সড়কযাত্রা নিরাপদ হবে কবে

সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন যেদিন (৬ আগস্ট) তাদের প্রতিবেদনে জানায় যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত জুলাই মাসে ৬৩২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭৩৯ জন নিহত এবং দুই হাজার ৪২ জন আহত হয়েছেন, তার তিন দিন আগে ২ আগস্ট রাতে টাঙ্গাইলে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। একটি বাসে ডাকাতির সময় এক নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। সারাদেশে এ নিয়ে তোলপাড় চলছে। পুলিশ কয়েকজনকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত ২ আগস্ট রাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থেকে ঈগল পরিবহনের একটি বাস ৩০-৩৫ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। সিরাজগঞ্জ জেলার কাছাকাছি একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারের জন্য যাত্রা বিরতি করে। রাত ১২টার দিকে আবার যাত্রা শুরু করে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার পর যাত্রী বেশে থাকা ১০ থেকে ১৫ জন যুবক বাসটিতে থাকা যাত্রীদের হাত, পা বেঁধে তাদের কাছে থাকা টাকা, মূল্যবান গয়না, ফোন সবকিছু নিয়ে নেয়। এ সময় তারা এক নারী যাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। 

মো. হেকমত নামে ওই বাসের একজন যাত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডাকাতরা বাসের আলো নিভিয়ে দেয়। ফলে কী হচ্ছিল তা পুরো দেখতে না পেলেও শব্দ শুনে বুঝতে পারছিলেন বাসের পেছনের দিকে একজন নারীর উপর যৌন নির্যাতন চলছে। একটা মেয়ে বাসের পেছন থেকে কাকুতি-মিনতি করছিল। বলছিল আপনাদেরও বাড়িতে মা-বোন আছে। নানা কথা বলে সে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। ওই মেয়েটার প্রতি যে অত্যাচার হচ্ছে বুঝতে পারছি, কিন্তু কিছু করতে পারছি না, এটা ভেবে চোখ দিয়ে পানি চলে আসছিল।’ যতটুকু জানা যাচ্ছে তা হলো, ধর্ষণের শিকার নারী ওই বাসে একা ঢাকায় যাচ্ছিলেন পোশাক কারখানায় কাজ করবেন বলে।

লজ্জার বিষয় হলো, বাসের ভেতরে ৩০-৩৫ জন যাত্রী। সেখানে নিশ্চয়ই অনেক শক্ত সমর্থ পুরুষও ছিলেন। অথচ ছয়জন ডাকাত মিলে একজন নারীকে ধর্ষণ করল, সেই সব পুরুষের কারোরই কিছু করার ছিল না। বলা হচ্ছে, ডাকাতির সময় ওই তরুণী প্রতিবাদ করেছিলেন। ডাকাতরা সম্ভবত তাকে এই প্রতিবাদের শাস্তি দিয়েছে। গণমাধ্যমের খবর বলছে, শুধু এই তরুণী নন, আরও এক নারীকেও এ সময় নির্যাতন করেছে ডাকাতরা।

তবে বাসে ধর্ষণের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট এই টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপা নামে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পরে মধুপুর থানা পুলিশ রূপার মরদেহ উদ্ধার করে। এ নিয়ে তখন সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ২০১৮ সালে এই ঘটনায় চার আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং একজনের সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। গত বছরের ৭ নভেম্বর ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার সেকেন্ড গোলড়া এলাকায় চলন্ত বাসে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা হয়। এ সময় তিনি চলন্ত বাস থেকে লাফ দিয়ে মহাসড়কে ছিটকে পড়েন। এর আগে মে মাসে সাভারের আশুলিয়ায় চলন্ত বাসে এক তরুণীকে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করা হয়। ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিকেলে বাসে সিলেটের লামাকাজী থেকে দিরাইয়ে যাচ্ছিলেন এক কলেজছাত্রী। দিরাই পৌরসভার সুজানগর গ্রামের পাশে এসে সব যাত্রী নেমে গেলে ওই ছাত্রী একা হয়ে যান। এ সময় চালক ও হেলপার তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তিনিও তখন চলন্ত বাস থেকে লাফিয়ে পড়েন।

২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে সাভারের ধামরাইয়ে চলন্ত বাসে এক নারী শ্রমিককে ধর্ষণের পরে হত্যার অভিযোগ ওঠে বাসচালকের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের মে মাসে কিশোরগঞ্জের একটি বাসে একজন নার্সকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ওই ঘটনাটিও সারাদেশে আলোড়ন তোলে। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাভারেই চলন্ত বাসে ধর্ষণ চেষ্টার সময় গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যান এক নারী।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৮ সালে গণপরিবহনে ২১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যদিও এ ধরনের ঘটনার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। 

সবশেষ টাঙ্গাইলে যে ঘটনাটি ঘটল, এই ঘটনার দায় কার?

১. মাঝরাস্তায় যাত্রীবেশে কয়েক দফায় ডাকাতরা ওই গাড়িতে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ডাকাতি শুরুর আগে সবার মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। ফলে যাত্রীরা ৯৯৯ নম্বরেও ফোন করতে পারেননি।

২. এক সময় দূরপাল্লাার বাস ছাড়ার আগে বাস কর্তৃপক্ষ অথবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ভিডিও ক্যামেরায় সব যাত্রীর চেহারা ধারণ করতেন। চালকের আসনের পেছন বরাবর একটি লোহার গেট ছিল। বাস ছাড়ার সময় সেটি আটকে দেওয়া হতো যাত্রীদের আলাদা করে ফেলার জন্য। নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী নেওয়ারও সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই চর্চাগুলো এখন নেই কেন সেটি বিরাট প্রশ্ন।

৩. পরিবহন মালিকদের দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা, হেলপার ও সুপারভাইজারদের গাফিলতি ইত্যাদিকে দায়ী করা যায়। কিন্তু হাইওয়ে পুলিশ কি তার দায় এড়াতে পারে? মহাসড়কে চলাচলকারী বাসে তাদের কোনো নজরদারি আছে? অভিযোগ আছে, মহাসড়কে কোথায় কী ঘটছে কোনো কিছুই হাইওয়ে পুলিশের অজানা থাকে না। মহাসড়কে যেসব জায়গায় ডাকাতি হয়, সেসব স্থান চিহ্নিতই বলা চলে। কিন্তু শোনা যায়, হাইওয়ে পুলিশের বেশি নজর ট্রাকের দিকে। কারণ ট্রাক থেকে চাঁদা নেওয়া যায়।

যাত্রাপথের নিরাপত্তায় সরকার কী করছে?

১. সরকারের সবশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, একটি আধুনিক, নিরাপদ ও সমন্বিত সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো স্থাপনের লক্ষ্যে দেশের জাতীয় মহাসড়কগুলোতে ইনটেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম বা আইটিএস স্থাপনের জন্য কোরিয়ান সরকারের কোরিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সিসের সহায়তায় একটি প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন।

২. নিরাপদ সড়ক নেটওয়ার্ক বাস্তবায়নে UN Decade of Action for Road Safety 2011-2020 এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় বিভিন্ন কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।

৩. National Road Safety Strategic Action Plan-এর আলোকে টেকসই ও নিরাপদ মহাসড়ক গড়ে তোলার জন্য চারটি জাতীয় মহাসড়কের (ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর ও ঢাকা-খুলনা) পাশে পণ্যবাহী ট্রাকচালকদের জন্য পার্কিং সুবিধাসহ বিশ্রামাগার স্থাপন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

৪. বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের Bangladesh Road Safety Program প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়েছে, যার অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন। এ প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে- রোড সেফটি সেল, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত দুর্ঘটনা তথ্য কেন্দ্র, ডিজিটাল এনফোর্সমেন্ট সিস্টেম, রোড সেফটি কাজের স্ট্যান্ডার্ড, যানবাহন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ও চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, দুর্ঘটনা পরবর্তী সাড়াদান পদ্ধতি তৈরি, সড়ক নিরাপত্তার উপর গবেষণা ও উন্নয়নের ব্যবস্থা।

তার মানে সবই প্রক্রিয়াধীন। প্রসঙ্গত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর গত ৫১ বছরে যোগাযোগ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ হয়েছে সড়কে। অথচ সেই সড়কেই প্রাণহানি সবচেয়ে বেশি, সেই সড়কেই নারী তার সম্ভ্রম হারায়। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, বিনিয়োগ কি শুধু চার লেনের সড়ক আর সেতু নির্মাণের জন্য? একটি নারীবান্ধব ও নারীদের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত সড়ক এবং পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ কোথায়? পরিমাণ কত?

ব্যক্তি পর্যায়ে কী করণীয়?

১. বিবিসি বাংলা ২০১৯ সালের ৯ মে ‘গণপরিবহনে নারী : কীভাবে বুঝবেন যে বিপদের মুখোমুখি হতে পারেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে শাহনাজ পারভীন নামে এক নারী বলেন, নির্জন এলাকা দিয়ে চলার সময় বা একা নারী হিসেবে কোনো গণপরিবহনে চলাচল করার সময় চালক, সুপারভাইজার বা হেলপারের আচরণের দিকে সবসময় খেয়াল রাখলে নারীরা পরিবর্তনটা বুঝতে পারবেন। নিজের একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে মাশহুদা হক ইফা জানান, একবার বাসে একটি ঘটনার প্রতিবাদ করায় ওই বাসের চালক ও সহকারীর বিরূপ আচরণের শিকার হন তিনি।

২. নিরাপত্তার জন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান তৎপরতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নারীদের প্রতি চালক, হেলপার ও কন্ডাকটরকে সংবেদনশীল হতে হবে। নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করার বোধ জাগ্রত করতে হবে। এজন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, তাদের মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে।

৩. রাতের যাত্রায় নির্জন রাস্তায় যৌন হেনস্তার শিকার হওয়ার শঙ্কা বেশি। ফলে এ রকম রাস্তায় পারতপক্ষে নারীদের রাতের যাত্রা না করা ভালো।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //