আন্দোলনের রাজনীতি আর ধর্মঘটের সংস্কৃতি

মত থাকলে সহমত যেমন থাকবে ভিন্নমতও তেমনি থাকবে; কিন্তু বিরোধী শিবিরে থাকলে রাজপথের আন্দোলনে যত জোরের সাথে এই কথা বলা হয়, ক্ষমতায় গেলে ঠিক তত জোরের সাথেই বিরোধী মত দমন করাটা যেন বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রিক বুর্জোয়া রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্বশর্ত পরমত সহিষ্ণুতা। এটা না থাকলে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা হয়। 

রাজনীতি মানেই প্রতিযোগিতা এবং প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে; কিন্তু এর একটা সীমারেখা থাকা উচিত, যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতি নষ্ট না হয়। এই কথা সুশীল সমাজ ক্রমাগত বলে গেলেও কেউ তা মানছেন না। একদল বিভাগীয় সমাবেশ ডাকে আর সাথে সাথে পরিবহন ধর্মঘট হয়ে যাচ্ছে- এটি কোন ধরনের সংস্কৃতি। একেকটা বিভাগে ৮টা জেলা, বিভাগীয় সমাবেশে জেলা থেকে নেতা-কর্মীরা আসবে- এটাই তো স্বাভাবিক; কিন্তু পরিবহন ধর্মঘট হলে তাঁরা আসবে কীভাবে? এ যেন বাচ্চাদের ছায়ার সাথে দৌড়ানোর মতো। সুকুমার রায়ের ভাষায়- ‘ছায়ার সাথে কুস্তি লড়ে গাত্রে হলো ব্যথা।’ একপক্ষ সমাবেশ ডাকে তো অন্যদের ইশারায় পরিবহন ধর্মঘট এবং এ নিয়ে চলছে বিতর্ক। ওরা আগে করেছে তখন দোষ হয়নি তা হলে আমরা করলে দোষ হবে কেন? কে কার ঘাড়ে দোষ চাপাবে তার কৌশল চলছে। তবে কৌশল যা-ই হোক, আর যেই করুক, শেষ পর্যন্ত ঘাড়টা জনগণের এবং বোঝাটা বহন করতে হবে তাদেরই। সে বোঝা দুর্ভোগের, ভাড়া বৃদ্ধির, দ্রব্যমূল্যের অথবা পুলিশি হয়রানির এবং আরও অনেক কিছুর। 

একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সমাবেশ সামনে রেখে পরিবহন ধর্মঘট হচ্ছে প্রতিটি বিভাগে। মালিক সমিতি কি ধর্মঘট আহ্বান করতে পারে কিংবা শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘট আহ্বান করলে কী নিয়ম অনুসরণ করতে হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে ধর্মঘট হচ্ছে, বাস বন্ধ থাকছে এবং ময়মনসিংহ, খুলনার ধারাবাহিকতায় রংপুরের পর বরিশালেও ধর্মঘট হবে। মালিক সমিতির কেউ কেউ বলছেন- কেন ধর্মঘট ডাকা হয়েছে তা তো জানেন, তা হলে প্রশ্ন করেন কেন? ধর্মঘট আহ্বানকারীদের দাবিগুলো দেখলে বোঝা যায় এ হলো স্থায়ী দাবিতে অস্থায়ী কর্মসূচি। তাঁরা বলেছে, মহাসড়কে তিন চাকার অবৈধ যান ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল বন্ধ করতে হবে। এদের কারণে দুর্ঘটনা হয়, বাসমালিকরা যাত্রী পান না। ফলে এসব বন্ধ করতে হবে। যদি কেউ বলেন- একই দাবিতে ধর্মঘটের আহ্বান একটি বিশেষ দলের কর্মসূচির সময়েই কেন বারবার ডাকা হচ্ছে, সারাবছর কেন ডাকা হয় না? তা হলে কি সমাবেশ ও ধর্মঘটের মধ্যে যোগসূত্র আছে? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে সবসময় জোরের সাথে বলা হচ্ছে- এই ধর্মঘটের সাথে তাদের কেনো সম্পর্কই নেই। কী অদ্ভুত সম্পর্কহীন ঐক্য! 

হাইওয়ের এই ভয়াবহ(!) সমস্যার কারণে বাসমালিক সমিতির নেতারা খুবই পেরেশান এবং এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তাঁরা নাকি ধর্মঘট করছেন। জিজ্ঞাসা হতে পারে- এই দাবিতে আগে তাঁরা কী কী কর্মসূচি পালন করেছেন, সেক্ষেত্রে পুলিশ এবং প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল? যে কোনো চূড়ান্ত কর্মসূচিতে যাওয়ার আগে কিছু আন্দোলন তো হয়। সে রকম আন্দোলনের খবর কেউ জানেন কিনা তা জানা নেই। 

পরিস্থিতির ফল দেখে স্বাভাবিকভাবেই সমাবেশ আয়োজনকারীরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের গণসমাবেশে মানুষের স্রোত ঠেকাতে এই সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পরিবহনসংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, তাঁদের কিছু দাবিদাওয়া দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন; কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তাঁরা শেষ পর্যন্ত যানবাহন বন্ধ করে ‘আন্দোলন’ করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে দুঃখজনকভাবে তাঁদের এই আন্দোলন কাকতালীয়ভাবে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলের সমাবেশের আগের দিন থেকে সমাবেশের পরের দিন পর্যন্ত পড়ে গেছে। 

খুলনায় পরিবহন বন্ধের বিষয়ে বলতে গিয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেছিলেন, বাসমালিকরা কেন খুলনার বাস বন্ধ রেখেছেন, সে বিষয়ে তাঁরা আমাদের অফিশিয়ালি কিছু জানাননি। কোনো দাবিদাওয়াও উপস্থাপন করা হয়নি। আমরা এ ব্যাপারে জানি না। এর পাশাপাশি লঞ্চ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেওয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকরা। এখন কী অবস্থা তাদের আন্দোলনের, তা জানতে অনেকের কৌতূহল জেগে ওঠা অসম্ভব নয়। 

সরকার স্পর্শকাতর ১৯ সেক্টরে ধর্মঘট করার অধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছে। অত্যাবশ্যক পরিষেবা আইন ২০২২-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী সভাপতিত্ব করেছেন এই সভায়। এর আগে ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দিয়ে সরকার ঘোষণা করেছিল- জরুরি প্রয়োজনে বিদ্যুৎ, টেলিযোগাযোগ, পরিবহনসহ যে কোনো সেবাকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা’ ঘোষণা করতে পারবে। ‘অত্যাবশ্যক’ ঘোষণার পর সেখানে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকতে পারবে না, এমন কি মালিকরাও প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারবে না। এই ঘোষণা না মানলে দণ্ডের বিধান রেখে নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এই আইন অমান্য করলে দণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, কেউ ধর্মঘট করলে তাকে বরখাস্তসহ তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন ভাঙলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা ৬ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে। মালিক ভাঙলে এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হবে। কেউ আইন ভাঙতে প্ররোচিত করলে এক বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। একদিকে করোনা অভিঘাত, অন্যদিকে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি টালমাটাল, তখন বাস-ট্রেন-লঞ্চ বন্ধ করে রাখা অর্থনীতির জন্য বিরাট ধাক্কা বলে সরকার যখন বলে, তখন তার ইশারায় ধর্মঘট হলে দায়ী করবে কাকে? 

রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে- একথা সবাই বলেন; কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক সমাবেশের সময়ই পরিবহন ধর্মঘটের ঘটনা যে ঘটেই চলেছে, তা দেশের মানুষকে কী বার্তা দেবে? দলীয় কর্মী দিয়ে হামলা, মামলা, গ্রেফতারসহ ক্ষমতায় থাকলে সকল রকমে নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর এই সংস্কৃতির অবসান কি হবে? অতীতেও বিরোধী দলের কর্মসূচি বাধাগ্রস্ত করতে গাড়ি-ফেরি বন্ধের নানা নজীর আছে। সেই খারাপ নজীরগুলোই কি বর্তমানেও চর্চা হতে থাকবে? 

রাজনীতির মাঠে উত্তাপ বাড়ছে। দিনের তাপমাত্রা বাড়ে সূর্যের আলো বাড়ার সাথে সাথে আর রাজনীতির উত্তাপ বাড়ে নেতাদের কথার সাথে সাথে। যে ধরনের হুঙ্কার দিলে কর্মীরা চাঙ্গা হয় আর প্রতিপক্ষ চাপে থাকে, সে ধরনের উত্তেজক কথা বলা হচ্ছে প্রতিদিন। উত্তেজনা শুধু যুক্তি ভুলিয়ে দেয় তা-ই নয়, নিজেদের ওয়াদা ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও একটি বড় প্রতারণমূলক অস্ত্র এই উত্তেজনা সৃষ্টি। যে কাজ স্বৈরাচারী শাসক করেছিল সেই কাজ আমি করলে যে গণতান্ত্রিক হয় না- এই সাধারণ নৈতিক বিবেচনা কর্মীরা হারিয়ে ফেললে শুধু পাল্টাপাল্টি কথা চালাচালি হয় তাই নয়, গণতন্ত্রও পথ হারিয়ে ফেলে। সমাবেশকে উপলক্ষ করে ধর্মঘট ডাকায় শুধু গাড়ি, লঞ্চ বন্ধ হয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা-ই নয়, গণতন্ত্রের চর্চা কি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে না?


লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //