শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয়’ হলো কতটুকু

চলতি বছরের জুলাই মাসের শেষ দিকের ঘটনা। জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেয়।

তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ রাখার নির্দেশনা। যদিও সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা বিদ্যুৎ ব্যয় করে থাকে তার কোনো পরিসংখ্যান করা হয়েছে বলে জানা নেই।

তবে গ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদ্যুতের ব্যবহার নগণ্য আর শহরকেন্দ্রিক সিংহভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালে সীমিত আকারে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। তাই স্বভাবতই জিজ্ঞাসা আর কৌতূহল জাগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুদিনের ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে সরকার কতটা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে সক্ষম হলো? অন্য কোনো পন্থায় কি সাশ্রয় সম্ভব ছিল না! 

ক্ষমতাবানদের সন্তানরা হয় বিদেশে পড়তে যায়, না হলে দেশে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশোনা করে এবং তারপর বিদেশে পড়তে যায়। তাই এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানাবিধ কাটাছেঁড়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তন লক্ষণীয়ভাবে বেড়েই চলেছে। যার যখন যা মনে আসে কোনো রকম দেরি না করেই তা বলবৎ করে ফেলে।

মানসিক প্রস্ততি গ্রহণের জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের ন্যূনতম সময় দেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করে না। যেমন বলা যায়, সৃজনশীল পদ্ধতি একটা সাধু উদ্যোগ; কিন্তু সময় নিয়ে বাস্তবায়ন না করার কারণে জাতি এ পদ্ধতির সুফল পেয়েছে- এমন দাবি এখনো করা যায় না। একজন শিক্ষক, যিনি নিজে সৃজনশীল পদ্ধতির মধ্য দিয়ে আসেননি তিনি ৩-৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সৃজনশীল শিক্ষক হিসেবে তৈরি হয়ে যাবেন- এটা কি কোনোভাবেই সম্ভব?

সৃজনশীল এ পদ্ধতিতে যদি তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু করে আস্তে আস্তে ওপরের স্তরে ওঠা হতো তা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ে এ পদ্ধতি বুঝতে পারতেন এবং এর সুফল পাওয়া সম্ভব হতো। সৃজনশীল পদ্ধতি এখন গাইড বই আর কোচিং ব্যবস্থার মধ্যে আটকে গেছে। আবার নতুন শিক্ষাক্রম চালু হতে যাচ্ছে। পূর্ব ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এখানেও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিগ্রহণ দেখা যাচ্ছে না। শত শত কোটি টাকা ব্যয়ের এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণের খাতে কত শতাংশ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে তা জানলে সত্যিই অবাক হতে হয়। 

দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দেখা যায় নীতিনির্ধারকরা যখন যার যা মনে আসে তাই করার নির্দেশ জারি করে থাকেন। এক একটা নির্দেশ জারি হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা অস্থির হয়ে পড়েন। কী করতে হবে, কী করা উচিত- এসব ভাবনার চক্রব্যুহে পড়ে শিক্ষা শেষপর্যন্ত ব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে। তাই সরকার জ্বালানি সাশ্রয়ে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন করলেও শিক্ষার্থীদের কোনো ছুটি নেই। এই সাধারণ শিক্ষার্থীদের আসলে শনি-মঙ্গলবার বলে কিছু নেই।

ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছুটা বিদ্যুৎ সাশ্রয় হলেও কোচিং সেন্টারে বিদ্যুতের ব্যবহার বেড়েই যাবে। দেশে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বহুদিন আগেই উঠে গেছে, আর এখন নানাবিধ নতুন নির্দেশ ব্যবসাকে আরও ব্যাপকতা দিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। নতুনত্বের এ আমদানি প্রক্রিয়ায় শুধু শিক্ষকরাই নয়, সংশ্লিষ্টরা আরও অনেক বেশি ব্যবসায় নিবেদিত হতে পারে, দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে পারে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি- করোনাকালের দুই বছরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে কোনো ক্ষতি হয়নি বরং তারা স্বশিক্ষায় অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। দেশের অভিভাবকরা ভালোই জানেন সন্তানদের স্বশিক্ষায় অভিজ্ঞতা অর্জনে তাদের কী করতে হয়েছে? এক মাস-দুই মাস করে ছুটি বাড়ানোর কারণে মূলত শিক্ষার্থীরা কোনো ছুটিই ভোগ করতে পারেনি।

সে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে শিক্ষার্থীদের করোনাকালে কোনো ক্ষতিই হয়নি। পাশাপাশি রয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে শতভাগ পাস এবং অটো প্রমোশনের সিদ্ধান্ত। এখানেই শেষ নয়, প্রাগুক্ত সবকিছুর পাশাপাশি রয়েছে আরও কিছু বাস্তবায়ন করা সিদ্ধান্ত। যেমন- কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে মাস্টার্স সমমানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

প্রগতিশীল লেখকদের গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার শিক্ষার্থীদের ধর্মবিশ্বাসী করে তোলার উপযোগী গল্প-কবিতা পাঠ্যবইয়ে সংযোজন হয়েছে। ৪ বছর মেয়াদি পলিটেকনিক শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের দারিদ্র্য ও মেধা বিবেচনায় ৩ বছরে রূপান্তরের ঘোষণা হয়েছে। 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন করায় কিছু শিক্ষক হয়তো খুশি হয়েছেন। দেশে শিক্ষাসহ জরুরি সেবা বিভাগের কর্মকর্তারা করোনার দীর্ঘ সময় সুবিধাবঞ্চিত হয়েছেন। তবে দেশের মানুষ আশা করে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা ঢাকা ওয়াসার মতো হবে, যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন লাগে ২৭ কোটি টাকা আর শুধু কর্মচারীদের ওভারটাইম বিল লাগে তার দ্বিগুণ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে দুদিন বন্ধ রেখে কত বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়েছে জানি না; কিন্তু করোনার দীর্ঘ ছুটির পর শিক্ষার্থীরা বা শিক্ষাব্যবস্থা পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। 

স্বাধীনতার পর থেকে অতীতের ধারাবাহিকতায় সব সরকার শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিত; কিন্তু শিক্ষার উন্নয়নে যা সব থেকে বেশি প্রয়োজন সেই শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা কোনো সরকারই অনুভব করেনি। ১৯৭২ সালে যে পরিমাণ অর্থ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল তা প্রতিনিয়ত শতাংশ হারে কমেছে। ফলে শিক্ষা দিন দিন মানহীন হয়ে পড়ছে।

ঐতিহ্যের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন আর বিশ্ব তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষা আইন গত এক যুগের বেশি সময় ধরে লাটিমের মতো ঘুরছে। শিক্ষা আইন কতটা ব্যবসায়িক হবে এবং ক্ষমতার দণ্ড কার হাতে থাকবে সেই টানাটানির মধ্যেই আইনটি ফেলে রাখা হয়েছে। শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেলের কথা কেউ আর মনে করতে চায় বলে মনে হয় না।

শিক্ষার উন্নয়নে সরকার আন্তরিক হলে স্বপ্নে পাওয়া পথে নয়, দেশের জ্ঞানী-গুণী শিক্ষাবিদদের সাথে বসে পরিকল্পনা করা জরুরি। সেই পরিকল্পনায় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, সুষ্ঠু ও সুন্দর শিক্ষা আইন, শিক্ষা বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষার মানোন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //