শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা।
সুতরাং শিক্ষকরা যেন মান-মর্যাদার সাথে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে, নীতি-নৈতিকতাবোধসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন শিক্ষার্থীদের। আবার ফিরে আসুক তাদের মর্যাদার সেই স্বর্ণালী অতীত, পাঠ্যপুস্তকে আবার অন্তর্ভুক্ত হোক 'শিক্ষকের মর্যাদা কবিতা।' জানুক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা কিভাবে সম্মান করতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের নিকট এতটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক : এম এ মাসুদ, কান্দি গার্লস আলিম মাদ্রাসা, পীরগাছা, রংপুর
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh