বিচারবান্ধব পারিবারিক আদালতের প্রত্যাশা

গত ৩ জুলাই জেনারেল এরশাদের শাসনামলের সব সামরিক আইন, প্রবিধান ও আদেশ বাতিল ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় বাস্তবায়নের জন্য খসড়া পারিবারিক আদালত আইন, ২০২২ অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।

বর্তমানে প্রচলিত পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ জেনারেল এরশাদের শাসনামলে প্রণীত হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিশ্চিত করেছেন যে, প্রস্তাবিত আইনে নামমাত্র পরিবর্তন হয়েছে। খসড়া আইনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আছে মাত্র দুটি; এখন থেকে জেলা জজ পদমর্যাদাসম্পন্ন সকল বিচারক পারিবারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আপিল নিষ্পত্তি করতে পারবেন এবং পারিবারিক মোকদ্দমায় পূর্বের কোর্ট ফি ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০০ টাকা করার প্রস্তাব হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনে এই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন অধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞদের হতাশ করেছে। বিচারবান্ধব পারিবারিক আদালত গঠনে বিদ্যমান পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশে আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। প্রচলিত পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ স্পষ্টতই পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং এই আইনের ফলে পারিবারিক মামলা হ্রাস না পেয়ে জটিল ও একই ঘটনা নিয়ে বর্তমানে বহুবিধ মামলার উদ্ভব হচ্ছে। সরকার যেহেতু বর্তমান প্রচলিত আইনটি বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে, তাই সংসদে খসড়া আইনটি চূড়ান্ত করার পূর্বে এর পুনর্মূল্যায়ন দরকার।

পারিবারিক আদালতের রায়ের সামাজিক প্রভাব শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পারিবারিক বিষয়াবলির জন্য একটি পৃথক বিশেষ আদালত গঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে কম খরচে এবং স্বল্প আনুষ্ঠানিকতায় দ্রুত পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে প্রচলিত ও প্রস্তাবিত উভয় আইনেই বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত করার নানাবিধ উপাদান উপস্থিত।

খসড়া আইনে পারিবার বা পারিবারিক বিষয় বলতে কী বোঝায় তার কোনো সংজ্ঞা প্রদান করা হয়নি। আইনে কেবল বিবাহবিচ্ছেদ, দেনমোহর, ভরণপোষণ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার এবং অভিভাবকত্ব ও নাবালকের হেফাজতের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতের এক্সক্লুসিভ এখতিয়ার নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে অন্যান্য পারিবারিক বিষয় যেমন বিবাহের বৈধতা, দত্তক নেওয়া, নারী নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, পিতামাতার ভরণপোষণ, সন্তানের বৈধতা, সম্পত্তি বণ্টন, ব্যভিচার প্রভৃতি পারিবারিক বিষয় হিসেবে আইনে উপেক্ষিত রয়েছে এবং এগুলোর জন্য আলাদাভাবে বিচার চাইতে বিচারপ্রার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন আদালতে বহুবিধ মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করতে হচ্ছে। একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, পারিবারিক আদালত কোনো সাধারণ আদালত নয় বরং এটি ব্যক্তিগত, ধর্মীয়, পারিবারিক, সন্তানের মঙ্গল এবং মোকদ্দমা দায়েরকারী পক্ষসমূহের আবেগ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে কাজ করে। 

পারিবারিক বিষয় নিয়ে বিরোধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আদালতে না যেয়ে বিচারপ্রার্থী জনগণের এক জায়গায় বিচার পাওয়া উচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, বিচারপ্রার্থী ব্যক্তি পারিবারিক বিষয়ে একাধিক আদালতে একাধিক মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করছেন। যেমন বিবাহবিচ্ছেদ, দেনমোহর এবং স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণের জন্য পারিবারিক আদালতে এবং যৌতুকের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি ফৌজদারি মামলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে দায়ের হচ্ছে। আবার পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতকে এ বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নির্ধারণ করেছে।

কখনো কখনো দেখা যাচ্ছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পারিবারিক আদালতে ন্যায়বিচার না পেয়ে নতুন করে মামলা দায়ের করছে। আবার স্ত্রী পারিবারিক আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করার পর মাঝেমধ্যে স্বামী দেওয়ানি আদালতে নিকাহনামা তার উপর বাধ্যকরী নয় মর্মে ঘোষণামূলক মোকদ্দমা দায়ের করছে। যদি পারিবারিক আদালতকে একটি ভিন্ন আঙ্গিকের আদালত বিবেচনা করে একই সঙ্গে দেওয়ানি ও ফৌজদারি এখতিয়ার দেয়া হতো এবং পারিবারিক সকল বিষয় তার এখতিয়ারর্ভুক্ত করে একই কক্ষে সকল বিষয় বিচার করার ক্ষমতা দেয় যেত, তাহলে বিচারপ্রার্থী জনগণ স্বল্প সময়ে ওয়ান স্টপ সেবা পেত, যাতে মামলা পরিচালনার সময় ও ব্যয়ও কমে আসত।

পূর্বে আইনাঙ্গনে একটি বিতর্ক ছিল যে পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ কেবল মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য প্রযোজ্য কিনা?  যদিও উচ্চ আদালত পঁচন ঋষি দাস বনাম খুকু রানী দাসি ও অন্যান্য, ৫০ ডিএলআর (হাই কোর্ট ডিভিশন) ৪৭ (১৯৯৮) মামলায় এ বিষয়টি স্পষ্ট করেন যে সমস্ত নাগরিক তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নির্বিশেষে পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাইতে পারবে। তবে নতুন আইনে এ বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া উচিত ছিল। 

পারিবারিক আদালতের বিচারক নিয়োগ নিয়েও আইনে সমস্যা রয়েছে। আইনে সকল সহকারী জজ আদালতকে পারিবারিক আদালত এবং সকল সহকারী জজকে পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পেশায় তরুণ সহকারী জজদের পারিবারিক বিষয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয় পরিচালনা করার মতো যথেষ্ট পরিপক্বতা এবং অভিজ্ঞতা থাকে না। সুতরাং নতুন আইনে পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসাবে আরও জ্যেষ্ঠ ও অভিজ্ঞ বিচারকদের বিবেচনা করা যেতে পারে। ভারতে পারিবারিক বিষয়াবলি বিচার করার জন্য বিচারকের ন্যূনতম সাত বছরের বিচার বিভাগীয় কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। তাছাড়া বিদ্যমান ব্যবস্থায় সাধারণত পারিবারিক আদালতের আলাদা কক্ষ থাকে না এবং একই সহকারী জজ অন্যান্য দেওয়ানি বিষয় নিষ্পত্তি করার পাশাপাশি পারিবারিক বিরোধও বিচার করেন; যা একজন নবীন বিচারকের উপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং কখনো কখনো এর কারণে বিচার সম্পন্ন করতে বিলম্ব হয়।

অধিকন্তু পারিবারিক আদালতের বিচারকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। এ ধরনের বিরোধ সাধারণত বেশ জটিল পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং পারিবারিক আদালতের বিচারকদের এসব বিষয়ে নিবিড় এবং বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। এছাড়া আমাদের আদালতের কার্যক্রম সাধারণত নারী, ট্রান্সজেন্ডার এবং শিশুবান্ধব নয়। প্রস্তাবিত আইনে ডিজিটাল সাক্ষ্য গ্রহণ সংক্রান্ত বিধান সন্নিবেশিত করা হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোকদ্দমার পক্ষ এবং সাক্ষীরা (বিশেষত শিশুরা) আদালত কক্ষে আসতে ভীত ও বিচলিত হন; সেক্ষেত্রে ভিডিও লিঙ্ক ব্যবহার করে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা যেতে পারে।

বিদ্যমান পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশে দ্বিস্তর বিশিষ্ট বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। ফলে বিচারকদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আপস-মীমাংসা করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। নতুন আইনে কোনো পারিবারিক মোকদ্দমা প্রক্রিয়া শুরু করার আগেই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে এবং শুধুমাত্র প্রারম্ভিক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পক্ষ প্রতিকার পাওয়ার জন্য আদালতে আসতে পারে। ফলে অহেতুক অনেক মোকদ্দমার চাপ আদালত থেকে কমে যাবে। 

বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী সন্তানের হেফাজত পারিবারিক আদালতের একটি মুখ্য বিচার্য বিষয়। অতএব পারিবারিক আদালতে স্বল্প আনুষ্ঠানিকতা ও শঙ্কামুক্ত পরিবেশে শিশুদের শুনানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রয়োজনে বিচারক যেন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে শিশুর সঙ্গে আলাদাভাবে ও আন্তরিকতাপূর্ণ পরিবেশে কাউন্সিলরসহ কথা বলতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। উপরন্তু প্রাক-শুনানি এবং শুনানিপরবর্তী কার্যধারায় পক্ষগণের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। সম্প্রতি আমরা আমাদের উচ্চ আদালতে সন্তানের হেফাজত এবং নিয়মিত পরিদর্শনের অধিকারে আন্তঃদেশীয় উপাদানের উপস্থিতি দেখছি। এছাড়াও বাংলাদেশ অদ্যাবধি আন্তর্জাতিক শিশু অপহরণ বিষয়ক হেগ কনভেনশন ১৯৮০-এ স্বাক্ষর করে পক্ষভুক্ত হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য উক্ত কনভেনশনে অতি সত্বর পক্ষভুক্ত হওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। 

দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার সারা বিশ্বেই একটি বিতর্কিত বিষয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও এই প্রেক্ষাপটে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছে। কিছু রায় এটিকে সংবিধান পরিপন্থী ও বৈষম্যমূলক হিসেবে এবং কিছু মামলায় নিয়মিত ধর্মীয় বিষয় বিবেচনা করা হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত পারিবারিক আদালত আইন এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব এবং এ ধরনের বিচারের রায় কার্যকর করার কোনো পথ দেখানো হয়নি। খসড়া আইনের আরেকটি ফাঁক হলো মিথ্যা মামলা দায়েরের কারণে শাস্তির বিধান নেই। ফলে মিথ্যা মামলা দায়ের হলে আদালতের মূল্যবান সময় এবং প্রচেষ্টা অযথা নষ্ট হবে।

পারিবারিক আদালত আইনের আরও একটি ত্রুটি হলো এই আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার অভাব। পারিবারিক আদালত আইনে উক্ত আদালতের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার ঘাটতির কারণে ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার এবং বিবেক বোধের উপর ভিত্তি করে আদালতের সুবিবেচনামূলক ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বর্তমান আইনের অপর একটি ত্রুটি হলো আদালতের দেওয়া ডিক্রি কার্যকরে নানাবিধ বাধা। 

পরিশেষে এ কথা বলা যেতে পারে যে, বিদ্যমান পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ প্রণয়নের লক্ষ্যগুলো অর্জনে আইনটি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে এবং দুঃখজনকভাবে প্রস্তাবিত আইনটিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের আশার আলো দেখাতে পারছে না। পারিবারিক আদালত আইনটিকে বিচারপ্রার্থীদের জন্য বিচারবান্ধব ও প্রকৃতপক্ষে কার্যকর একটি আইন প্রণয়ন করার সুযোগ এখনো রয়েছে। সুতরাং সংসদে প্রস্তাবিত নতুন আইনটিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে এদেশে একটি প্রকৃত ন্যায়বিচারবান্ধব পারিবারিক আদালত গঠন করা হবে বলে প্রত্যাশা।


লেখক: সহকারী অধ্যাপক ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //