মানববন্ধন যখন প্রতিবাদের হাতিয়ার

দেশে যে কোনো অসংগতিতে অধিকার বুঝে নেবার দাবিতে এবং প্রতিবাদ জানাবার প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান। কখনো এককভাবে, আবার কখনো একসঙ্গে আন্দোলনের এ হাতিয়ারকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী তাদের সিংহভাগ প্রতিবাদ আজ এভাবেই করে থাকে।

তবে সাংস্কৃতিক সমাজ মাঝেমধ্যে মানববন্ধনের সঙ্গে ব্যতিক্রম হিসেবে প্রতিবাদী গান বা নাটক করে সাধারণ জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্যোগ নিয়ে থাকে। রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে যদিও প্রতিবাদের ভাষার ভিন্নতা দেখা যায়। তবে যত দিন যাচ্ছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমাজের প্রতিবাদের হাতিয়ারগুলো সীমিত হয়ে পড়ছে। প্রতিবাদের মানুষও যেমন সীমিত হয়ে যাচ্ছে, তেমনি অবস্থা প্রতিবাদের হাতিয়ারের। তাই তো সারাদেশে প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে এ অস্ত্র ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে দেশের অসংগতির পাশাপাশি বিদেশি বিষয় নিয়েও প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। 

দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে কত রকমের অসংগতি প্রতিনিয়ত ঘটছে তা মানববন্ধনগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এ প্রতিবাদের বিষয় বৈচিত্র্য শুধু মানুষের চাওয়া পাওয়ার মধ্যেই সীমিত থাকে না, তার মধ্যে দেশ, জাতি ও নিজেদের কল্যাণও থাকে। সাম্প্রতিক সময়ের জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকের পৃষ্ঠা উল্টালে বিষয়ের বহুধা বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। এ সময়কালে কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি হয়রানি বন্ধ, ছাত্রী ধর্ষণের বিচার, যানজট থেকে মুক্তিতে আবাসিক গ্যাস সংযোগ চালু করার দাবিতে, কর্মচারীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তর কিংবা হাফ ভাড়ার দাবি, অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদ, পরিবেশ ও তার সৌন্দর্য রক্ষায়, গাড়িভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে, সাম্প্রদায়িক হামলায় জড়িতদের বিচার, নদী বাঁচানোর দাবি, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, নদীভাঙন রোধ, কলেজের কৃষিজমি রক্ষা, পরিবেশ রক্ষায় ইট ভাটা বন্ধ আর নির্মাণ কাজের মানরক্ষা থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দাবিতে মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। কলেবর বিষয়টি মাথায় রেখে আরও অনেক বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয় না। 

১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রতিনিয়ত অসংগতি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। তবে কিছু কিছু বিষয় আছে যা স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে কাম্য হতে পারে না। দেশে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির ফলে যে হানাহানির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তাতে কিছু মানুষ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে তখন তা যে কোনো অবস্থায় স্বাধীন থাকবে। কাজেই নিশ্চিন্ত মনে নিজের এবং পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনে ছলে-বলে-কৌশলে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই তাদের একমাত্র দায়িত্ব। সাধারণ মানুষকে মুক্তিলাভের আস্ফালনের মধ্যে রেখে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতা রক্ষা আর জনকল্যাণের কথা বলে চোখে পট্টি পরিয়ে রাখতে চায় তারা। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের লেশমাত্র তাদের মধ্যে দেখা যায় না। শুধু নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার আশায়, নিজের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আশায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে এ গোষ্ঠী। তখন আর সহযোগিতা কিংবা সম্প্রীতিতে বাঁচার পরিবেশ থাকে না। তাই তো স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সাধারণ জনগণের দুঃখ দুর্দশা চলমান। 

দেশের সাধারণ মানুষের দুঃখ বেদনায় পাশে দাড়াতে, তাদের অধিকার আদায়ের দাবিতে পাশে দাঁড়াতে, নানা অসংগতিতে অতিষ্ঠ হয়ে, ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠা মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রতিবাদ করে সমাজের সচেতন প্রতিনিধিরা। যদিও সামাজিক সুবিচারের আশায় প্রতিবাদী মানুষের সদিচ্ছার সঙ্গে তাদের সামর্থ্যরে ব্যাপক তফাত। রাষ্ট্র ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে এই প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদ সহজে কারো মনে দাগ কাটে না। ধারাবাহিকতার অভাবে নাকি প্রতিদিনকার সংঘটিত অসংগতির সংখ্যাবৃদ্ধির কারণে আন্দোলনকারীদের পক্ষে ধারাবাহিকতা রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে অল্প সময়ে সবাই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। যেখানে শক্তিশালী পেশাজীবীরা পর্যন্ত প্রতিবাদের ধৈর্য রাখতে পারছে না সেখানে সাধারণ মানুষের কথা হিসাবের বাইরে রাখাই শ্রেয়। দেশে আইন সবার জন্য সমান বলা হলেও তার প্রতিফলন যথাযথভাবে প্রকাশ না হওয়ায় এবং প্রতিদিনই কিছু না কিছু অসংগতি, অনিয়ম সংঘটিত হওয়ায় প্রতিবাদকারীরাও নিজেদের আস্থা হারিয়ে ফেলছে কিনা তা বিবেচনার দাবি রাখে। তবে একথা স্বীকার করতে দ্বিধা রাখা যাবে না যে প্রতিবাদের কারণে অসংগতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। 

রাজনৈতিক স্থবিরতার কারণেও সামাজিক প্রতিবাদ মানববন্ধন আর স্মারকলিপি প্রদানের মধ্যে সীমিত হয়ে পড়েছে। যে কোনো অসঙ্গতিতে প্রতিবাদের হাতিয়ার আজ মানববন্ধন বা মানব শেকল। আবার বর্তমান সময়ে দেশের সর্বত্র যেসব মানববন্ধন হয়ে থাকে তাতে মানব শেকল পর্যন্ত তৈরি করা হয় না। প্রতিবাদী কিছু মানুষ সে তারা সংখ্যায় যে কয়েকজনই হোক না কেন সবাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকে আর নেতারা ব্যানারের পাশে জটলা করে একের পর এক বক্তৃতা দিয়ে যায়। এমনও দেখা যায়; যার কথা বলা হয়ে যাচ্ছে তিনি চলে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে মানব শেকল করে না বলে প্রতিবাদীদের মধ্যে ঐক্যের এহেন অভাব পরিলক্ষিত হয়। দেশে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্তি প্রবল, কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করতে না পারলে সফলতার আশা বৃথা। বর্তমানে মানববন্ধনে পরস্পরের হাতের সঙ্গে হাত বন্ধন কেন করা হয় না তা বলতে পারা কঠিন। তবে প্রতিবাদ সফল করতে ঐক্য প্রদর্শনের কোনো বিকল্প নেই। অতীত ইতিহাস আমাদের এমন শিক্ষাই দিয়ে থাকে। তাই মানববন্ধনে ঐক্য প্রদর্শন করেই সাধারণ মানুষদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টির উদ্যোগ সফল হতে পারে। 

সামাজিক প্রতিবাদের আর একটা অংশ স্মারকলিপি প্রদান। সাধারণ মানুষের নূ্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ, সুষম বণ্টন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, পরিবেশ রক্ষাসহ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহুধা বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়ে থাকে। যারা জনগণের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করবার চেতনায় নিজেরা উদ্বুদ্ধ হতে পারেন না, তারা কীভাবে স্মারকলিপি ধারণ করবেন? তাই তো যেসব স্মারকলিপি প্রদান করা হয়ে থাকে তা দায়িত্বপ্রাপ্তরা দেখেন বলে মনে হয় না। সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ তো অনেক পরের কথা। আজ পর্যন্ত কেউ দেখেছে কিনা জানি না যে, স্মারকলিপির ভিত্তিতে কোনো সমস্যার সমাধান হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে কোনো এক সময় সম্যার সমাধান হলে অনেকেই বিশ্বাস করেন স্মারকলিপি দেবার ফল পাওয়া গিয়েছে। নিজেদের সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য এমন ভাবনা ভিন্ন পথ কী? 

দেশের সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে না পারলে বাহুবলে যে শক্তিশালী তার অনুগত থেকেই জীবন কাটাতে হবে। আমাদের সমাজটা এমনভাবেই গড়ে উঠছে। এই সমাজের বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যক্তিসত্তার ও মর্যাদাবোধের সমাজ গড়ে তোলা না গেলে, মানুষ তার অধিকার ও চেতনার দাবি প্রকাশ্যে আনতে অক্ষমই থেকে যাবে। মনে রাখা দরকার রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবাদী মানুষদের কেউ বিদ্রুপ করে না, কিন্তু কেউ তারিফও করে না। সাধারণ মানুষ রূপকথার রাজপুত্রদের জয় দেখে। রূপকথার গল্প শুনে আনন্দে আপ্লুত থাকার জীবন ধারাকেই মেনে চলে। তাই তো ঐক্যহীন প্রতিবাদ তাদের প্রভাবিত করতে পারছে না। তাই নিজেদের ঐক্য দিয়ে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষবদ্ধ চেতনাকে বের করে আনতে পারলেই দেশ ও জাতির কল্যাণের পথ পাওয়া সম্ভব।


লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //