ক্ষমতা-সর্বস্ব রাজনীতি

আজকাল পত্রপত্রিকা হাতে নিলেই যে খবর পাঠকের মনে দারুণ ‘চমক’ জাগায় সেটি হলো, দেশের ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা প্রতিপক্ষ বিরোধী দলের আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পিটিয়ে কুপিয়ে তাদের নাস্তানাবুদ করছে, অনেকে নিহতও হচ্ছেন।

বিরোধীদলীয় মিছিল ও সমাবেশগুলোতে সশস্ত্র ক্যাডাররা মহড়া দিচ্ছে, কোথাও হামলা করছে। তাদের বাড়িঘরে গিয়ে হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও ককটেল নিক্ষেপ করছে। এমনকি বিরোধী দলের স্থানীয় অনেক নেতা-কর্মীর বাড়িতে ঢুকে প্রতিপক্ষকে না পেয়ে শিশু ছেলে-মেয়েদের মারধরের মতো ভয়ংকর ঘটনাও ঘটছে। এগুলো সবই পত্রিকায় প্রকাশিত খবর।

পাঠক মাফ করুন, আমি কোনো দলেরই পক্ষেও নই, বিপক্ষেও নই। আবার এসব ঘটনার বিরোধিতা করা বা সমালোচনা করারও পক্ষে নই। সমালোচনা করতে গেলে তো ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলকেই করতে হয়। এমনকি দেশের সব দল এবং ব্যক্তি আপনি ও আমাকেও করতে হয়। কারণ পরিস্থিতির দায় আমাদের সকলের। তাই কারো সমালোচনায় না গিয়ে বাস্তব ও সত্য কথাগুলো বলতে চাই।

প্রথম কথা হলো, দেশের রাজনীতির যে পরিস্থিতির কথা বর্তমান আলোচনায় এসেছে, সেটি মোটেও কোনো নতুন বিষয় নয়। বিগত প্রায় তিন দশক ধরেই দেশের রাজনীতি এরূপ এক অসুস্থ ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। ক্ষমতার সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবে, যখন যারাই বিরোধী প্ল্যাটফর্মে থেকেছে, তাদের ওপর ক্ষমতাসীন দলের এই রকম হামলা, মামলা, খুন, জখম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ভয়াবহভাবেই হয়েছে।

আবার বিরোধী দল ক্ষমতায় গিয়ে, ক্ষমতাচ্যুত প্রতিপক্ষ দলের ওপর একইভাবে হামলা, খুন, জখম, মামলা, গ্রেপ্তার, জেল-জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, আজকের বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকাকালে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সেই সময়কার ক্ষমতা হারানো নেতা-কর্মীদেরকে আজকের মতোই রামদা, চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা ও জখম করেছে, লাঠিপেটা করে রক্ত ঝরিয়েছে। এমনকি গদি হারানো মন্ত্রী-মিনিস্টারদেরকেও পুলিশ দিয়ে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। এই ব্যাপারগুলো প্রায় তিরিশ বছর ধরেই পুনঃপুন ঘটেছে। আর এগুলো সবচেয়ে ভয়াবহভাবে ঘটেছে প্রধানত নির্বাচন সামনে রেখে।

এই সময়গুলোতে ক্ষমতাসীন দল তথা সরকারের সঙ্গে দেশের অন্যান্য দল ও গোষ্ঠীরও দ্বন্দ্ব হয়েছে, কখনো কখনো সংঘাতও হয়েছে। তাদের ওপর রাষ্ট্রের পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডারদের দ্বারা নির্যাতন-নিপীড়নও পরিচালিত হয়েছে। তবে সে দ্বন্দ্বগুলো হয়েছে রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা ইস্যু নিয়ে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ওপর যেসব হামলা-মামলা নির্যাতন পরিচালিত হয়েছে (এবং আজও হচ্ছে) সেগুলোর ইস্যু শুধু একটি, আর তা হলো ক্ষমতা। দেশে অসুস্থ ও শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার তাৎক্ষণিক বড় কারণ হলো শুধুই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

গত কয়েকটি নির্বাচনকালে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সে সময়কার প্রধান বিরোধী দল, আরও একাধিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের জোর দাবি নিয়ে দেশব্যাপী যে বড়সড় ঝটিকা আন্দোলনের সূচনা করেছিল, সেটি হয়তো বা একটি অভ্যুত্থানের দিকে অগ্রসর হতে পারত।

কিন্তু তার মধ্যে জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে গণবিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ঢুকে পড়ায় অথবা আন্দোলনের মধ্যে কোনো নাশকতার মাধ্যমে উগ্র সন্ত্রাসের রং লেগে যাওয়ার কারণে শুধু আন্দোলনই ব্যর্থ হয়নি, বিরোধী দলের শক্তি ও ইমেজ দুটোই ক্ষয় হয়েছে। পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে সম্পূর্ণ ইউ-টার্নের কারণে তাদের ইমেজ ও শক্তি আরও ক্ষয় হয়েছে। তবে সেসব আন্দোলনের বিরোধী দলের ওপর ক্ষমতাসীনদের হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন সমানতালেই চলেছে।

দেশের প্রধান বিরোধী দল এখন মনে করছে, দেশের অর্থনীতিতে নানা সংকট সৃষ্টি এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, লুটপাট ও অযোগ্যতার বিষয়গুলো আগের তুলনায় বেশি করে উচ্চকিত হওয়ার ফলে একটা নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তাই নির্বাচন সামনে রেখে এবার তারা নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে নতুন কৌশলে আন্দোলনে নেমেছেন।

কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অবকাঠামোর চোখধাঁধানো উন্নয়ন ঘটলেও, একদিকে জনগণের প্রতি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা না থাকা এবং গণতন্ত্র চর্চার সব দরোজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের রাজনীতিতে নিবর্তনমূলক কর্তৃত্ববাদিতার যে অচলায়তন তৈরি হয়েছে তার আমূল পরিবর্তন জরুরি। কিন্তু সেই অচলায়তন ভেঙে নতুন রাজনীতির উত্থান ঘটানোর জন্য মেধা, যোগ্যতা ও চরিত্র দেশের প্রধান বিরোধী দলের আছে কিনা তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

আবার এই দলের বাইরে মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন এবং ত্যাগী কোনো রাজনৈতিক শক্তি সহসা গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনদের নানা ভুল-ভ্রান্তি ও বিচ্যুতির কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থাটি যেমন নাজুক, তেমনি সকল সংকট উত্তরণে মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান না ঘটার কারণে বিরোধীদলীয় রাজনীতির অবস্থাও নাজুক।

সেই প্রেক্ষাপটে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, ক্ষমতাসীন দলের জন্য এখনো দেশের রাজনীতির মাটি উর্বর। তারপরও বিরোধী দলের ওপর ক্ষমতাসীনদের আদা-জল খেয়ে এমন ক্ষিপ্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়টি বোধগম্য নয়। এর রহস্যও আমরা বুঝি না। তবে বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষমতাসীনদের মরিয়া হয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার একটি ঘোর রহস্যের কথা মনে হয় এখানে বলাই যায়। কথাটি হলো, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল উভয়ের অবলম্বন এখনো যদি হয় রামদা ও চাইনিজ কুড়াল, তাহলে দুনিয়ায় কে এমন বোকার হদ্দ আছে যে, জলজ্যান্ত ক্ষমতা হাতছাড়া করে চাইনিজ কুড়াল আর রামদার কোপের মধ্যে পড়বে? এবার বুঝুন, কী রকম গ্যাঁড়াকলে পড়েছে এই দেশের রাজনীতি এবং জনগণ। 

লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //