চা শ্রমিকদের জীবনমান

দেশের ১৬৬টি চা বাগানের দেড় লাখের বেশি শ্রমিক দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে যে আন্দোলন শুরু করেছিল তার সমাপ্তি ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক নির্ধারিত ১৭০ টাকা মেনে নিয়ে চা শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিয়েছে। পাশাপাশি বার্ষিক ছুটি, উৎসব ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটির দিনসংখ্যাও বাড়বে। এছাড়াও ভর্তুকি মূল্যে রেশন সুবিধা এবং চিকিৎসা সুবিধা বাড়ানো হবে। শ্রমিকেরা আন্দোলনে থাকাকালীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রী যা সিদ্ধান্ত দেবেন তারা তা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নেবে। ইতিপূর্বে মজুরি বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা করার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা সাধারণ শ্রমিকেরা প্রত্যাখ্যান করে। বর্ধিত মজুরি ১৭০ টাকাও আমাদের কাছে খুব কম মনে হয়। তবে ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, কেনিয়া প্রভৃতি দেশেও চা শ্রমিকদের মজুরি তুলনামূলক বিচারে কম। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একজন চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ২৩২ রুপি বা ২৭৭ টাকা, তবে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার তথ্য না থাকায় অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করা সঠিক হবে না। চা শ্রমিকদের জীবনমান আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে তুলনা করলেও কোনো মিল পাওয়া যাবে না। কারণ ব্রিটিশেরা এদের ধরে এনেছে পাহাড়-পর্বত-জঙ্গল থেকে; ধরে আনা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে বহু বিভাজন, ভাষাও আলাদা আলাদা। 

ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমলের শুরুতে একজন পুরুষ শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল এক টাকা দুই আনা, নারী শ্রমিকের ছিল এক টাকা এক আনা। পরে তা বাড়িয়ে করা হয় পাঁচ টাকা। ১৯৬১ সালে পুরুষ এবং নারী শ্রমিক পেত যথাক্রমে ৪৯.৭০ টাকা এবং ৪৬.৫৩ টাকা। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই পারস্পরিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে এ যাবৎ নির্দিষ্ট হারে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। শ্রমিকদের সংগঠন এবং বাগান মালিকদের সংগঠনের মধ্যে প্রতি দুই বছর অন্তর মজুরি বৃদ্ধি নিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হয় এবং প্রতিবার ১০-১৫ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করে চুক্তি হয়ে আসছে। সর্বশেষ সম্পাদিত চুক্তির মেয়াদ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যায়; চুক্তি শেষ হওয়ার পর থেকেই শ্রমিকেরা ৩০০ টাকা মজুরির দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়। এত বেশি মজুরি বৃদ্ধির দাবি আগে কখনো করা হয়নি। ২০২০ সালে সম্পাদিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে মজুরি ১৮ টাকা বৃদ্ধি করে ১০২ টাকা থেকে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়। অতীতে যে হারে মজুরি বেড়েছে তার ধারাবাহিকতায় ২০২১-২২ অর্থবছরেও মজুরি ১৪ টাকা বাড়াতে মালিক পক্ষ প্রথমে প্রস্তাব দিয়েছিল। মালিক পক্ষের অভিমত হচ্ছে, মজুরি ছাড়াও একজন চা শ্রমিকের পেছনে রেশন, বাসা, মেডিক্যাল, বোনাস ইত্যাদি খাতে প্রচুর ব্যয় করতে হয়। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে প্রতিজন শ্রমিককে দুই টাকা কেজি দরে সাড়ে তিন কেজি আটা দেওয়া হয় এবং বছরে ৪৭ দিনের সমপরিমাণ মজুরি বোনাস হিসেবে প্রদান করা হয়। সব মিলিয়ে একজন শ্রমিকের পেছনে মালিক পক্ষের মাসে কমপক্ষে ১০-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়। 

চা বাগানে শ্রমিকদের শ্রেণিভেদ আছে, দক্ষ-অদক্ষ, স্থায়ী-অস্থায়ী। সব শ্রমিক কিন্তু দিনে ১৭০ টাকা করে পাবে না; শুধু ‘এ’ ক্যাটাগরির শ্রমিকরাই পাবে ১৭০ টাকা; ‘বি’ এবং ‘সি’ ক্যাটাগরির শ্রমিকদের মজুরি কিছুটা কম হবে এবং অস্থায়ী শ্রমিকদের মজুরি হবে আরও কম, তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হলেও রেশন এবং বোনাস দেওয়া হবে না। এই মজুরি থেকে প্রতি মাসে ১৫ টাকা করে তাদের সংগঠন পঞ্চায়েত চাঁদা হিসেবে নিয়ে নেবে। বিদ্যুৎ বিল মালিক পক্ষ দেবে না। মালিক পক্ষের তরফ থেকে বাগানে চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফের ব্যবস্থা থাকলেও জটিল এবং গুরুতর রোগের চিকিৎসা ওখানে নেই। বাগানের ভেতরে বিনা পয়সায় থাকার ঘর দেওয়া হলেও সেই ঘরের অবস্থা নিম্নমানের। বাগানে কাজ না করলে নিম্নমানের ঘরটিও হারানোর ভয় থাকায় প্রতি পরিবারের অন্তত একজনকে চা শ্রমিক হিসেবে বংশানুক্রমে কাজ করে যেতে হচ্ছে। 

১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৪০ সালে ব্রিটিশ বণিকরা চীন থেকে বীজ, চারা এবং যন্ত্রপাতির পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিকও আনে। এরপর থেকে বাগান চক্রেই আটকে যায় শ্রমিক এবং তাদের নতুন প্রজন্মের জীবন। শ্রমিকরা যাতে বাগানের বাইরে গিয়ে খরচ করার সুযোগ না পায় সেজন্য ব্রিটিশ আমলে দেশের বৈধ মুদ্রায় মজুরি দেওয়া হতো না, তাদের জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিল বিশেষ ধরনের মুদ্রা যা শুধু বাগানের ভেতরে কেনাকাটায় ব্যবহৃত হতো। চাবুক-বুটের লাথি ছিল এই নিরীহ মানুষগুলোর জীবনের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মালিকদের নির্যাতনে শ্রমিকের মৃত্যু হলেও তার জন্য মালিককে জবাবদিহি করতে হতো না, কারণ মালিকদের কথাই বাগানে রাষ্ট্রীয় আদেশ হিসেবে গণ্য হতো। 

মানবেতর জীবনযাপন এবং মালিক পক্ষের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯২১ সালে সিলেট অঞ্চলের প্রায় ৩০ হাজার চা-শ্রমিক ‘মুল্লুকে চল’ স্লোগান দিয়ে সিলেট রেলস্টেশন থেকে হাঁটতে হাঁটতে চাঁদপুর মেঘনা স্টিমার ঘাটে এসে পৌঁছামাত্র ব্রিটিশদের নির্দেশে গোর্খা সেনারা গুলি ছোড়ে বহু শ্রমিককে হত্যা করে। এই হত্যার কোনো বিচার হয়নি। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমল পার হওয়ার বায়ান্ন বছর পর তাদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকার কথা শুনে অনেক রাজনৈতিক নেতা প্রেস ক্লাবের সম্মুখে উচ্চকণ্ঠে চা শ্রমিকদের পক্ষে স্লোগানও দিচ্ছেন। শ্রমিকদের পক্ষে বাম রাজনীতি করেন, অথচ শ্রমিকদের বেতনের খবর এত দিন তাদের জানা ছিল না। শ্রমের মজুরি কম বলেই আমাদের চা শিল্প এবং পোশাক শিল্প টিকে আছে। শ্রমের মূল্য বেশি বলে উন্নত দেশগুলো শ্রমনির্ভর কাজ ছেড়ে দিয়েছে, পণ্য উৎপাদন করে পোষাতে পারে না। ফলে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্য তৈরির কারখানা ইউরোপ আমেরিকা বাদ দিয়ে চীনে গড়ে তুলেছে। চীনের অর্থনৈতিক অবস্থারও দ্রুত উন্নতি হচ্ছে, শ্রমিকের মজুরি বেড়ে গেলে তারাও পোশাক শিল্প ছেড়ে দেবে। তখন ভিয়েতনাম, লাউস, কম্বোডিয়ার মতো গরিব দেশগুলো হবে বাংলাদেশের প্রতিযোগী। 

কম মজুরিতে কাজ করে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা কতকগুলো ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে, কিন্তু তাদের জীবন খুব কষ্টের। দেশের উন্নতি হলেও বদলাচ্ছে না শ্রমিকদের জীবন। একজন চা শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজ করে যে মজুরি পায় উন্নত দেশে এক ঘণ্টা কাজ করে তার চেয়ে অনেক বেশি মজুরি পায়। যে কোনো কাজে  ঘণ্টায় সর্বনিম্ন নির্ধারিত মজুরি অস্ট্রেলিয়াতে ১৩৫০ টাকা, কানাডায় ১১৫০ টাকা এবং আমেরিকায় ৭০০ টাকা। তবে উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা যথার্থ না হলেও একজন চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি শুধু ১৭০ টাকা হবে কেন? মাত্র ২ কেজি চালের পয়সা। এই টাকা দিয়ে শুধু চাল নয়, কিনতে হয় মাছ, মাংস, ডাল, সবজি, তেল, লবণ, সাবান, পোশাক; ব্যয় করতে হয় জটিল ও গুরুতর রোগের চিকিৎসায়, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ায়। নির্ধারিত পরিমাণ চা পাতা তোলা না হলে ১৭০ টাকা থেকে জরিমানা কর্তন করে রাখা হবে, অবশ্য নির্ধারিত কোটার বেশি তোলা হলে মজুরি আনুপাতিক হারে বেশিও দেওয়া হয়। এই অতিরিক্ত মজুরি পাওয়ার লোভে পাতা সংগ্রহে মাকে শিশুরা সহায়তা করে থাকে। বাড়তি টাকা আয় করেও পাঁচ সদস্যের একটি সংসার চালানো দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি মূল্যস্ফীতি সবই হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, অথচ তাদের মজুরি এতদিন ধরে বেড়েছে ১০ টাকা বা ১৫ টাকা করে।  

১৯৬৬ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১১৪টি চা বাগানের মধ্যে ৫৬টির মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি, ৪৭টির মালিক ইউরোপীয় এবং মাত্র ১১টির মালিক বাঙালি উদ্যোক্তা। ১৯৭০ সালে ১৬২টি চা বাগানের মধ্যে ৭৪টিরই মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্যোক্তা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চা শিল্পে ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল। এখনো এই শিল্পে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর আধিপত্য রয়েছে। তাই সরকার ইচ্ছে করলেই মজুরি বাড়াতে পারে না। তবে শ্রমিকের মজুরি বাড়ানো হলে মালিক পক্ষ দেউলিয়া হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা করার কোনো কারণ নেই। শ্রমিকেরা যখন দেখেন চা বাগানের মালিকেরা টাকার পাহাড় গড়ে তুলছেন, ঈদের বাজার করতে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে ব্যাংকক যাচ্ছেন, আর বিদেশে অর্থ পাচার করে সন্তানদের বিলাসী জীবন নিশ্চিত করছেন তখন শ্রমিকদের না খেয়ে মরাটা জাস্টিফাই করা সম্ভব হয় না। অনাহারে-অর্ধাহারে, অসুখে-বিসুখে এক বীভৎস জীবনের সম্মুখীন তারা। শ্রমিক না বাঁচলে চা বাগান দেউলিয়া হওয়া, না হওয়া দুটোই সমানভাবে তাদের কাছে অর্থহীন। 

১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকরাও তাদের তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে, কিন্তু তাদের কেউ আজ পর্যন্ত এক খণ্ড জমির মালিক হতে পারেনি। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর আর্থিক সচ্ছলতা ছাড়াও দরকার একটু সহানুভূতি, ভালোবাসা আর মানুষ হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর অধিকার। 

লেখক- সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //