শনিবারের বিষণ্ণ বিকেলের হাওয়া ও শিল্পীর স্বাধীনতা

নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী গত ২ সেপ্টেম্বর নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন : ‘আপনারা দেখছেন আমি কতটা নিয়ন্ত্রণ করছি আমার আবেগ। এমনকি অ্যাবসোলিউট বুলশিটের উত্তরও না দিয়া কনফ্লিক্ট এড়াইয়া গেছি।

কিন্তু আজকে সকালে একটা খবর পড়ে, যদিও খবরটা আগে থেকেই জানতাম, আমার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না! হলি আর্টিজানের উপর নির্মিত ভারতীয় ছবি ‘ফারাজ’ দ্রুতই মুক্তি পাবে। আমার ভারতীয় ফেলো ফিল্মমেকার হানসাল মেহতার জন্য আমি আনন্দিত যে সে তার ছবিটা শেষ করে প্রিমিয়ার করতে পারছে। হয়তো দ্রুতই আপনারাও সেটা দেখতে পারবেন। একই সঙ্গে আমি একজন বাংলাদেশি ফিল্মমেকার হিসেবে অনুতপ্ত, ক্ষুব্ধ, বিরক্ত! আমার ছবিতে কোথাও হলি আর্টিজান মেনশন করা নাই, আমার ছবিতে হলি আর্টিজানের কোনো রিয়াল ক্যারেক্টার পোর্ট্রে করা হয় নাই, তারপরও স্রেফ এই দেশের হতভাগা ফিল্মমেকার হওয়ার অপরাধে আমার ছবিটাকে সাড়ে তিন বছর আটকে রাখা হইল।’ এর কয়েক দিন আগে তিনি লিখেছেন : ‘এই দেশে ফিল্ম বানানোর মতো অপরাধ আর দ্বিতীয়টা নাই!’

ফারুকীর এই ক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ আছে। সে প্রশ্নের উত্তর পাঠকেরও জানা। বেশ কিছুদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া উত্তপ্ত। 

প্রায় ৩ বছর আগে সেন্সর ছাড়পত্রের জন্য জমা দেওয়া হয় মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’। প্রথম প্রিভিউয়ের পর সেন্সর ছাড়পত্র পাওয়ার কথা বলা হলেও দ্বিতীয় প্রিভিউ করে তা আটকে দেওয়া হয়। এরপর প্রায় সাড়ে ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও সিনেমাটি ছাড়পত্র পায়নি। নির্মাতা ও অভিনেতা আফজাল হোসেন এই ঘটনাকে যে কোনো সৃজনশীল মানুষের জন্য দারুণ মর্মবেদনা ও হতাশার বলে উল্লেখ করেছেন (বাংলা ট্রিবিউন, ৩১ আগস্ট ২০২২)।

যে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনাকে উপজীব্য করে ‘শনিবার বিকেল’ নির্মিত হয়েছে, সেই ঘটনা নিয়ে অসংখ্য সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশ ও প্রচার হয়েছে। এখনো প্রতিবছরের পয়লা জুলাই ওই ঘটনার ফলোআপ সংবাদ প্রকাশ করে গণমাধ্যম। বিশ্লেষকরা এখনো ওই ঘটনা নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। 

কিন্তু একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা যদি এরকম একটি লোমহর্ষক ঘটনাকে নিজের মতো করে, নিজের স্টাইলে, এমনকি চলচ্চিত্রের নির্মাণ কৌশলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা থেকে কিছু করার চেষ্টা করেন, সেই স্বাধীনতা তো তার থাকা উচিত। এখানে সেন্সর বোর্ডের মাতব্বরির কি প্রয়োজন? 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ পৃথিবীর আরও অনেক বড় ঘটনা নিয়ে অসংখ্য সিনেমা হয়েছে। তার মধ্যে কয়টি সিনেমা সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছে? একই বিষয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন নির্মাতা, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে সিনেমা বানিয়েছেন এবং এটিই স্বাভাবিক। কারণ বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তি বিশাল। শুধু হিটলারের শেষ কদিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও একাধিক সিনেমা হয়েছে। সুতরাং হলি আর্টিজানের ঘটনাটি কী ছিল, সেটি বের করে আনা গোয়েন্দা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কাজ। তাদের বলা ও লেখার ভঙ্গি একরকম। কিন্তু সেই একই বিষয় নিয়ে যখন একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা গল্প বলবেন, তখন সেটির বয়ান অভিন্ন নাও হতে পারে। 

তিনি ওই বিরাট ঘটনার খুব সামান্য একটি অংশ নিয়ে দুই আড়াই ঘণ্টার একটা ভিজ্যুয়াল বানাতে পারেন। এমনকি ওই বিশাল ঘটনার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষের মধ্য থেকে স্রেফ একজন মানুষকে নিয়েই সিনেমাটা বানাতে পারেন। এখানেই সাংবাদিকতা ও সিনেমার পার্থক্য। 

কিন্তু আমরা অদ্ভুতভাবে খেয়াল করলাম, ‘শনিবার বিকেল’ কীভাবে মুক্তি পেতে পারে তার উপায় বাতলে দিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, হলি আর্টিজান হামলায় দুজন পুলিশ অফিসার মারা গেছেন এবং পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জঙ্গিদের দমন করেছিল। কিন্তু সেই বিষয়গুলো সিনেমাটিতে আসেনি। সেজন্য এই দৃশ্যগুলো সংযোজন করতে বলা হয়েছে (আজকের পত্রিকা, ২৯ আগস্ট ২০২২)। অর্থাৎ এই দৃশ্যগুলো সংযোজন করলেই সিনেমাটি মুক্তি পাবে। 

অথচ ‘শনিবার বিকেল’ যে হলি আর্টিজান নিয়েই নির্মিত, সে কথা নির্মাতা বলেননি। ওই ঘটনার কোনো চরিত্র এই সিনেমায় নেই। প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক। ফারুকীর ভাষায় : ‘আমি একটা কাল্পনিক গল্প বানিয়েছি টেরর অ্যাটাকের উপর। হলি আর্টিজানের ঘটনা থেকে আমি ইন্সপিরেশন নিয়েছি।’

প্রশ্ন হলো, সিনেমায় কোন দৃশ্য থাকবে আর থাকবে না, সেটি কি রাষ্ট্র নির্ধারণ করবে? তাহলে চিত্রনাট্য নির্মাতা ও পরিচালকের কাজ কী? তাহলে শিল্পীর স্বাধীনতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে কিনা? 

মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কি দাবি করেছেন যে, তিনি হলি আর্টিজান নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি অথবা টেলিভিশনের রিপোর্ট বানিয়েছেন? ‘শনিবার বিকেল’ তো ডকুমেন্টারি বা টেলিভিশনের প্যাকেজ নয়। 

সিনেমা একটি স্বাধীন শিল্প। এখানে কোন দৃশ্য সংযোজন করতে হবে আর কোনটি বাদ দিতে হবে, সেই এখতিয়ার সেন্সর বোর্ডের থাকলেও একুশ শতকের এই সময়ে এসে সেন্সর বোর্ডের মতো একটি পশ্চাৎপদ ধারণা চলচ্চিত্রশিল্পে থাকা উচিত কিনা- সেটিও বিরাট প্রশ্ন।

তবে শুধু শনিবার বিকেল নয়। সম্প্রতি আরও একটি সিনেমা প্রশাসনিক খবরদারির শিকার হয়েছে। সেটি হচ্ছে ‘হাওয়া’। সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে বন বিভাগ। অভিযোগ, তারা (বন বিভাগ) নাকি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত চলচ্চিত্রটির রিভিউয়ে পড়েছে, এই সিনেমায় একটি পাখিকে (শালিক) হত্যা করে চিবিয়ে খেয়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। 

অথচ সিনেমার দৃশ্যে যে পাখি হত্যা করে চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেটি যে আসলেই শালিক পাখি ছিল না, এটি বোঝার জন্য সিনেমাবোদ্ধা হওয়ার দরকার হয় না। সিনেমায় যে ধর্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়, সেটি যে  আসল ধর্ষণ নয়, সিনেমায় যে খুন দেখানো হয়, সেটি যে আসল খুন নয়, সিনেমায় যে বন্দুক দিয়ে বাঘ ও হরিণ শিকার দেখানো হয়, সেখানে যে আসলেই বাঘ ও হরিণ হত্যা করা হয় না- এটুকু কাণ্ডজ্ঞান মানুষের আছে। কিন্তু তারপরও মামলায় হয়রানির হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে হাওয়ার পরিচালক ক্ষমা চেয়েছেন এবং বন বিভাগ মামলা প্রত্যাহার করেছে। অথচ বন বিভাগের কাছে এই প্রশ্ন করা উচিত যে, একটি পাখিকে খাঁচায় পুরে রাখা এবং চিবিয়ে খাওয়ার অভিযোগে যদি সিনেমার পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাহলে সারা দেশের চিড়িয়াখানায় যে বন্যপ্রাণী আটকে রাখা হয়েছে, সেজন্য কি প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা হবে? রাজধানীর কাঁটাবনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খাঁচায় রেখে যে বন্যপ্রাণী ও পাখি বিক্রি করা হয়, সেগুলো কি অবৈধ? সিনেমায় পাখি হত্যা দেখানো হয়েছে বলে যদি পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাহলে এ যাবৎ পৃথিবীতে যত সিনেমায় ধর্ষণের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, যত খুনের দৃশ্য দেখানো হয়েছে, সেসব ঘটনায় ভিলেনের চরিত্রে অভিনয়কারীদের বিরুদ্ধে কি ধর্ষণ ও হত্যা মামলা করা হবে? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, সুন্দরবনসহ সারা দেশের বন যে উজাড় হয়ে যাচ্ছে; প্রতিদিন যে বন বিভাগের চোখের সামনে বনজসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে এবং এই বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীরাই বনের সম্পদ লুটপাট করে শত কোটি টাকার মালিক হচ্ছেন, সেগুলোর বিরুদ্ধে বন বিভাগ কয়টা মামলা করেছে?

সিনেমার কোনো দৃশ্যের বিরুদ্ধে মামলার অর্থ হলো নির্মাতাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া। সব জায়গায় প্রশাসনিক খবরদারি জাহির করা। জনগণ নয়, প্রশাসনই যে রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক, সেটি বুঝিয়ে দেওয়া। 

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ‘আই থিয়েটার’ নামক একটি অ্যাপে আংশিকভাবে মুক্তি পায় ‘নবাব এলএলবি’ নামে একটি সিনেমা- যার একটি দৃশ্যে যে নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে, তিনি থানায় মামলা করতে যান। যেখানে পুলিশের একজন এসআই ওই নারীকে ধর্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। এ নিয়ে আপত্তি জানায় পুলিশ। পরে সিনেমার পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শাহীন মৃধাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তাদের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মামলা করা হয়। তখনো বাস্তবতা ও সিনেমার মধ্যে পার্থক্য এবং শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নটি সামনে আসে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এভাবে নির্মাতা ও শিল্পীদের বিরুদ্ধে মামলা করে, গ্রেপ্তার করে, তাহলে এই দেশে তো কোনো শিল্পের চর্চা হবে না।

নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ শনিবার বিকেল মুক্তি দেয়ার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন (বাংলা ট্রিবিউন ২৯ আগস্ট ২০২২)। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলো মহল্লার মাঠ রক্ষা থেকে শুরু করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ- সবকিছুর জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি পেশ করতে হয়। তিনি যতক্ষণ না হস্তক্ষেপ করেন বা নির্দেশনা দেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। তাতে বরং এই প্রশ্ন উঠতে পারে বা উঠেছে যে, যদি মহল্লার মাঠ রক্ষা থেকে শুরু করে দেশে গণতন্ত্র কায়েম অবধি সবকিছু একজন ব্যক্তিকেই করতে হয়, তাহলে সরকারের প্রশাসনযন্ত্র, অর্ধশত মন্ত্রণালয়, দপ্তর, অধিদপ্তর, সাড়ে তিনশ এমপি, হাজার হাজার চেয়ারম্যান, মেয়র, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিশাল বাহিনীর কী কাজ? সবাই কেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবেন? প্রতিটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য তো কিছু আইন ও বিধিবিধান, নিয়ম-কানুন ও রেওয়াজ আছে। কিন্তু অতি ক্ষুদ্র সমস্যার সমাধানেও রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীকে কেন হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু তারপরও বলবো যদি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে শনিবার বিকেলের ফাঁড়াটা কেটে যায় মন্দ কী!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //