বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ালে পস্তাবে মিয়ানমার

জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, নানারকম ঘটনা ঘটবে। তার মধ্যে রোহিঙ্গা উৎপাত তো রয়েছেই। যখন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ সোচ্চার এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও বলছেন যে রোহিঙ্গারা এখন বোঝা- তখন সীমান্তে মর্টার ও গুলি ছুড়ে; বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে যুদ্ধের উসকানি দিচ্ছে মিয়ানমার। এটা এখন নিয়মিত ঘটছে।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, ১৬ সেপ্টেম্বর রাত ৮টার দিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম কোনার পাড়া সীমান্তে মিয়ানমারের ছোড়া ৪টি মর্টার শেলের বিস্ফোরণে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হয়েছেন। আরও ছয়জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিন দুপুরেই নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় একটি মাইন বিস্ফোরণে একজন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন। অনুসন্ধানের বিষয় হলো, মাইনটি কি বাংলাদেশ সীমানার ভেতরে পুঁতে রাখা ছিল? যদি তা-ই হয়, তাহলে এটি আরেকটি খারাপ সংকেত। 

গত ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে গুলি ও মর্টার শেল ছোড়া হয়। গণমাধ্যমের খবরে তখন বলা হয়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে শূন্যরেখার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ১২০ মিটার ভেতরে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর দুটি গোলা এসে পড়েছে। জনবসতিহীন পাহাড়ে এ দুটি গোলা বিস্ফোরিত হলেও কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। 

এর আগে গত ২৮ আগস্ট দুটি মর্টারের গোলা নাইক্ষ্যংছড়ির উত্তর ঘুমধুমপাড়ার জনবসতিপূর্ণ এলাকায় এসে পড়ে। তবে গোলা দুটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পরদিন সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল সেটি নিষ্ক্রিয় করে।

এর দুদিন পরই ৩০ আগস্ট মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ওই দিন দুপুরে ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশফাঁড়ি সীমান্তের ৩-৪শ গজ ভেতরে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার বেশ কয়েকবার ঘুরতে দেখা গেছে বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। 

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালের জুলাই মাসেও বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমার। ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের হাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা চলে আসার পর অন্তত তিন বার বাংলাদেশের আকাশ সীমানায় উড়ে গেছে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার। তখনো এর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। 

এবারও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে মর্টার শেল ও গুলি নিক্ষেপ এবং মিয়ানারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে সতর্ক করা হয় এবং এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। সীমান্তে বিজিবিকে সতর্ক অবস্থানে রাখা হয়। বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি।

প্রসঙ্গ, মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের আগে ২০২০ সালে আরাকান আর্মির সঙ্গে সেদেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিরতি সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাখাইন রাজ্যেও সেনাবাহিনীবিরোধী মনোভাব বেড়ে ওঠে। এরই সুযোগে আরাকান আর্মি ওই যুদ্ধবিরতি থেকে বের হয়ে আবার নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এ অবস্থায় রাখাইন রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মির সঙ্গে সে দেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয় এবং বিদ্রোহী তথা স্বাধীনতাকামীদের লক্ষ্য করে মিয়ানমার যে গুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে, সেগুলো মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশের সীমানায় এসে পড়ছে। এখন এটি যদি নিছকই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় তথা মিয়ানমার সরকার এবং তাদের ভাষায় বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাত হয়ে থাকে, তাহলে এটি একরকম। কিন্তু এখানে অন্য কিছু আছে কি না, অর্থাৎ মিয়ানমার সচেতনভাবে বাংলাদেশকে যুদ্ধের উসকানি দিচ্ছে কি না; তারা তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রের পার্পাস সার্ভ করার জন্য বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে কি না- সেটিও বিবেচনায় রাখা দরকার। 

তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, মিয়ানমারের এই আচরণের প্রতিবাদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হওয়া উচিত এবং বাংলাদেশ যেভাবে ও যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে, সেটি ঠিক আছে কি না। 

সম্প্রতি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘আমরা মিয়ানমারের উসকানি বা ফাঁদে পা দিতে চাই না।’ এটি নিশ্চয়ই একটি ‘ম্যাচিউরড ডিপ্লোম্যাটিক স্টেটমেন্ট’। ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা কী হবে? 

প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার যদি উসকানি অব্যাহত রাখে; আকাশসীমা লঙ্ঘন করতেই থাকে এবং তাদের ভাষায় বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে ছোড়া গুলিতে বাংলাদেশের মানুষ নিহত হয়; তখনো কি বাংলাদেশ শুধু তাদের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানাবে? 

‘সবার সঙ্হে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-এই পররাষ্ট্র নীতি বা মূলমন্ত্র নিয়ে বসে থেকে মিয়ানমারের এই অডাসিটির জবাব বাংলাদেশ কীভাবে দেবে? পাল্টা মর্টার বা গুলি না ছুড়লেও এই ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠন এবং তাদের উপর চাপ প্রয়োগে যা করা দরকার, তা কি বাংলাদেশ সরকার করছে? মিয়ানমারের যারা বন্ধু, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও ভালো। মিয়ানমার যে জাতিসংঘের কথা শুনবে না বা পাত্তা দেবে না, সেটা তারা আগেও বুঝিয়েছে। কিন্তু চীন যদি কিছু বলে সেটা মিয়ানমারকে শুনতে হবে। রাশিয়া যদি ধমক দেয় তাহলে ভয় পেতে হবে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ভালো। শুধু তা-ই নয়, চীন এখন বাংলাদেশের বিরাট উন্নয়ন অংশীদার। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো। 

এ অবস্থায় মিয়ানমারকে যে বার্তাটি এখন দেওয়া দরকার তা হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে সে যুদ্ধে জড়ালে, আয়তনে ও সামরিক শক্তিতে সে যত বড়ই হোক, আখেরে তাকেই (মিয়ানমার) পস্তাতে হবে। কারণ বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন কোনো রাষ্ট্র নয় বা ভূরাজনৈতিকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ নয়। এই অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিবর্গ নিজেদের আধিপত্য বিস্তার তথা ধরে রাখার ক্ষেত্রে যেসব বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালায়, বাংলাদেশ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। 

বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এই অঞ্চলে ভারত যেমন খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না, তেমনি চীনও। আবার পুরো বিশ্বে নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার জন্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও সতর্ক থাকতে হয়। সেও নানাভাবে তার খবরদারিও করতে চায়। সেই ইকুয়েশনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। উপরন্তু ১৭-১৮ কোটি লোকের দেশ এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হওয়ায় তুরস্কসহ শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

সুতরাং মিয়ানমারের উসকানিতে বাংলাদেশ যদি যুদ্ধে জড়ায় কিংবা মিয়ানমার যদি বাংলাদেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়, সেটি আর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং পুরো বঙ্গোপসাগর, এমনকি ভারত মহাসাগরও একটি বিরাট যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে। সেই যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে না। আর সেই সুযোগে মিয়ানমারের বহুধাবিভক্ত জাতিগোষ্ঠীর ভেতরে বছরের পর বছর ধরে যে অস্থিরতা ও সহিংসতা চলছে; তাদের নিজেদের ভেতরেই যে স্বাধীনতাকামীরা দীর্ঘদিন লড়াই করছে- সেই গোষ্ঠীগুলো আরও শক্তিশালী হবে; তারা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পাবে, যা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তাদের অভ্যন্তরীণ লড়াই আরও কঠিন করে তুলবে। শেষমেশ মিয়ানমারের ভেতরে একাধিক অঞ্চল স্বাধীনতা ঘোষণা করে ফেলতে পারে। আবার তখন সেই সব অঞ্চল স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়ে যেতে পারে। 

তার মানে বাংলাদেশকে উসকানি দিয়ে বা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিলে তাতে আখেরে পস্তাবে মিয়ানমার। এই পুরো অঞ্চলটি অশান্ত হয়ে ওঠার ফলে মিয়ানমারই বরং তার বহু অঞ্চল হারাবে। তার লাখ লাখ মানুষ নিহত হবে। এখন যে বিশাল অঞ্চল নিয়ে মিয়ানমার গঠিত, সেটি কয়েক টুকরো হয়ে যাবে। এই নির্মম বাস্তবতাটি মিয়ানমারকে বোঝানো দরকার। তারা এটা যত দ্রুত বুঝতে পারবে, ততই তাদের জন্য মঙ্গল।

পরিশেষে করোনা অতিমারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতির ধকল বিশ্ব কাটিয়ে না উঠতেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে নতুন করে সংকটে ফেলেছে। আগামী বছর মন্দারও আভাস রয়েছে। এই অবস্থায় নতুন করে বিশ্বের কোনো দুটি দেশ যুদ্ধে জড়ালে সেটি শুধু ওই দুটি দেশই নয়, বরং পুরো বিশ্বকে আরও বিপদের সম্মুখীন করবে। আর যুদ্ধে শুধু সৈনিক মরে না, নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই থাকে সাধারণ মানুষ।

অতএব বিশ্বের সকল মানুষের স্বার্থেই মিয়ানমারকে বোঝানো উচিত যে, যুদ্ধ হলে ক্ষতিটা যেমন অন্যের, তেমনি তার নিজেরও। বরং তার ক্ষতির শঙ্কাই বেশি। নিজের ভালো তো পাগলেও বোঝে!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //