পাকিস্তানের আসন্ন নির্বাচন এবং ইমরান খানের লড়াই

ইতিহাসে খেলোয়াড় থেকে যারা রাজনীতিবিদ হয়েছেন, ইমরান আহমেদ খান নিয়াজি নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে সফলতমদের একজন। তার গড়ে তোলা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ খুব দ্রুতই পাকিস্তানের সফল রাজনৈতিক দলগুলোর একটি হয়ে উঠেছে, যেটির জন্ম হয়েছিলো মাত্র ১৯৯৬ সালে।

অবশ্য ১৯৯২ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বিশ্বকাপে জয়ী হলে এবং ইমরান দলের নেতৃত্বে থাকায় এই অর্জন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য ইমরান খান শুধু ভালো ক্রিকেটারই ছিলেন না, তার বিদ্যাবুদ্ধিও আছে। তিনি স্নাতক করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কিবল কলেজ থেকে।

তিনি পাকিস্তানের অন্যতম পরিষ্কার রাজনীতিবিদ। গদিতে বসে তিনি যথেচ্ছ চুরি-বাটপারি করেননি। ২০১৮ সালে ইমরান ও তার দল গণভোটে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং ইমরান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। 

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে একটি নোংরা ধারা আছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো যতই পরস্পরের বিরোধিতা করুক, একে অন্যের বিরুদ্ধে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করুক; নতুন কোনো দল তাদের ছাড়িয়ে যাবে, সেটা কেউ চাইবে না। সেইক্ষেত্রে বাঁধা দিতে তারা একাট্টা। ইমরান খানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে ইমরানের নিজের যে কোনো ভুলভ্রান্তি নেই, তা-ও বলা যাবে না। ইমরান খানকে বোঝার জন্য তার রাজনৈতিক দর্শন বোঝা জরুরি। 

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইসলাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাকিস্তানে ইসলামপন্থীদের তিনটি ধারা আছে। একটি কট্টর সালাফিপন্থী। এরা অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যে আল-কায়েদার পতনের পর এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এবং সেইসাথে আফগানিস্তানের তালেবানদের শক্তি বর্তমানে কিছুটা হ্রাস পাওয়াতে খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই।

দ্বিতীয় দলটি বুদ্ধিবৃত্তিক ইসলামপন্থী। তারা ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধকে অক্ষুণ্ন রেখে পাকিস্তানের আধুনিকায়নে বিশ্বাসী। এই ধারার মনোস্তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন কবি, দার্শনিক মুহাম্মদ ইকবাল। ইমরানের ওপর তার প্রভাব আছে। তবে ইমরানের চিন্তায় ইরানি দর্শনিক ও বুদ্ধিজীবী আলি শারিয়াতির প্রভাবও রয়েছে। ইসলামকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার আগে প্রথমে রাষ্ট্রভিত্তিক ইসলামের উত্থান জরুরি।

ফলে ইসলামপন্থী হয়েও আধুনিক ও আপাতত জাতীয়তাবাদী হওয়া দরকার। ইমরান খান এই ধারার অনুসারী। তৃতীয় দলটি সুবিধাবাদী। তারা মনে করেন, যেহেতু ইসলাম পাকিস্তানে জনপ্রিয়, তাই ইসলামকে ব্যবহার করতে হবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। ১৯৪৭ সাল থেকে এরাই পাকিস্তানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনেছে। পাকিস্তানের বিভাজন এবং বাঙালি নিধনের যে চক্রান্ত ১৯৭১ সালে হয়েছে, তার জন্যও এরাই দায়ী।

মনে পড়ে জার্মানিতে আমাকে এক পাকিস্তানি বোদ্ধা বলেছিলেন যে, এই দলের ঈশ্বর তিনজন, তিন ‘আ’: আল্লাহ, আর্মি ও আমেরিকা। তবে জানা যায়, ইমরানের প্রথম দিকের উত্থানেও পাকিস্তান আর্মি ও ইনটিলিজেন্সের হাত ছিলো। তবে সত্য এই যে, ইমরান পরে শুধু আর্মির সাহায্যের আশায় বসে থাকেননি।

অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়া পাকিস্তানকে আবার দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। তার আন্তরিকতাও ছিলো; কিন্তু তাতে যে তিনি খুব সফল হয়েছেন, তা বলা যাবে না। তবে তার দায় ইমরানের একার নয়। কোভিড-১৯ পাকিস্তানের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে আরও বিপর্যস্ত করেছে। চীনের কাছ থেকে সে নিয়েছে প্রচুর ঋণ। তা পাকিস্তান কীভাবে শোধ করবে, তারও কোনো সুস্পষ্ট ধারণা ইমরানসহ পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মাথায় নেই।

ফলে এ বছরের গোড়াতে স্বল্পমূল্যে তেল ও গ্যাসের জোগানের আশায় তিনি রুশ সফর করলে ও ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে দেখা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার রোষানলে পড়েন। পাকিস্তান সম্প্রতি ৬.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চীনের কাছে চেয়েছে। ইতিপূর্বে চীনের পাওনা তার কাছে ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সুরাহা কীভাবে হবে তা এক বড় প্রশ্ন সবার জন্য। 

ইমরানের সফলতাও আছে বেশকিছু। তিনি কাশ্মীর সীমান্তে ভারতের সাথে যে বিবাদ তা ভালোমতো সমঝোতায় আনতে পেরেছেন। চীনের সাথেও তিনি সম্পর্ক জোরদার করেছিলেন, ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের পরও। পাকিস্তানে সন্ত্রাসবিরোধী কাজেও ইমরান তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন; হাফেজ সাঈদ প্রতিষ্ঠিত জামাত-উদ-দাওয়া ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট ফালাহ-ই-ইনসানিয়াত ফাউন্ডেশনকে ২০১৯ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

এতে পশ্চিমে তার ভাবমূর্তি কিছুটা উজ্জ্বল হলেও তা আবার নিস্প্রভ হয়, যখন ২০২০ সালে তিনি আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠাতা ওসামা-বিন-লাদেনকে শহীদ বলে অভিহিত করেন। ইমরান খান মনে করেছিলেন তিনিই হবেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি তার পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করবেন; কিন্তু তা হয়নি। সেনাবাহিনী নানা কারণে তার প্রতি বিমুখ হয়েছে, বিশেষত একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের নিয়োগ কেন্দ্র করে।

রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্কের কারণে পশ্চিম হয়েছে তার প্রতি নাখোশ। এপ্রিলে জাতীয় সমাবেশে আইনপ্রণেতারা তার ওপর অনাস্থা জারি করলে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব হারান। অনেকে এর পেছনে পশ্চিমা মদদ আছে বলে মনে করেন; কিন্তু জনগণ এখনো তার সাথে আছে।

সম্প্রতি তাকে হত্যার চেষ্টাও হয়েছে। তিনি পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এর আগে স্পষ্টভাষী ইমরান পাকিস্তান ভাঙার কারণ স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করেন। তিনি ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিজয়ের পরও তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করাকে পাকিস্তান ভঙ্গের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধেরও তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এসব হঠকারিতা করেই কিছু রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনী পাকিস্তানের বিভাজনের কারণ হন।

সামনে পাকিস্তানের নির্বাচন। এতোকিছুর পরও ইমরান যে ক্ষমতায় ফেরত আসবেন, তা ভাবতে পাকিস্তানের বেশির ভাগ মানুষ আশাবাদী। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শুধু জনগণের ম্যান্ডেটই ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র উপায় নয়। তাই ইমরানের ভাগ্যে কী ঘটে, তা-ই এখন দেখার বিষয়।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //