সাংবাদিক দমনের শেষ কোথায়

বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকতাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা বললে অত্যুক্তি হবে না। গত মে মাসে ইসরায়েলের পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভিযানে প্রতিবেদন করার সময় আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আখলেহ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। এটাকে বিশ্ব একটা হত্যাকাণ্ড হিসেবে দাবি করে। এবং এই হত্যাকাণ্ড আবারও প্রমাণ করে সাংবাদিকতা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ।

বলাই বাহুল্য এরকম ঝুঁকির বড় একটা অংশ বহন করেন বাংলাদেশের বস্তুনিষ্ঠ, সাহসী সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকেরা। 

বাংলাদেশে সাধারণভাবে মতপ্রকাশের উপর, বিশেষ করে সাংবাদিকদের উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনের অভাব নেই। প্রচলিত ফৌজদারি আইনের কথা বাদ দিলেও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮ যে কালাকানুনের মতো চেপে বসেছে, তা কারও অজানা নয়। সাংবাদিকেরা হরহামেশাই অভিযুক্ত হচ্ছেন, আটক হচ্ছেন। 

এর উপরে নতুন আইনের কথা শোনা যায় ১৪ জুন রাজশাহীতে। সাংবাদিকদের জন্য আয়োজিত এক কর্মশালায় বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, সাংবাদিকেরা অন্যায় করলে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রেখে একটি আইন হচ্ছে। আইনের খসড়া এখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আছে। সংসদের আগামী অধিবেশনেই তা পাস হতে পারে। তিনি অবশ্য এ ধরনের নমনীয় শাস্তিতে সন্তুষ্ট নন। তার কথা অনুযায়ী, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে এক দিনের জেলের পক্ষপাতী। জেলে গেলে তার মনে হবে যে আমার কাজটা অন্যায় হয়েছিল। আর করা যাবে না।’ (প্রথম আলো, ১৪ জুন ২০২২)

প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নতুন আইন হচ্ছে বলার এক দিন পর তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘নতুন আইন হচ্ছে না।’ তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্রেস কাউন্সিল আইনের সংশোধন করার বিষয় সরকারের বিবেচনায় আছে। (সমকাল, ১৫ জুন ২০২২)

তবে তারও আগে (১০ এপ্রিল, ডেইলি স্টার) তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার ক্ষমতা পাচ্ছে প্রেস কাউন্সিল। বর্তমান প্রেস কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এ সংশোধনের উদ্যোগ শুধু সমর্থন করেছেন তা-ই নয়, তিনি জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কাউন্সিলের আগের কমিটিগুলোতেও আলোচনা হয়েছে।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হানিকর বা বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধিমালার পরিপন্থী কোনো সংবাদ, প্রতিবেদন, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি প্রকাশের দায়ে কাউন্সিল কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিতভাবে অপরাধ আমলে নিতে পারবে। সব রকমের প্রিন্ট ও ডিজিটাল গণমাধ্যম এর আওতায় পড়বে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেছেন, কার্টুন, প্রিন্ট বা ডিজিটাল গণমাধ্যমে দিলে সেটা যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু হয়, তাহলে সেটি অপরাধ হবে। 

যদিও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কী হানিকর বা পরিপন্থী, তার কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা খসড়া প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। 

সাংবাদিক কামাল আহমেদের মতে, ‘সাংবাদিকদের দণ্ড প্রদানসহ প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি হঠাৎ কিছু নয়, বরং পরিকল্পিত এবং পরিকল্পনাটি অনেক দিনের। সরকারসমর্থক সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এ উদ্যোগের সক্রিয় অংশীজন এবং তারা নিশ্চিতভাবে আস্থা রাখেন যে কাউন্সিলের বাকি সদস্যরাও তাদের সঙ্গে একমত পোষণ করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আলী রিয়াজের ভাষ্য মতে, যেসব আইন আছে এবং আইনের বাইরেও যা ঘটছে, তাতে সরকার সন্তুষ্ট নয়; আরও নতুন আইন করার কৌশল চলছে। নতুন আইন হোক কিংবা প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করেই হোক- নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কেবল সেটাই হবে, তা নয়। ইতোমধ্যে উপাত্ত সুরক্ষা আইন, বিটিআরসির প্রবিধান এবং ওটিটি নীতিমালা তৈরি হচ্ছে। এগুলোর লক্ষ্য একটাই- নাগরিকের কথা বলার জায়গা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া।

প্রেস কাউন্সিলের ধারণাটি এসেছে মূলত সংবাদপত্রের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংরক্ষণের তাগিদ থেকে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার লক্ষ্যে সরকার যাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে কারণেই নিজেদের নীতি-নৈতিকতা ও জবাবদিহির একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হিসেবে এই সাংবাদিকেরাই প্রেস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যেখানে সব দল-মতের সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ থাকবে। তবে বর্তমান প্রেস কাউন্সিলে গণতন্ত্রের কোনো প্রতিফলন ঘটার কোনো অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধিরাই এখানে মূল ভূমিকা পালন করেন, সুতরাং কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব গণতান্ত্রিকভাবে অনুমোদিত হবে, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। 

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই খর্ব এখন। গণমাধ্যমগুলো মূলত পুঁজিপতিদের এক ধরনের এক্সিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে। তাই বড় বড় করপোরেট কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করে থাকে। 

করপোরেটোক্রেসির যুগে গণমাধ্যম মূলত একটা ব্যবসায়িক মডেল। অন্য আর দশটা ভোগ্যপণ্যের মতো। গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা থাকলেও এখন যেন সে কথা আর খাটে না। মূলত জনগণের অনুশাসন চলে গেছে করপোরেট শ্রেণির হাতে। গণতন্ত্রের খোল-নলচেও পাল্টে গেছে। গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় যখন পরিবর্তন আসে, তখন করপোরেট অনুশাসনে চলা গণমাধ্যম আর কতটা চতুর্থ স্তম্ভের দায়-দায়িত্ব পালন করতে পারে সে ক্ষেত্রে সন্দেহ রয়েই যায়।

তাই তো রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকগণ পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে হচ্ছেন নির্যাতিত। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগীয় শহর কিংবা মফস্বল সর্বত্রই চলে সাংবাদিক নির্যাতন। স্থানীয় প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা বা সদস্য, সবার বিরুদ্ধেই বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। লোকচক্ষুর অন্তরালে তুলে নিয়ে নির্যাতন থেকে শুরু করে প্রকাশ্য দিবালোকে জনসমক্ষে মারধরের শিকার হচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। হত্যা ও নির্যাতনের অগুনতি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে; বিচারের কোনো অগ্রগতি নেই। বিচার না করায় দেশে এখন সাংবাদিক নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের পরিসংখ্যান দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার দীর্ঘ ৯ বছর পার হলেও এখনো হত্যারহস্য উদ্ঘাটন করা হয়নি।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল, চোখ ও মুখ বাঁধা অবস্থায় নিখোঁজ ছিলেন ৫৩ দিন। খোঁজ পাওয়ার পর কারাগারে ছিলেন সাত মাস। সাংবাদিক গোলাম সরোয়ারকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পুলিশ উদ্ধার করে সীতাকুণ্ড থেকে। সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। 

এভাবে গত দেড় দশকে নির্যাতন ছাড়াও বাংলাদেশে সাংবাদিক নিহত হয়েছেন ২৩ জন। এর মধ্যে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে নিহতের সংখ্যা ১৪, আহত হয়েছেন ৫৬১ জন সাংবাদিক। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ৯ বছরে খুন হন ৯ জন সাংবাদিক। আর নির্যাতনের কথা বাদ দিলেও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হচ্ছেন সাংবাদিকরা। যার কারণে বস্তুনিষ্ঠ স্বাধীন সাংবাদিকতার ধারণাটাই বদলে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার সস্তা রগড় আর পেজ থ্রির বিনোদন সংবাদ কখনো কখনো হয়ে উঠছে মূলধারার গণমাধ্যমের লিড নিউজ। সত্য ঢাকা পড়ে যাচ্ছে অতলে। আর তাই তো রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে এক বছরে এক ধাক্কায় ১০ ধাপ নেমেছে- ১৫২ থেকে ১৬২, স্কোর নেমে হয়েছে ৫০ দশমিক ২৯ থেকে ৩৬ দশমিক ৬৩।

এমন সময়ে প্রেস কাউন্সিলের প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো মোটেও সামান্য কিছু নয়। এটা মতপ্রকাশের টুঁটি চেপে ধরার একটা কৌশল মাত্র। গঠনের পর থেকে প্রেস কাউন্সিলের ইতিহাসে প্রকাশিত খবরের জন্য সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে কেউ কাউন্সিলের শরণাপন্ন হয়ে বিচার চাইলে সালিশ ছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সুরক্ষায় তারা আজ পর্যন্ত আর কোনো ভূমিকা নিয়েছে বলে রেকর্ড নেই। 

তাছাড়া আদালত ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা রাখে কিনা, সেটিও একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন। 

তথাপি আইনের সংশোধন ও নতুন নীতিমালার প্রস্তাব যখন আসছে, তখন তা বাস্তবায়নও সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে ক্ষমতাসীন দল, সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ফারাক যেখানে অনেক আগেই একাকার হয়ে গেছে, সেখানে এই বিধান সংযোজন স্বাধীন সংবাদ ও মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে সন্দেহ নেই।


লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //