আফতাব-শ্রদ্ধা মার্ডার কেস : লিভ-টুগেদার এবং সমাজ

ইন্ডিয়ার এই মার্ডার কেস সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। আফতাব নামের এক ভারতীয় যুবক তার লিভ-ইন পার্টনার শ্রদ্ধাকে খুন করে দেহ টুকরা করে ফ্রিজে রেখে দেয়। এক সময় শ্রদ্ধার পরিবার অভিযোগ করে যে, মেয়ের কোনো খবর নেই। সেটার সূত্র থেকে পুলিশ আফতাবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

মিডিয়ায় রিপোর্ট অনুযায়ী সে বলে যে তাদের ঝগড়া হয়েছিল ঠিক; কিন্তু শ্রদ্ধা বেরিয়ে যায়। শ্রদ্ধা কই সে জানে না- এসব কথা ছিল তার সাফাই দেওয়ার পূর্বপরিকল্পনার অংশ। 

দুই.

বেঙ্গালোরের এক বারে আফতাব মাতাল অবস্থায় অনেককিছু বলে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে। সেটা পুলিশের কাছে পৌঁছায়। তারা নজরদারিতে রাখে, তার পর একসময় মজবুত তথ্য নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আবার। এক পর্যায় সে ভেঙে পড়ে এবং সব স্বীকার করে। গ্রেপ্তারের পর তার কথা ধরে ফ্রিজ থেকে শ্রদ্ধার দেহের খণ্ডিত অংশগুলো উদ্ধার করে। গোটা ইন্ডিয়া তো বটেই, পুরা দক্ষিণ এশিয়াতে এটা তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সেটা কেবল এর ভয়াবহতা নিয়ে নয়, এর সামাজিক দিকও আসছে আলোচনায়। 

তিন.

কয়েকটি বিষয় নিয়ে ভারতীয় মিডিয়াতে বেশি আলাপ হচ্ছে। প্রথমত লিভ-টুগেদার করার ভালো-মন্দ। একালের জীবনযাপন ধারা বা লাইফস্টাইল। দ্বিতীয়ত হিন্দু-মুসলমানের মেলামেশা। তবে আলোচনা হচ্ছে- এমনটা বলা যায় কম। বেশিরভাগ হচ্ছে দোষারোপ, গালি আর তিরস্কার। খুনের পক্ষে কেউ নেই; কিন্তু অন্য সব বিষয়ে একাধিক মত রয়েছে। বোঝা যায় একটি ঘটনার কত ডাইমেনশন থাকে। 

চার.

ইন্ডিয়ার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সুশীল-সমাজে লিভ-টুগেদার রাখঢাকের বিষয় নয় আজকাল। অনেকটাই সমাজে স্বীকৃত। কেউ কেউ নাক সিটকালেও আসলে এটা আর তেমন বিষয় নয়। যেসব গবেষণা আছে তাতে দেখা যাচ্ছে- এর শুধু আইনি স্বীকৃতি যে আছে, তা-ই নয়, সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতাও ব্যাপক। এটা এমন কিছু মনে করে না দেশের মধ্যবিত্ত নাগরিক-সমাজের মানুষ। তবে সমাজের সবাই নয়, প্রায় ৩০% মানুষ এটা অপছন্দ করে, বিবাহ নয় কেন- এটাই প্রশ্ন। এটা ইন্ডিয়াতে ধর্মভিত্তিক ইস্যুতে নয়, সামাজিক। আমাদের ঢাকাতেও লিভ-টুগেদার করা এক শ্রেণির মধ্যে বেশ চালু আছে। 

পাঁচ. 

সনাতনী ভাবনার সিলসিলাটা সহজ। সম্পর্ক= বিবাহ= পরিবার। যদি সমাজের ভিত্তি তা-ই হয়, তা হলে বুঝতে হবে সমাজ দুর্বল হচ্ছে, কারণ বিবাহ অত সবল নেই; পরকীয়া একটা বাস্তবতা আজকের সমাজে। যারা লিভ-টুগেদার অপছন্দ করেন, তারা অনেকেরই চিন্তা- সমাজের কী হবে। অবশ্য তার সাথে আছে কনজারভেটিভ অংশ, যারা মনে করে বিবাহ বাদে কোনো সম্পর্ক থাকা ঠিক নয়; কিন্তু যে সমাজ কেবল বিয়েকেই বৈধ সম্পর্ক মনে করেছে, সে সমাজ কি আছে?

ছয়.

বিবাহ, খুনের মতো বহু মাত্রিক। অতএব শুধু সামাজিক বিশ্বাস একে ধরে রাখতে পারে না। বিবাহ অনেক কাজ করে একসাথে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, দৈহিক, গার্হস্থ্য, যোগাযোগকেন্দ্রিক। আরও অনেক চাহিদা মেটায়। তবে আগে যেটা কেবল বৈবাহিক পরিসর মেটাতে পারতো, সেটা বিয়ে ছাড়াই সম্ভব আজকাল। অতএব এটা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান; কিন্তু একমাত্র নয়। বিবাহের সাম্প্রতিক দুর্বলতার এটি অন্যতম কারণ।

পরিবার ছাড়াও নিরাপত্তা দেওয়ার/পাওয়ার আরও সুযোগ আছে সমাজে। অর্থনীতিতে, নৈতিকতার পারিসরেই। তাই বিবাহের বিকল্প এসেছে; একাও থাকা যায়। তাই অনেকের কাছে এটা মেনে নেওয়ার ব্যাপার, ভালো-মন্দের নয়।

সাত.

তবে এটাও ঠিক যে, লিভ-ইন সম্পর্ক বেশি টেকে না। পশ্চিমা দেশে প্রায় ৫০% বিবাহ বিচ্ছেদ হয়; কিন্তু লিভ-ইন ভাঙে ৯০%। পরকীয়ার সম্পর্ক থেকে বিবাহ হলেও প্রায় ৯৫% টেকে না। এর নানা কারণ আছে, তবে সম্পর্কে কমিটমেন্ট একটা বিষয়, যেটা গুরুত্বপূর্ণ- বলেন গবেষকরা। জীবনের পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব মেনে নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে, এমনকি নৈতিকতারও; কিন্তু অনেক মানুষ এই সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নানা কারণে- এটাও বাস্তবতা। তা ছাড়া বর্তমানে যেসব আর্থসামাজিক চাহিদা আছে সেটা বিবাহ। পরিবার একমাত্র সাপ্লায়ার নয়। বিবাহ ব্যক্তিগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে, সামাজিক নয়। সেটা লিভ-টুগেদার হোক, বিবাহ হোক বা অন্য কিছু; কিন্তু এই পাল্টানো সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে শান্তিতে থাকার কৌশল মানুষের জানা নেই।

আট.

যে কারণে ভারতীয় মিডিয়াতে লিভ-টুগেদারকে গালি দিয়েছে, হিন্দু মেয়েদের সাথে মুসলমানদের মেলামেশা নিষিদ্ধ পর্যন্ত করতে বলেছে; তার কারণ একই। অনিশ্চিত বর্তমান, অনিশ্চিত আগামী। অর্থনৈতিক উন্নতি মানে নিশ্চয়তা বা স্বস্তি নয়। মানুষ সকল ক্ষেত্রে অস্থির এবং ঘুরপাক খাচ্ছে পথের খোঁজে। এই খুনি আফতাবের সাথে অনেক মেয়ের পরিচয় ছিল, যেটা নিয়ে ঝামেলার এক পর্যায় সে খুন করে শ্রদ্ধাকে। তার পরও অনেক মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক হয়। প্রাক্তনের খণ্ডিত শরীরের অংশ ফ্রিজে রেখেই সে তাদের সাথে মিলিত হতো তার ঘরে। ধর্ম বা নৈতিকতা শিক্ষা দিয়ে কোনো লাভ হয়নি কোথাও, ইতিহাসে এসব ব্যবহার কমতেও দেখা যায়নি।

নয়.

কিন্তু আমরা মানতে চাইনা যে, অতীত সুখী ছিল না, মানুষের আর্থসামাজিক চাহিদা মিটতো না। আমরা কাদায় গেড়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত যেটাকে ‘স্বস্তি’ বলি, সেটা ছিল কেবল অল্প কিছু মানুষের জন্য। দারিদ্র্যের চেয়ে বড় দানব আর কেউ নেই, যেটা পৃথিবী থেকে অনেকটাই চলে গেছে এখন। তার বদলে নতুন দানব এসেছে, তবে এটা সামলানোর দায়িত্ব আমাদের নিজের কাছে। নিজে সবল হওয়া প্রয়োজন সমাজ বা সরকারের ওপর নির্ভর না করে। তাই অতীতে কী ছিল ভেবে বর্তমানের সমাধান হবে না। সমাজের ভয়ে মানুষ কিছু খারাপ কাজ করে, কিছু ভালো কাজ করে। তবে সেই সমাজ কেমন দেখতে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় চলবে- সেটা আমাদের নিজস্ব বিষয়। সেটা জানি না বোধ হয়।

দশ. 

আগের দিনে মহাসমাজের বদলে এখন ছোট ছোট একাধিক সমাজ চালু হয়েছে, যারা জোটের মতো একসাথে থাকে। যে যাতে আছে সেটার দিকে নজর দেওয়া উচিত। কেবল একটিমাত্র ভালো-মন্দের কাঠামো সবার জন্য থাকবে- সেই জামানা শেষ। এখন হাজার ভালো-মন্দের কাল। সেই ভাণ্ডারে নিজেরটা নিজেকেই চিনে নিতে হবে। শান্তি বহুবিধ, সন্ধান তেমনি।


লেখক: সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //