প্রকৃতির জগতে মানবজগৎ-সম্পর্ক ও ভবিষ্যৎ

পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে প্রকৃতি ও মানুষ দুটি জগৎ ক্রিয়াশীল। যদিও মানুষের বাইরে প্রকৃতির কোনো আলাদা জগৎ নেই। তারপরও মানুষ নিজের জগৎ সৃষ্টি করতে পারার এবং এই জগৎকে সমৃদ্ধ ও অগ্রসর করতে পারার কৃতিত্বের দাবি করে। নিজের জগৎকে অধিকতর সুন্দর ও শান্তিময় করার পাশাপাশি প্রকৃতির জগৎ সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটনে তার আগ্রহ কখনো থেমে থাকেনি। তবে অগ্রগতি যে আছে তা বলাই বাহুল্য। 

গ্রিক দেশে দর্শনের জনক থেলিসের সময় জীবন-জগৎ জিজ্ঞাসা যেখানে ছিল, সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটলের কালে সেখানে থেমে থাকেনি। শেষোক্তদের চিন্তা এবং দেখানো পথ এবং জগৎ-জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে চিন্তার যে ভিত্তি তা অবলম্বন করেই মানবজাতি ক্রমাগত অগ্রসর হতে পেরেছে। তবে সমাজ অগ্রগতির প্রশ্নে তিনটি মতধারা প্রণিধানযোগ্য হয়ে ওঠে। এসবের একটি হলো ক্ষমতালিপ্সা, দ্বিতীয়টি অর্থ সম্পদ অর্জনের চাহিদা এবং তৃতীয়টি যৌনচাহিদা চরিতার্থ বা বংশবৃদ্ধির দায়বোধের তাগিদ। এই তিনের যুগপৎ আবশ্যকতা সর্বজনগ্রাহ্য।

ক্ষমতার অন্যায্য-বেপরোয়া কর্তৃত্ব

জগৎ-সংসার গতিশীল হওয়ার পেছনে ক্ষমতার ভূমিকাকে সমাজ ও রাজনীতি মেনে চলে। ক্ষমতা প্রয়োগ করে নেতৃত্ব। নেতৃত্ব করে মানুষ। কিছু মানুষ সকল মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সমাজ-রাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে। সে অর্থে ক্ষমতার উৎস মানুষ-মানে জনগণ। প্রশ্ন হলো মানুষ এই ক্ষমতা পায় কার কাছ থেকে? এই প্রশ্নে ইতিহাসবাদীরা অর্থাৎ সমাজ কিংবা রাজনীতিবিজ্ঞান নীরব। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা ইহকাল-পরকাল পরিচালিত হওয়ার সকল ক্ষমতার উৎস এবং মানুষ এই জগতে সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়।

মানবপ্রজাতির এই গ্রহের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া এবং আজকের দিনে এক রাষ্ট্র বা এক জাতি রাষ্ট্রের পক্ষে অন্য রাষ্ট্র বা অন্য জাতিকে দখলে নেওয়া কি এক কথা? এখন আধিপত্য একটি ঘৃণিত কথা। ভারতবর্ষে মধ্য-এশিয়ার আর্যদের আধিপত্যকে ভারতবাসী একপ্রকার ভুলে গেছে। পরবর্তীকালে একই মধ্য-এশীয় অঞ্চল থেকে আসা তুর্কি-মোগলদেরকে আর্যবাদীরা মনে করে দখলদার এবং নিজেদেরকে ভারতবর্ষের মালিক মনে করে। যখন তারা তুর্কি-মোগলদের অনুপ্রবেশকারী যবন বা দখলদার বলে তাদেরকে উচ্ছেদের আওয়াজ তোলে তখন নিজেরাও যে ভারতে দখলদার সে কথা বেমালুম ভুলে যায়। দখল পালটা দখলকে ইতিহাস স্বাভাবিক গতি ও নিয়ম বলে মেনে নিয়ে চলে। এই ধারায় ভারতবর্ষ হিন্দুস্থান এবং পাকিস্তান নামে বিভক্ত করে এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অস্বাভাবিক ও প্রকৃতি-রীতিবিরুদ্ধ রাষ্ট্র গড়ে তোলে যেখানে ভারতবাসী নিতান্ত অসহায়। পরে ব্রিটিশদের আগমনকে আধিপত্য বলে তাদের সরাতে এই দুই আধিপত্যবাদী শক্তি একসময় সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে। ব্রিটিশরা তৃতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি হিসাবে একতাবদ্ধ পূর্বোক্ত দুই দখলদার শক্তিকে বিভাজিত করার কৌশল গ্রহণ করে তাদের দখল টিকিয়ে রাখতে চায়। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের সরে যেতে হয়। 

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পৃথিবীতে এরকম অজস্র যুদ্ধ সংঘটিত হতে দেখা যায়। সবগুলো যুদ্ধের মূলে রয়েছে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা। রয়েছে বিকৃত ক্ষমতার অপব্যবহারের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা। রামায়ণ-মহাভারতের যুদ্ধ, কারবালার যুদ্ধ, ক্রুসেড, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, শ্রেণিযুদ্ধ-সবই ক্ষমতার দ্বন্দ্বের দখল-পালটা দখলের যুদ্ধ। যুদ্ধের বিপক্ষেও মানুষের আর্তি ছিল। ভারতে হিন্দু-মুসলিম বিরোধের মূলে আছে ভারতকে দখলে রাখা এবং দখলে নেওয়ার লড়াই। মূলের এই কারণের দিকে না গিয়ে উপরের দিকের সকল মীমাংসা-প্রচেষ্টা ধামাচাপায় পরিণত হতে দেখা যায়। যুদ্ধ থামেনি কখনো। ফিরে আসে বারবার ভিন্নরূপে-মানবতার সকল ক্রন্দন ও উদ্যোগ যায় ভেস্তে। 

কেবল ভারতবর্ষে নয়, সমগ্র দুনিয়ায়ই চলছে এরকম ইতিহাস এবং এই ইতিহাস ও সমাজবীক্ষা অর্থাৎ নিজ দখলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত দখলদারি খারাপ আর নিজের দখলদারি কায়েমের পরক্ষণেই দখলস্বত্ব জায়েজ হয়ে যায়-এই ইতিহাসই ইতিহাসের শিক্ষা। এরকম অন্যায্য ইতিহাসের ধারায় গড়ে উঠেছে দুনিয়াজুড়ে রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা। যাকে আমরা ক্ষমতা বলে সংজ্ঞায়িত করি, তা আসলে শক্তির প্রয়োগ-প্রকাশ। ক্ষমতাবান হওয়ার পিছনে শক্তির প্রয়োজন পড়ে। শক্তির জোরেই মানুষ সক্রিয় এবং এই সক্রিয়তার পিছনে রয়েছে ক্ষমতা। শারীরিক ও মানসিক সকল কর্মই ক্ষমতার প্রকাশ। শক্তির এরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পদার্থবিজ্ঞানের চর্চার বিষয়। সমাজবিজ্ঞানে এর চর্চা নেই, তা সম্ভবপর নয় এমন মনে করে সম্ভবত মাথা ঘামায়নি সমাজবিজ্ঞান। তবে ইতিহাসপন্থি কিংবা বিবর্তনবাদীদের মতে যেহেতু মানুষ বস্তুগত শক্তিরই বিকশিত প্রাণময়-মনোময় সত্তার জীব, সেহেতু পদার্থবিজ্ঞানের মতো গবেষণাগারে প্রমাণ করা না গেলেও শক্তির ক্রমবিকাশমান কার্যকরতাকে অস্বীকারের কোনো যুক্তি থাকে না। 

এবার আসা যাক-রাজনৈতিক ক্ষমতার কথায়। জনগণ নিজ নিজ শক্তির ক্ষমতা দিয়ে নেতৃত্বকে ক্ষমতাবান করে। ফলে নেতা জনগণের অর্পিত ক্ষমতার বলে রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় আটশ কোটি মানুষ দুইশ রাষ্ট্র গঠন করে রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করছে। সার্বভৌমত্বের বিবেচনায় সংবিধানমূলে দুইশ রাষ্ট্রের মালিকানা ভোগ করে আটশ কোটি মানুষ। যার অর্থ এই গ্রহটির মালিক মানুষ। 

অ্যারিস্টটলের কাল থেকে মানুষ জেনে এসেছে সে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। অন্যদের সঙ্গে দলবেঁধে সংঘশক্তি গড়ে তুলে পরস্পরের সহযোগিতার ভিত্তিতে সমাজবদ্ধভাবে অগ্রসর হয়। বিচ্ছিন্ন মানুষ শক্তিহীন। রাজনীতি পানিমিশ্রিত সিমেন্টের মতো মানুষকে শক্তির জোগান দিয়ে সংঘবদ্ধ-শক্তিশালী করে তোলে। আধুনিককালে সমাজসংস্থার উঁচুস্তরের সংস্থা হিসেবে রাষ্ট্র মানবজীবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার ফলে রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত কার্যাদিকে রাজনীতি হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে সমাজসংঘ নামক সংস্থাটির বিলোপ ঘটে যায়নি কখনোই। রাষ্ট্রীয় সংস্থা এবং ব্যক্তি পরিসরে জীবনের মাঝখানে সমাজকে অবলম্বন করেও মানুষ অনেক প্রয়োজন মিটিয়ে চলে। 

অর্থ সম্পদ অর্জনের চাহিদা

বলতে হয় মানুষ সবার আগে সাংস্কৃতিক সত্তার জীব এবং এই সংস্কৃতি বিকাশমান। তবে হাল আমলে মানুষের অর্থনৈতিক পরিচিতি অন্য সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ ক্রমাগত অর্থনামক বস্তুপিণ্ডে পর্যবসিত হতে চলেছে। ফলে সমাজবিজ্ঞান পাঠে মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবের সঙ্গে অর্থনৈতিক জীব-এই অভিধাও যুক্ত করতে হবে বলে মনে হয়। শুধু তাই নয়। একান্ত অর্থঅনুগামী মানুষ ক্রমশ প্রযুক্তির হাতে বন্দিত্ব বরণ করে যন্ত্রমানবে রূপান্তরের পথে কিনা-আতঙ্কের সঙ্গে ভাবতে হয়। অবলীলায় নিজের অবস্থানে প্রযুক্তিকে অভিষিক্ত করে ফেলছে। যে ধারা চলছে তাতে এখন অ্যারিস্টটলের মানুষ সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব-এর সঙ্গে মানুষ অর্থনৈতিক জীব যুক্ত হওয়ার বাস্তবতার ধারাক্রমে সামনে প্রশ্ন উপস্থিত হবে এমন এক বাস্তবতা যখন মানুষ প্রযুক্তিগত জীব এ প্রশ্নও আসবে। 

সকল কথার গোড়ার কথা হলো মানুষ দেহ ও মনের সমন্বিত জৈবসত্তা। দেহ থেকে মনকে আলাদা করা অসম্ভব। দুটোই বিবর্তনের ফসল এবং অবিরাম পরিবর্তনের সারথি। দেহ চলে মনের তাগিদে আর মন চলে প্রকৃতির সঙ্গে দেহের নিরন্তর মিথস্ক্রিয়ার পরিণতিতে। মানবজগতে মানুষের দৈহিক অবয়ব এবং মন তত দিন ক্রিয়াশীল থাকবে যত দিন জাগতিক শক্তি দ্বারা পুষ্ট হতে পারবে। সেই শক্তিকে অতিক্রম করে গেলে বিলয়ের ভাগ্যবরণ অবশ্যম্ভাবী। এ ক্ষেত্রে দৈহিক স্থিত বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জাগতিক পরিবর্তনের এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে যখন মন তথা চিন্তার গণ্ডি প্রকৃতির জগৎ তথা প্রাকৃতিক বিবর্তন স্তরে পৌঁছায় তখন মানবজগৎ এবং প্রকৃতির জগতের মধ্যে সম্পর্কের এক নতুন ও অভিনব বাস্তবতা তৈরি হয়। এটা কি আমাদের শ্রী অরবিন্দের ‘অতিমানষ’ স্তর? কিংবা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর সেই ধারণার মতো ব্যাপার যেখানে তিনি মনে করেন জীবের মধ্যে যেমন চেতনা রয়েছে, জড়ের মধ্যেও তেমনি রয়েছে প্রচ্ছন্ন হয়ে। তিনি বলেন, ‘জীব ও জড়ের মধ্যে যে প্রাণধর্মের লীলা চলছে, কোথাও তার ছেদ নেই। একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর কাছে লেখা এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র এবং মাটি, পাথর, জল সমস্তের সঙ্গে একসঙ্গে আছি এই কথাটা এক শুভ মুহূর্তে যখন আমার মনের মধ্যে স্পষ্ট সুরে বাজে তখন বিপুল অস্তিত্বের নিবিড় হর্ষে-আমার দেহমন পুলকিত হইয়া উঠে। ইহা আমার কবিতা নহে, ইহা আমার স্বভাব। এই স্বভাব হইতেই আমি কবিতা লিখিয়াছি, গান লিখিয়াছি।’ এই যে স্বভাব রক্ত মাংসের দেহমনের রবীন্দ্রনাথ অর্জন করেছিলেন তা স্পষ্টতই মানবজগৎ ও বিশ্বজগতে মিলন মোহনায় উপস্থিত হয়ে। মহামানবগণ, মুনি-ঋষি-দার্শনিকগণ, বিজ্ঞানী-কবিগণ-এরা অর্জন করতে সক্ষম হন। এটি সাধারণ চিন্তার বিষয় নয়; কিন্তু এই অসাধারণত্ব কোনো অলৌকিক ব্যাপার নয়, বিবর্তনেরই অনুক্রম ব্যাপার। 

বিকাশের এই ধারায় রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করে মানুষ আজ কোন স্তরে পৌঁছেছে তা আমরা বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ জীবন দিয়ে দেখছি। সমগ্র পৃথিবীজুড়েই মানুষ রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারী। রাজনীতি যেখানে জনগণের শক্তির ব্যাপার সেখানে সেই শক্তিকে হরণে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গায়ের শক্তি, অর্থের শক্তি, অস্ত্রের শক্তি এবং ধর্মের শক্তি। রাষ্ট্রের সংজ্ঞায় ‘জনগণ’কে ক্ষমতাবান করার কথা আছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অছিলায় নামকাওয়াস্তে জনগণকে রাষ্ট্রসমূহের সাংবিধানিক দলিলে মালিক বানানো হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কেবল মানুষ থাকে না এবং মানুষ আকাশ থেকে এই ভূখণ্ডে নাজিল হয়নি। মাটি, পানি, আলো, বাতাস-এসবের নিয়ত মিথস্ক্রিয়ায় শক্তির নিরন্তর বিবর্তনের ধারায় মানুষ সৃষ্টি হয়ে কোনো ভূখণ্ডে অন্যান্য প্রজাতি নির্বিশেষে সকল কিছুরই মতো স্থিত হয়। সংঘবদ্ধ হয়ে-সমাজ সংগঠন ইত্যাদি তৈরি করে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বসবাস করে। এই সহযোগিতার পরিবেশ বা পারস্পরিকতা কেবল মানুষের মধ্যে তা কিন্তু নয়। মানুষের সঙ্গে মানুষের সহযোগিতার পাশাপাশি চতুষ্পার্শ্বে পরিবেষ্টিত পরিবেশ ছাড়াও মানবজীবন অচল। কাজেই মাটি, পানি, আলো. বাতাস, নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়-পর্বত, উদ্ভিদরাজিসহ অন্যান্য প্রজাতি সহযোগে গঠিত দেশকে নিয়ে রাষ্ট্রে উন্নীত করলে মানুষ একক মালিক হয়ে যাবে কোন যুক্তিতে? অগ্রগামী চেতনা অর্জনের জোরে, সংগঠিত শক্তির জোরে মালিক হয়ে যাওয়া যায়-মানুষ আমরা করছিও তাই। কিন্তু প্রকৃত ন্যায়বিচারের বিবেচনায় তা অন্যায় বলে গণ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রকৃতির চোখে তা আধিপত্যবাদিতা-স্বেচ্ছাচারিতা যা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

প্রতিটি রাষ্ট্র আজ স্বৈরাচারকবলিত। জনগণ ক্ষমতার মালিক এ কথা অসার হয়ে পড়েছে। রাজনীতি হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং তা ধরে রাখার কৌশল। দেশকে রাষ্ট্র বানানোর সময় মানুষ প্রকৃতির অন্য সবকিছুকে বঞ্চিত করে কারচুপির আশ্রয় নিয়ে একক মালিক বনে নিজে সার্বভৌমত্বের অধিকারী হয়ে গিয়েছিল বিষয়টাকে আরও পরিষ্কার বুঝতে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের শক্তির নীতিতে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। মানুষ প্রকৃতিতে শক্তির অংশ। শক্তির ভারসাম্যের নীতিতে আধিপত্যের কোনো অবকাশ আছে কি? বরং বলা যায় লালিত্যের-পরস্পর ভালোবাসার-গলাগলির বন্ধনের সম্পর্ক রয়েছে। রাজনীতির-রাষ্ট্রগঠন সেই ধারার ব্যতিক্রম কিছু হওয়া প্রকৃতির চোখে অর্থাৎ বিবর্তনের শাশ্বত নিয়মে অন্যায়। কিন্তু মানুষ প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করে ভূখণ্ডের সকল অন্যবিধ সত্তার অধিকারকে শুধু পদদলিত নয়; কার্যত অস্বীকার করে একক মালিকানার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অর্থাৎ জগৎবিধান করে নিয়েছে। এই অন্যায়কে রীতিসিদ্ধ ও শিরোধার্য করে প্রকৃতির সমাজ থেকে আলাদা মানব জগৎ সৃষ্টিতে মানুষের জীবন ভালো চলবে না-এটাই ছিল অবধারিত। 

এটাই মানুষের আদিপাপ। এই পাপকে ধারণ করে ক্ষমতার যথেচ্ছাচার করে আজকে মানবজাতি বিকাশের ক্ষেত্রে অচলায়তনে আটকা পড়েছে। 

সৃষ্টিকর্তার সার্বভৌমত্বের বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করে দুনিয়ার সব কিছুকেই মানুষের ভোগদখলের জন্য সৃষ্টি করেছে সৃষ্টিকর্তা। ফলে তাদের কাছে প্রকৃতির সবকিছুকে ভোগ করার ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়ের কোনো প্রশ্ন নেই। অন্যদিকে মানুষের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী যুক্তিবাদীরাও প্রকৃতির উপর অত্যাচারকে অন্যায় কর্ম বলে মনে করে না। তাদের মনে এবং কাজের ধারায় এমন ধারণা বদ্ধমূল যে দুনিয়াটা মানুষের জন্যই প্রকৃতি সৃষ্টি করেছে এবং সে কারণে মানুষের প্রয়োজনে যা ইচ্ছা তা করা ন্যায়সঙ্গত। অর্থাৎ প্রকৃতির উপর অন্যায়-অত্যাচার ও জবরদখল করার ক্ষেত্রে উভয় মতাবলম্বীরাই ঐকমত্য পোষণ করে। আজকে যখন দুনিয়া মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে অনুপযোগী হয়ে পড়ছে তখন মানবজাতির মনে বিদ্যমান ধারণার পরিবর্তন করা আবশ্যক। প্রকৃতিতে অন্যায্য প্রভুত্ব করাই আদিপাপ। এ বোধোদয় যত তাড়াতাড়ি হবে ততই মঙ্গল।


লেখক- আহ্বায়ক
বাংলাদেশ জাগরণী শান্তিসংঘ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //