২য় মৃত্যুবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

জাহিদ হোসেন মুসা স্মরণে

ব্রিটিশ আমল, ক্ষমতা হস্তান্তর, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিরাট বিরাট ঘটনার তিনি শুধু একজন প্রত্যক্ষদর্শী নন- একজন অংশগ্রহণকারী সংগঠক এবং নেতাও বটে। দীর্ঘ সময় ১৯৩২-২০২০। তিনি পরিণত হয়েছিলেন বৃহৎ এক আয়নায়।

জাহিদ হোসেন মুসা আমাদের অগ্রজ প্রিয় ‘মুসাভাই’ হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হলো-কথা হলো ১৯৬২ সালের একেবারে শেষে। মূলত ১৯৬৩ সালেই ঘনিষ্ঠতা। আয়ুবি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়েছে- এটাই আলোচনার মুখ্য বিষয়।

মুসা ভাই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। আমাদের প্রজন্ম থেকে দশ বছর আগের প্রজন্মের একজন সক্রিয় প্রভাবশালী নেতা। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ন্যাপ পর্যন্ত তিনি অন্যদের সঙ্গে নিয়ে ঝিনাইদহকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রামী ধারার নেতা-কর্মীদের এক গণতান্ত্রিক জোট।

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার- ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই ছিলেন পাকিস্তান কায়েম করার নেতা-কর্মী; কিন্তু বলতে গেলে বছর না ঘুরতেই প্রিয় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সাহসী-সংগ্রামী ছাত্ররা রুখে দাঁড়ালেন। ক্রমে এই সংগ্রাম ছাত্র-জনতার গণসংগ্রামে পরিণত হয়।

সংগ্রামের এই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হলো ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মুসলিম লীগকে জনতার রাজনৈতিক দলে পরিণত করার চেষ্টা হলো। মওলানা ভাসানী এই নতুন ধারার রাজনীতির প্রধান উদ্যোগী-নেতা। এর পর ফেলে দেওয়া হলো ‘মুসলিম’ শব্দটি। একটি  গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহক হওয়ার প্রত্যাশায় গঠন করা হলো ‘আওয়ামী লীগ’।

অর্থাৎ মুসলিম লীগের গণবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিপরীতে সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শক্তি দেশের মধ্যে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জনগণকে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, আর বিদেশিদের গোলামী নয় এবং প্রধানত হিন্দু জমিদার, জোতদার-মহাজনদের নিপীড়ন ও শোষণ থেকে বৃহত্তর কৃষকসমাজ মুক্তি পাবে; কিন্তু দেখা গেল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শক্তি ভারতকে বিভক্ত করে চলে গেল ঠিকই, তবে রেখে গেল তাদের উত্তরাধিকার। তখন রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যমণি ইংরেজদের জায়গায় প্রধানত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং হিন্দু জমিদার-জোতদারদের জায়গায় মুসলমান সামন্ত শোষকরা।

এ রকম একটা অবস্থায় ’৫৪-এর নির্বাচন। যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয় অর্জন করে; কিন্তু চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র এবং স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটল।

দেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলির যে রকম বিকাশ ঘটছিল, সেই জটিলতার মধ্যে জাহিদ হোসেন মুসাকে বেছে নিতে হচ্ছিল তিনি কোন ধারায় চলবেন। দেখা গেল তিনি যেমন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে চলা শুরু করলেন; তেমনি সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধিতাকে জোরের সঙ্গে আঁকড়ে ধরলেন। এ ব্যাপারে তাঁর বন্ধুরা ও মওলানা ভাসানী তাঁকে প্রভাবিত করেন এবং তিনিও তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক বিবেচনায় বর্ণিত পক্ষকেই শ্রেয় জ্ঞানে সঠিক মনে করলেন। রাজনীতির এই ধারাতেই তিনি অবিচল থাকতে চেয়েছেন- নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির জন্য যা প্রয়োজন, তা তাঁর ছিল।

জাতীয় রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকল। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে দুটি ধারা স্পষ্ট হতে শুরু করে। এ আভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল- প্রধানত নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বিরোধ। মওলানা ভাসানী ও দেশব্যাপী তাঁর সুযোগ্য সঙ্গীরা পূর্বপাকিস্তানসহ পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেছে। তা ছাড়া অত্যন্ত জোরের সঙ্গে তাঁরা এ দাবি করে যে, দুইশ বছর আমরা ব্রিটিশদের গোলামী করেছি, এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতে সে স্থান দখল করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী মার্কিন নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে কয়েকটি সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এতে পাকিস্তান জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর বন্ধুত্ব হারায়। ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত ও মিসরসহ অনেক রাষ্ট্রই তখন দুই পরাশক্তির বিপরীতে নিজেরাই জোট গঠনে ব্যস্ত। সংক্ষেপে এই হলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য যে দাবি, তার সার কথা।

ভেঙে গেল আওয়ামী লীগ

১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানী গড়লেন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)’। এই পার্টিরও নেতা হলেন জাহিদ হোসেন মুসা। মূলত যুক্তফ্রন্টের একজন বিশিষ্ট নেতা হিসেবে প্রধানত ঝিনাইদহ অঞ্চলে এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি বৃহত্তর (অবিভক্ত) যশোর জেলার একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত হন। তা ছাড়া ভাষা আন্দোলন থেকে ন্যাপ পর্যন্ত তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয় স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ হন।

প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত পাকিস্তানে ন্যাপ অতিদ্রুতগতিতে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। পশ্চিম পাকিস্তানেও গণবিরোধী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রগতিশীল শক্তির বড় অংশই ন্যাপের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে।

আর ঠিক এই সময় (১৯৫৮) পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করেন। সারাদেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মওলানা ভাসানীসহ বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী কারাবরণ করলেন।

সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে বিলম্ব হতে থাকল। আয়ুব খানের পেছনে যেমন একদঙ্গল কথিত রাজনীতিবিদ জড়ো হলো, তেমনি আয়ুববিরোধী হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যেও ছিল দ্বন্দ্ব। শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বে আয়ুববিরোধী আন্দোলনের শুরু। আর এ কারণেই ১৯৬২ সালে প্রথম মুসা ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ।

মুসা ভাই একজন পরিচ্ছন্ন পরিশীলিত রাজনীতিবিদ। মানুষ হিসেবে মিশুক, অমায়িক, বিনয়ী ও আন্তরিক; গণমানুষের আপনজন। তাঁর জন্ম হয়েছিল শিক্ষিত জমিদার পরিবারে। লক্ষ করা যায়- ’৫২ থেকে ’৬২ পর্যন্ত যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই এসেছিলেন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে। পাকিস্তানের বিভিন্ন পর্বে প্রকাশ্যে যেসব গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল সংগ্রামে ছিল, কমিউনিস্টরা তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ দুই দলেই অভ্যম্ভরে থেকেই তাঁরা গণআন্দোলনে শরিক হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা কম-বেশি বজায় ছিল।

মুসা ভাই স্কুলজীবন থেকেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। অগ্রগামী রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীনতা সুষ্ঠু গণআন্দোলনের পথে বড় বাধা। এ বিষয়ে তাঁর সচেতনতা ছিল উঁচু স্তরের।

মুসাভাই, আপনি না ফেরার জগতে পাড়ি দেওয়ার আগে সাধারণ মানুষের জন্য, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য যেসব স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ রয়েছে। উন্নয়নের সিংহভাগ আত্মসাৎ করেছে মুষ্টিমেয় মানুষের একটা শ্রেণি- অকল্পনীয় আয়বৈষম্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বিপদে ফেলেছে। নারী নির্যাতন, কর্মসংস্থানসহ নানাবিধ সমস্যা এখনো তীব্র। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের গণতন্ত্র ও পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আমরা অহঙ্কার করি; কিন্তু ১০ লাখ রোহিঙ্গা যখন বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা চরম নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকল, তখন আমাদের বৃহৎ বন্ধু চীন, রাশিয়া ও ভারত সরাসরি মিয়ানমারকে সমর্থন করে- এটাই এখন স্বপ্ন বাস্তবায়নের কেচ্ছা।


লেখক: প্রাবন্ধিক, সমুদ্র গবেষক ও যশোরের সাবেক রাজনীতিবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //