অভিবাসনে আনাড়ি নারী

কেউ ভালো পরিবেশে বসবাস বা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমালে তাকে সাধারণ অর্থে প্রবাসী বলা হয় । কেউ বসবাস, অর্থ উপার্জন বা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে এক বছরের বেশি সময় থাকলে তাকে অভিবাসী বলা হয়।

সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসন বিষয়ক কেন্দ্রের শিক্ষক শার্লট টাইলরের গবেষণার বিষয় এটিই। তাঁর মতে, “অভিবাসী যথেষ্ট নিরাপদ একটি পরিভাষা। এমন নয় যে এটি ভবিষ্যতেও নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে বর্তমানে এটি বেশ নিরাপদ একটি পরিভাষা।”

তবে রাজনৈতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। ব্যক্তি যখন বিশেষ কোনো শাসনাবস্থা থেকে দূরে যেতে চায়, তখন এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। একটি দেশে ক্রমাগত অভিবাসীদের আগমন হতে থাকলে যখন সেই সংক্রান্ত খবরে বা লেখায় ‘ঢল’, ‘জোয়ার’ বা ‘বন্যা’র মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়, তখন অভিবাসীদের সঙ্গে ‘অমানবিক’ আচরণ করা হয় বলে মনে করেন টাইলর। কারণ এরকম শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে অভিবাসীদের ‘পণ্য’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় বলে মনে করেন তিনি। 

সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশের নারীরাও অভিবাসীর খাতায় নাম লিখিয়েছেন অনেক দিন আগে। কিন্তু তাঁদের হালফিলের চিত্র সুখকর নয়। সারাবিশ্বে যত প্রবাসী বাংলাদেশি বসবাস করেন তাঁদের সিংহভাগই মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ২৮ লক্ষ প্রবাসী বাংলাদেশির অর্ধেক সৌদি আরব এবং চার ভাগের এক ভাগ আরব আমিরাতে বসবাস করেন। বাংলাদেশিরা সাধারণত টেকনিশিয়ান, গৃহস্থালি কর্মী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যায়। এছাড়া বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার এবং চিকিৎসক রয়েছে। 

বর্তমানে সৌদি আরবে ২০ লক্ষেরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন। বাংলাদেশ সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক জোগান দেয়। সৌদি আরবে ২০০৭ সালে ১৫ লক্ষ ভিসার মধ্যে প্রায় ২৩.৫০ শতাংশ ভিসা বাংলাদেশিদের দেওয়া হয়। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ মিলিয়নেরও বেশি বাংলাদেশি সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৮০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি কাতারে বসবাস করে। 

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো বিএমইটি তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ২০১৬ সালের মার্চ পর্যন্ত ৫ লাখ ৫ হাজার ৪৭ জন বাংলাদেশি গেছেন কুয়েতে। এর মধ্যে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত গড়ে প্রতিবছর ১০ হাজার লোক কুয়েতে গেছেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের সুনাম বেড়ে যায়। এরপর ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত গড়ে ২৫ হাজার লোক দেশটিতে গেছেন। ২০০১ সালের পর তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে এবং প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার লোক কুয়েতে যেতে থাকেন। যদিও ২০০৭ সালের শেষে বাজারটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০০৮ সালে মাত্র ৩১৯ জন, ২০১০ সালে ৪৮ জন, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে মাত্র ২ জন ও ২০১৩ সালে ৬ জন কর্মী যান দেশটিতে। 

২০১৪ সালের শেষ দিক থেকে আবারও কর্মী যাওয়া শুরু করে। গত বছর ১৭ হাজার ৪৭২ জন কর্মী গেছেন দেশটিতে। জনশক্তি রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২০০৫ সালেও ৪৭ হাজার কর্মী গেছেন দেশটিতে। বাজার পুরোপুরি চালু হলে বছরে ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মীর কর্মসংস্থান হতে পারে। 

ওমানে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪.৬ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, ওমানের মাটিতে বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সুনামেও তারা সবার শীর্ষে। ফলে অন্য যে কোনো দেশের শ্রমিকদের তুলনায় ওমানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের রয়েছে বিশেষ চাহিদা। 

সবশেষ ‘ন্যাশনাল সেন্টার অ্যান্ড ইনফরমেশন’-এর (এনসিএসআই) তথ্য মতে, ডিসেম্বর, ২০১৬-এর শেষের হিসাব অনুযায়ী ওমানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮১ জন। 

অভিবাসনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টাকার লোভে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালেরা বিভিন্ন জালিয়াতি করে নারী কর্মীদের বিদেশে পাঠায়। তাই নারী কর্মীকে পদে পদে হয়রানি হতে হয়। রিক্রুটিং এজেন্সি গড়ে দালালদের কর্মী প্রতি ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দেয়। 

জানা যায়, বিদেশ যাওয়ার পর নারীকর্মীরা কোনো নজরদারির মধ্যে থাকে না। তাই তাঁরা নির্যাতন বা নিপীড়ন নিয়ে কাউকে অভিযোগও করতে পারেন না। দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীরাও সামাজিক, আর্থিক চাপে মানসিক পীড়নের মধ্যে আছেন। শিক্ষার অভাব, তথ্যের ঘাটতি, দক্ষতার অভাবে তাঁরা কোনো কাজে জড়াতে পারছেন না। নিয়োগকারীরা তাদের দিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করান। কোনো রকম ছুটি দেওয়া হয় না এমন ক্ষেত্রও আছে। শারীরিক বিশেষত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন অনেকে। আবার দেশেও তাদের চরিত্রহীন গণ্য করে অনেকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামীদের অবহেলার ও তালাকের শিকার হন একটি বড় অংশ। 

সরকারিভাবে ঋণে নারীদের সুযোগ থাকলেও তা নিতে পারছেন না। নারীদের আলাদা করে প্রশিক্ষণ দরকার। নাজমা আক্তার নামের বিদেশ ফেরত এক গৃহকর্মী গণমাধ্যমকে বলেন, দুটি সন্তান নিয়ে চরম অশান্তির মধ্যে আছি। মাঝে না খেয়েও ছিলাম কয়েক দিন। এখন বাঁচতেও পারছি না, মরতেও পারছি না

এদিকে নারী শ্রমিক কেন্দ্র বলছে, বিদেশে যাওয়া নারীদের একটি বড় অংশ তালাকপ্রাপ্ত। দেশে ফিরে কোনো কাজ নেই, ছোট বাচ্চার খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। দেশে-বিদেশেও কোথাও শান্তি নেই প্রবাসী নারী কর্মীর। 

বমসার পরিচালক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, নারীকর্মী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা আছে। সমাজের মানসিকতা বদলাতে হবে। তাঁদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, শিক্ষার সনদ দিতে হবে। প্রবাসী নারীদের আয় আলাদা করে দেখানো দরকার। এতে অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান স্পষ্ট হবে। 

বিদেশফেরত কর্মীদের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ চালু করেছে সরকার। এ ছাড়া আরও ৫০০ কোটি টাকা পুনর্বাসন ঋণ বরাদ্দ হয়েছে। বিএমইটির মহাপরিচালক মো. শামছুল আলম বলেন, ফিরে আসা কর্মীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদা করে কোনো প্রকল্প নেই। তবে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। 

তবে নারী শ্রমিক কেন্দ্র ও অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন বলছে, নারীরা যথাযথ তথ্য প্রাপ্তি থেকে অনেক পিছিয়ে থাকে। তাই ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের উপস্থিতি কম। নারীদের বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ঋণের আবেদন করতে সহায়তা দিচ্ছে নারী শ্রমিক কেন্দ্র। সৌদি আরব থেকে ফেরা সিলেটের সাহেরা খাতুন বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর ভাগ্য ফেরাতে সৌদি আরব যান। ১৬ মাস ছিলেন। নিয়োগকর্তার আয় না থাকায় চার মাসের বেতন না দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গত মার্চে ফিরলেও কোনো কাজ পাননি। পুনর্বাসন ঋণের বিষয়ে জানা নেই তাঁর। 

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচি বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত চার বছরে ৪১০ নারী কর্মীর লাশ এসেছে দেশে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবে মারা গেছেন ১৫৩ জন। আর গত বছরের প্রথম ৯ মাসে দেশে এসেছে ৬৩ প্রবাসী নারীর লাশ, যার মধ্যে সৌদি থেকে এসেছে ২২টি। দেশে আসা লাশের ১৪টির ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে ‘আত্মহত্যা’। এর মধ্যে ৮ নারী কর্মীর লাশ এসেছে সৌদি আরব থেকে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সন্দেহ, এগুলো আত্মহত্যা নয়। এসব বিষয়ের সুষ্ঠু প্রতিকারসহ যাঁরা ফিরে আসবেন বিদেশ থেকে তাদের ঋণ সুবিধাসহ অন্যান্য সরকারি সুবিধার আওতাভুক্ত রাখা আশু প্রয়োজন। 

নারীদের দক্ষতা  বৃদ্ধিসহ কর্মস্থলে তাঁদের নিরাপত্তার দেখভাল করা সরকারের উপর বর্তায়। প্রবাসে তারা যে বিভিন্ন অন্যায়ের শিকার হন বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহকে এ ব্যাপারে কড়া নজরদারি ও নারীকর্মীদের জন্য সহায়তার হাত প্রশস্ত করতে হবে। নারী কেন আনাড়ি হয়ে থাকবেন? বিদেশ থেকে তিনিও যথাযথ উপার্জন ও রেমিট্যান্স প্রেরণে সক্ষমতা অর্জনে অবশ্যই সক্ষম হবেন। সেভাবে তাদের প্রস্তুত করে তবেই বিদেশে কাজে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //