ডিলান- সুমন- আরমান আলিফ: গান তুমি কার

কদিন আগে কবির সুমন ঢাকায় এসে গান গেয়ে নাড়া দিয়ে চলে গেলেন। তাকে কেন্দ্র করে অনেকেই, বিশেষ করে ‘সুশীল সংস্কৃতির’ দরদী মানুষ খুবই আলোড়িত হয়েছেন। তো এক আপা ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন- ‘সুমনের গান না শুনলে আমি আধুনিক বাঙালির গান কী সেটা জানতে পারতাম না।’ নিশ্চয়ই তাই। এই ভাবনাটা অনেকের মনেই আছে। 

তবে বিষয় হলো- এই সকল শ্রোতার মধ্যে আমি নেই, তার গান শুনিও না। কারণ টানে না আমাকে; যখন ফেসবুকে কথাটা লিখলাম, আমার বন্ধুবান্ধবরা ফেসবুকি কায়দায় আলাপ শুরু করে দিলো- সুমন তাদের কত কাছের মানুষ, তাদের কথাতেই বোঝা যায়। আমার   কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা চাই; কিন্তু এই গায়কের ঘরানা কী, কাদের কাছে তিনি বেশি আদৃত? 

দুই 

উইকিপিডিয়া পড়ে জানা গেলো যে, তিনি বব ডিলানের গান দ্বারা খুব প্রভাবিত, তার গানের রোলমডেল বলা যায়। রাজনৈতিক সচেতন সুমন নিকারাগুয়া গেছেন, জার্মানি গেছেন। অর্থাৎ মনের দিক থেকে ‘প্রোগ্রেসিভ’। সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘ দিন এবং ইউরোপ থেকে যন্ত্রপাতি এনে দল বানান, গান শুরু করেন। আবার রাজনীতি করেন, এমপি হন। 

ওনার ডিলান সিলসিলার কথা আগেও শুনেছিলাম। ‘বাংলার ডিলান’- এই কথাটা বলেছিলেন আমার এক বন্ধু তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে। প্রথম হিট গান: তোমাকে চাই, ১৯৯০ সালে মার্কেটে আসে। এই তথ্যটা জেনে উপকার হলো, কিছুটা বুঝলাম গড়বড় কোথায়। 

তিন

প্রথমে আমি মূল ডিলান শুনেছি ইংরেজিতে ৬০ দশকের শেষ দিক থেকে। ৭০ দশকেও শুনেছি; কিন্তু ৮০-তে এসে আমি ডিলান শোনার বয়স পার করেছি। বাংলার ডিলান যখন এসেছে তখন মার্কিন আদি ডিলান শোনার দিন শেষ আমার। সুমন টানেনি, কারণ ওই রকম গান আমি আগে শুনে শেষ করেছি ইংরেজিতে, বাংলায় দরকার হয়নি। 

এটা পরিষ্কার- সুমন সুশীল বাঙালির গায়ক, রাজনীতিক। সমাজ সচেতন শুধু নন, রীতিমতো তৃণমূলের এমপি ছিলেন। যেমন- আমাদের মমতাজ বেগম আওয়ামী লীগের এমপি। তবে মমতাজের প্রধান শ্রোতা নাগরিক মধ্যবিত্ত নয়, গ্রামের মানুষ। অবশ্য ফিউশনের কল্যাণে ‘তুই লোকাল বাস’ ইত্যাদি নগরের নতুন ভাই- বোনেরাও শুনছে। 

আজকাল নস্টালজিয়া খুশখাস না করলে ডিলান শুনি না। ও আমার ভেতর আর নেই। আর সুমন তো ছিলই না; কিন্তু সুমন ঢাকার বাঙালি বাবুদের কাছে আধুনিক সংস্কৃতির গানের প্রতীক। তা হলে এরা কারা? তাকে ভালো লাগা মানুষদের ঠিকানা কী?

চার

আমার ছাত্র-ছাত্রীরা সুমন শোনে না, অনেকে নাম জানে না। তারা অন্য কিছু শোনে, এমনকি কোরিয়ান পপ-কপপ। তারা এই বাংলা ব্যান্ডের গান শোনে না; কিন্তু বিদেশি ব্যান্ড শোনে। তারা না শোনে ডিলান, না শোনে সুমন, না শোনে পিঙ্ক ফ্লয়েড। এক ছাত্রীর ভাষায়- ‘আব্বা-আম্মাদের গান’। এভাবেই কিন্তু বিজ্ঞাপন করে সারেগামা প্রতিষ্ঠানটি অনেক পুরনো গানের সাইটে। ওনাদের একটা সময় ছিল, আর নেই- এটা বোধহয় বাস্তবতা। ইতিহাস শ্রোতা তৈরি করে; ইতিহাস পাল্টায়, গায়ক পাল্টায়। 

পাঁচ

আমাদের সমাজের একটি বিশেষ বয়সের বিশেষ অংশ, সুশীল, সংস্কৃতিবান, বাঙালি ভাষা জাতীয়তাবাদীদের তিনি গায়ক; সবার নন। আমার ফেসবুকের মন্তব্য বেশ জমে উঠেছিল। বেশির ভাগ মানুষ ছিল সুমনভক্ত। কয়েকটি মন্তব্য উল্লেখ করি- একজন বলেন, ‘তিনি আমাদের কাছে কলকাতাকে নিয়ে আসেন।’ আর একজন, ‘তিনি একজন মানবিক বাঙালি।’ অন্য একজন বলেন, ‘যারা জনপ্রিয় বা যে গান জনপ্রিয় সেটা লিরিক্সের জন্যই। যেমন- সুমন।’ 

ভালো লাগার ভিত্তিগুলো মৌলিক। একজন মানবিক, বাঙালির লিরিক্সনির্ভর গান, যিনি বোনাস হিসেবে কলকাতার/বাঙালির চর্চাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসেন। কম- বেশি এই বৃত্তে সুমনকে অনেকটাই ধরা যায়। এসব গুণাবলী আমরা গানে খুঁজি, সবার কথা মতো প্রায় সবাই। অর্থাৎ কথাপ্রধান গান; কিন্তু সবাই কোন গান শোনে? 

ছয় 

আমি ইউটিউব ঘেঁটে যা পেলাম তাতে দেখা যায়- সুমনের টপ পাঁচটা গানের শ্রোতাসংখ্যা দশ লাখের মতো বা ১ মিলিয়ন। সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘তোমাকে চাই’ ১৫ লাখের কাছাকাছি; বেশ ভালো সংখ্যা। সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় জনপ্রিয় কথাটার নতুন মানে আছে আজকের গানের দুনিয়ায়। 

সাত 

অন্য বিষয় যেটা খেয়াল করলাম সেটা হলো- তার জনপ্রিয় গান রোমান্টিক, সমাজ সচেতন গানগুলো নয়। গানের দুনিয়া চলে প্রেমের টানে। বিপ্লব- বিদ্রোহ পরাজিত প্রেমের কাছে। 

তা হলে জনপ্রিয় কে আমাদের ‘বাঙালি’ সমাজে? প্রথম হচ্ছে- আরমান আলিফের ‘তুই অপরাধী’ গান, ৩৫০ মিলিয়ন বা সাড়ে তিন কোটি; মিনারের ‘ঝুম’, ৬৫ লাখ; লায়লার ‘সখি গো আমার মন ভাল না’, ৬৫ লাখ .... এই তালিকা বহুদূর যাবে। আসলে ‘জনপ্রিয়’ শব্দের সূচক পাল্টেছে অনেক। জনপ্রিয় হতে কথা লাগে, সুর লাগে, দর্শন লাগে। এর মধ্যে দুটি মিউজিক ভিডিও। আর লায়লা নিজেই খুব আকর্ষণীয়ভাবে গান করেন। তাদের আবেদন কেবল শহর নয়, গ্রামও। কেবল এপার নয়, ওইপারেও যায়। এখন আর সুশীল- মধ্যবিত্ত সমাজের রুচি নিয়ন্ত্রণ করে না, অনেকে করে। তারা অনেক কিসিমের আর তাদের পছন্দের পরিসর নানা রকম। গানের জগতে জনপ্রিয়তা প্রধান স্তম্ভ নয়, তবে জনপ্রিয়তার বাস্তবতায় এরাই প্রধান।

আট

আর আমি গানের কথা শুনি না তেমন, হয়তো আমার ছোটবেলার ধ্রুপদী গানের তালিমের জন্য এটা। আমরা সুর শিখেছি, লিরিক্স নয়। যে গানটি প্রতিদিন শুনি সেটার হিট মাত্র ১৫ হাজার ৫ বছরে। উস্তাদ গোলাম আলী খানের ‘গুজরি টোরি’ রাগের ওপর ঠুমরি, কথা বুঝি না একটাও। সুর, তাল আর গলার কারুকাজ উপভোগ করি এবং সাধকের মতো ধ্যান করে শুনি। 

একসময় কয়েকজন ছিলেন সমাজে গানের অধিপতি, এখন অনেকে। সবাই থাকুক গানে- সমাজে।

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //