বাঙালির গৌরব ‘অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’

বাংলার হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মহাজ্ঞানী অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। চীন ও বাংলার মধ্যে হিমালয়ের উচ্চতায় মৈত্রীর যুগোত্তীর্ণ সেতু বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম নির্মাণ করেন। হাজার বছর আগে তিনি মহাকালজয়ী মৈত্রী মিলনের যে বন্ধন রচনা করে গেছেন, তা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে আমাদের দুই দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের দুই দেশের জনগণকে আরও একত্রিত ও নিবিড় করেছে।

প্রাচীন বঙ্গ ও সমতট রাজ্যের রাজধানী কিংবা বৌদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশস্থল, যেদিক থেকেই ধরা যাক না কেন প্রাচীন বাংলার একটি সমৃদ্ধ স্থান হিসেবে গড়ে ওঠে এই বিক্রমপুর। তাই তো নিকটবর্তী নানা স্থানে আবিস্কৃত প্রাচীন বাংলার শাসকদের তারশাসনের ভাষ্যে এই অঞ্চলের নাম হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে- ‘শ্রীবিক্রমপুর-সমাবাসিত-শ্রীমজ্জায়স্কন্ধাবারৎ’ শীর্ষক সম্মানিত উচ্চারণ।

বাংলাদেশের বৌদ্ধ সংস্কৃতিকে নতুন করে জানার ক্ষেত্রে অনেকটা পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বিবরণী। আর বিক্রমপুর প্রসঙ্গে তার বর্ণনা আমাদের আরও আশাবাদী করে তুলেছে। তিনি মনে করেন বিক্রমপুর অঞ্চলে ত্রিশটির অধিক বৌদ্ধ বিহারের অস্তিত্ব ছিল। নির্মাণসামগ্রীর দুর্বলতা ও বাংলার উষ্ম-আর্দ্র প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাবে কালের আবর্তে তার বর্ণনায় আসা বিহারগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেলেও ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে যায়নি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সেই সময়। আর এ সময়ের বর্ণনালেখ্যে ঘুরে ফিরে আসছে অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞানের নাম। 

বিক্রমপুরের জন্মজাত যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (১৮৮২-১৯৬৪) ২৬ বৎসরে (১৯০৮ খ্রিঃ) ‘বিক্রমপুরের ইতিহাস’ নাম গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘আমরা দীপঙ্করের সম্পর্কে তিব্বতীয় ভাষায় লিখিত সমুদয় জীবন-চরিত হইতেই জানিতে পারি যে, তিনি বাঙলা দেশের অন্তর্গত বিক্রমপুরের অধিবাসী ছিলেন। বিক্রমপুর, অর্থাৎ শ্রীবিক্রমপুর নাম সুবৃহৎ রাজধানীর অন্তর্গত বজ্রযোগিনী নামক অংশে জন্মগ্রহণ করেন।’ সে সময়ে অধ্যাপক শ্রীযুক্ত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ মহাশয়ও লিখেছিলেন, ‘বিক্রমপুর অদ্বিতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত দীপংকরের শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি এবং তদানীন্তন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পণ্ডিত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ মহাশয় যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তকে একটি পত্র লিখেন-‘My dear Jogendra Babu, As regards Dipankar I long ago gave out my view that he was a native of Vajrajogini in Vikarampur. He flourished during the region of the Pal king and belonged to the Vajra sect of Mahajan Buddhist. That sect still exist in Tibet, Their Tantrik Practice called Mahasiddhi requires the Company of women called Yoginis.’

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আপ্লুত হয়ে উচ্চারণ করেন- ‘বাংলা দেশের দশম গৌরব দীপংকর শ্রীজ্ঞান’। তখনকার বিক্রমপুর পরগণায় জন্ম নেয়া অতীশ ভিক্ষু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিলেন বিক্রমশীলা বিহারে। নিজ মেধা, প্রজ্ঞা ও সাধনার ওপর নির্ভর করে অল্প দিনের ব্যবধানে পদোন্নতি প্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি এই বিহারের প্রধান পণ্ডিত হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন।

প্রয়োজন বোধে বিক্রমশীলা মঠের তখনকার অধ্যক্ষ তার ওপর নানা গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এক পর্যায়ে মহামতি বুদ্ধের মানবতার বাণী প্রচারে তাকে ভ্রমণ করতে হয়েছে সুবর্ণদ্বীপও। তিনি সেখানে গিয়ে পরম যত্ন এবং আস্থার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিজ নামের প্রতি সুবিচার করেছেন। এখানে ফিরে আসার পর বৌদ্ধ দর্শনে অগাধ জ্ঞান, শিক্ষক হিসেবে প্রদর্শিত পাণ্ডিত্য ও উদ্ভূত নানা সমস্যা সমধানের সক্ষমতা বিচারে তাকে বিক্রমশীলা বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল। মনে করা হয় তার আন্তরিক প্রচেষ্টা, পাণ্ডিত্য, জ্ঞানানুরাগ ও সক্ষমতার গুণেই তখনকার প্রসিদ্ধ নালন্দা বিহার থেকে বিক্রমশীলার গুরুত্ব বেড়ে যায় বহুগুণে।

বিক্রমশীলা বিহার থেকে শিক্ষালাভের পর এখানকার শিক্ষার্থীরা তাদের কর্মাকাণ্ডে ভারতবর্ষের সীমারেখা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। বিশেষত, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও কাজের ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ আন্তরিকতা বিশ্বের নানা স্থানে বৌদ্ধ ধর্মমত প্রসার ও প্রসারে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান সম্পর্কে বলেছেন- ‘দীপঙ্কর হিন্দুযুগের শেষ অধ্যায়ের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পুরুষ এবং বাঙালি জাতির চির গৌরব। শ্রীজ্ঞানের নাম বৌদ্ধ জগতের পুরোভাগে। তাঁহার প্রতি সমস্ত এশিয়ার লোকের শ্রদ্ধা এরূপ হইয়াছিল যে, তাঁহার নাম শুনিলে রাজচক্রবর্ত্তীদের মস্তক আনত হইত।

বুদ্ধদেবের পর বৌদ্ধজগতে দীপঙ্করের ন্যায় আর কোনো লোক জন্মগ্রহণ করেননি।’ দীনেশ চন্দ্র সেনের এই উচ্চারণের পাশাপাশি তিব্বতী নানা ঐতিহাসিকের মতামত আমলে নিলে অতীশ দীপঙ্করের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে অনুমান করা সম্ভব। বিশেষ করে তিনি মহাযানী বৌদ্ধ দর্শনের ওপর প্রায় শতাধিক বই লিখে গেছেন, যা নানা স্থানে সংরক্ষিত ছিল। সময়ের আবর্তে এর থেকে বেশিরভাগ হারিয়ে গেলেও যা এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে তা-ও নেহায়েত কম নয়। 

এই মহামুনির জীবনালেখ্য আলোচনা করতে গেলে শুরুতেই বলতে হয়, বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের বিক্রমপুরে (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ) বজ্রযোগিনী গ্রামের কথা। কেউ কেউ লিখেন ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে, মতান্তরে  ৯৮২ খ্রিস্টাব্দে এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। তার বাবা ছিলেন বিক্রমপুরের ছোট নগরীর রাজা শ্রী কল্যাণশ্রী আর মা ছিলেন প্রভাবতী। কল্যাণশ্রী আর প্রভাবতীর সন্তানদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা-মায়ের দেয়া নামে তিনি ছিলেন চন্দ্রগর্ভ। তিব্বতের নাথান বৌদ্ধ বিহারে ১০৫৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। 

জ্ঞানতাপস অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান উচ্চশিক্ষা অর্জন করার পর নিজ এলাকা বিক্রমপুর ও বগুড়ার সোমপুর মহাবিহারে অধ্যাপনা করেছেন এবং সেখানে বসে বই লিখলেন ‘মধ্যামকররত্নপ্রদীপ’। ওদন্তপুরি ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনা করেন এবং পরবর্তীতে রাজা ন্যায়পাল অতীশ দীপঙ্করকে বিক্রমশীল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যের দায়িত্ব অর্পণ করেন। 

তিব্বতের রাজা লাহ্-লামা-যে-শে-ওড (এশেওদ) অনুধাবন করলেন যে, তিব্বতে পুনরায় জাগরণ করার জন্য মহাজ্ঞানী অতীশ দীপঙ্করের প্রয়োজন। তিব্বতের রাজা লাহ্-লামা-যে-শে-ওড (এশেওদ) দূতের মাধ্যমে পত্র পেরণ করেন তিব্বতে যাওয়ার জন্য। নির্লোভ, নিরহঙ্কারী দীপঙ্কর সবিনয়ে এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন।

কিছুদিন পর তিব্বতে রাজার মৃত্যু হয়; কিন্তু মৃত্যুর আগে রাজার অবস্থা ও প্রাণের একান্ত অভিপ্রায় জানিয়ে দীপঙ্করের উদ্দেশে একটি পত্র লিখে যান। রাজা লাহ্-লামা-যে-শে-ওড (এশেওদ) মৃত্যুর পর তার ভ্রাতুষ্পুত্র জং-ছুবের রাজত্বকালে তিব্বতী ভিক্ষু আচার্য বিনয়ধর (ট্ষুল-খিম-গ্যালবা) মাধ্যমে পত্র ও স্বর্ণ দিয়ে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আগমনের জন্য প্রেরণ করেন। অবশেষে প-িত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বতে যাওয়ার সম্মতি প্রদান করেন এবং জানালেন- সব কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর তিব্বতে যাবেন। ১০৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দে তিব্বতে যাওয়ার পরিপূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। 

তিব্বতীয় আচার্য বিনয়ধর গ্যা-ট-সন, পণ্ডিত ভূমিগর্ভ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে নিয়ে নেপাল ও হিমালয়ের দুর্গম পথ দিয়ে যাত্রা করেন। পথে দুইবার দস্যুদের কর্তৃক আক্রান্ত হন। পথে তিব্বতী পণ্ডিত গ্যাটসন মারা যান। নেপালরাজ অনন্তকীর্তির সঙ্গে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সাথে দেখা হয় এবং অনন্তকীর্তির পুত্র বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন। নেপালে প্রায় এক বছররের কাছাকাছি পর্যন্ত ছিলেন; তখন  ১০৪১ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে। এ নেপালে বসেই ‘চর্যাসংগ্রহপ্রদীপ’ রচনা করেছিলেন। পালরাজ ন্যায়পালকে উপদেশমূলক একটি পত্র লিখেন, কিভাবে রাজ্য শাসন করবেন এবং প্রতিবেশী রাজাদের সাথে ব্যবহার কেমন হব- এরূপ প্রিয় রাজাকে পত্র ‘বিমলরত্মলেখ’ নামে  সেই চিঠিটি বিখ্যাত হয়ে আছে। 

তিব্বতীয়দের জ্ঞানের আলোয় আনয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখলেন- ‘বোধি-পথ-প্রদীপ’ ‘The lamp of Enlightenment’ও ‘বোধিমার্গ-প্রদীপ-পঞ্জিকা’ এবং দৈনন্দিন জীবন চরিতের জন্য ‘দশ-অকুশল-কর্ম-পথ-দেশনা’ মানুষের সুস্বাস্থ্যের জন্য লিখেন, , ‘Sman-yig sa-sbyor dar-ya-kan’ ‘চিকিৎসা-জীব-সেবা’ ‘The Method of Curing Head Ailments’ অতীশের অসামপ্ত কাজগুলো অতীশের প্রাণপ্রিয় শিষ্য ডোম-তোন-পা, অতীশের বইগুলো অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে শিষ্যকেই অতীশের উত্তরাধিকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিন শতাধিক গ্রন্থ ও অনুবাদ রচনা করেন। তিব্বতের রাজা Byam-chub-hod of M-nah-ris  দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে ‘অতীশ’ উপাধি প্রদান করেন। এ ‘অতীশ’ শব্দের অর্থ- শান্তি বা জ্ঞানের অগ্রপথিক।  

বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি মহামান্য মহাসংঘনায়ক বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো স্বপ্ন বুনন করেন এবং মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের শ্রীজ্ঞানের জন্মভূমি বজ্রযোগিনী গ্রামে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ছাত্র নিয়ে পরিদর্শন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন ঢাকা জাদুঘরের তৎকালীন সহকারী কিউরেটর শ্রী গণেশ চক্রবর্তী। ১৯৭৮ সালের ২৮ জুন মহাপণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের দেহাবশেষ তার স্বদেশের ঢাকাস্থ তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে আনা হয়।

১৯৮৩ সালে অতীশের দীপঙ্করের বাস্তুভিটায় মুন্সীগঞ্জস্থ (বিক্রমপুর) বজ্রযোগিনী গ্রামে অতীশের দীপঙ্করের হাজার বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়। সেই সময়ে অতীশের বাস্তুভিটায় অতীশের স্মৃতির উদ্দেশ্যে স্মৃতিসৌধ ও অতীশ দীপঙ্কর স্মৃতি কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী সময়ে কিছু জমিও ক্রয় করা হয়। সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথের অতীশ দীপঙ্করের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে অতীশের রিলিক্স স্তুপা নির্মাণ ও অতীশ দীপঙ্কর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে অতীশ দীপঙ্কর লাইব্রেরি কাম মিউজিয়াম ভবন নির্মাণ করা হয়। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ভিক্ষুসংঘ বসবাস করে এ প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে।

লেখক: ভদন্ত করুণানন্দ থের, অধ্যক্ষ, অতীশ দীপংকর মেমোরিয়াল কমপ্লেক্স।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //