রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা-সংগ্রাম

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তাকে ‘শেখ মুজিব’ বা ‘শেখ সাহেব’ বলে ডাকত, পরবর্তীকালে তিনি হয়ে গেলেন ‘বঙ্গবন্ধু’।

তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান হওয়ার পর আওয়ামী লীগ গঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, পরে এক সময় তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হন। দলের নেতৃত্ব পেয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে সোচ্চার হন। বাঙালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিমাতাসুলভ আচরণের তথ্যচিত্র প্রচার করে তিনি বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলেন, বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ভাবনায় আন্দোলিত হতে থাকে।

বাঙালি জাতির সঙ্গে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা বাস্তবায়নের প্রস্তাব উত্থাপন করেন; এতেই  তিনি হয়ে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূল। তারা বুঝতে পারল, শেখ মুজিবকে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না, তাকে শেষ করা না গেলে তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। নির্মাণ করা হলো ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’, দেশদ্রোহী করে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১৯৬৮ সালে মামলা ঠুকে দেওয়া হলো। এই মামলার লক্ষ্য ছিল, শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে লটকানো, ঊনসত্তরে গণ-অভ্যুত্থান না হলে ঠিকই লটকিয়ে দিত। 

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী; কিন্তু ১৯৫৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। শেখ মুজিব যখন জেলে, গণ-আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন মওলানা ভাসানী। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগের কাগমারী সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলে তিনি তাদের বিদায় জানিয়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনের পূর্বে তিনিও বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র  মামলার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে শেখ মুজিবসহ সকল আসামিকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। শেখ মুজিব সবসময়ই ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং ভাসানীও মুজিবকে স্নেহ করতেন। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত ধর্মীয় নেতা; ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করার যে পাঁয়তারা চলছিল তার জোর প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। কিন্তু ভাসানীকে বোঝা যেত না, তিনি কোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারতেন না। তিনি একদিকে মওলানা, অন্যদিকে বামপন্থি।

চীনপন্থি সমাজতন্ত্রী ছিলেন বলে ভাসানী এক সময় চীনের বন্ধু আইয়ুব খানের সমর্থকও ছিলেন, ঊনসত্তরে আবার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তার দলের সেক্রেটারি মশিউর রহমান যাদু মিয়া দালাল আইনে জেলে যান, আর ভাসানী দালাল আইন বাতিলের জন্য বঙ্গবন্ধুকে আল্টিমেটাম দেন। সারাজীবন তিনি মেহনতি জনতার পক্ষে কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা বলেছেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন: কিন্তু অসম্প্রদায়িক এই নেতা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোরআন সুন্নাহর ভিত্তিতে দেশ শাসনের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচন এলেই তার স্লোগান ছিল, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’; কিন্তু ভাতের ব্যবস্থা করবে কে? স্বাধীন বাংলাদেশে অবস্থান করে তিনি ভুট্টো এবং ইসলামপান্থদের হাতে সৃষ্ট ‘মুসলিম বাংলা’র জন্য দোয়াও করেছিলেন।  

বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন এবং বিশ্বাস করতেন বলেই ইয়াহিয়া খানের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের অধীনেও ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলার সুযোগ পায়নি। নির্বাচনে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তান আর একত্রে থাকবে না; কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটাররা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভোট দিয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা শুধু আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় জনসংখ্যা কম থাকায় ৩০০টি আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১৬২টি আসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১৩৮টি আসন বরাদ্দ ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়ী হয় এবং ভুট্টোর পিপলস পার্টি পায় ৮১টি আসন। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে ৮টি আসনে মনোনয়ন দিলেও ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনেও মনোনয়ন দেননি। আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানে মনোনয়ন দিলেও সবগুলো আসনে পরাজিত  হয়। জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগ সামরিক সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় অঞ্চলে মনোনয়ন দিলেও উভয় দলের শোচনীয় পরাজয় হয়, উভয় দল পূর্ব পাকিস্তানে একটি আসনও পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে যে দুটি আসনে আওয়ামী লীগ হেরে যায় তার একটিতে পিডিপি এবং অন্যটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করে। 

ভোটারদের এই বিভাজনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান আর এক থাকবে না। তিনশ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয়লাভ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। অন্যদিকে ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১ আসন পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী কল্পনাও করেনি যে, আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন; ভুট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে শুরু হলো অধিবেশন বানচালের ষড়যন্ত্র।

অভিজাত মুসলমানিত্বে অহঙ্কারী পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালির শাসন মানতে কোনোভাবেই সম্মত ছিল না। ভুট্টোকে দিয়ে তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে দিল। ভুট্টো হুমকির পর হুমকি দিতে লাগল, আওয়ামী লীগ তার সঙ্গে সমঝোতা না করলে তিনি অধিবেশনে যোগ দেবেন না বলে হুমকি দিলেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া ভুট্টোর হুমকিকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলেন। এই ঘোষণাই বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ঠেলে দিল, শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। ইংরেজদের তাড়ানোর জন্য মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলেনের সূচনা করলেও তা সফল হয়নি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান স্থবির হয়ে যায়, পুরা দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হতে থাকে। 

ইয়াহিয়া এবং ভুট্টোর দুরভিসন্ধি বাঙালিদের উত্তেজিত করে তোলে। জনতা রাস্তা-ঘাটে স্লোগান দিতে থাকল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। এলো ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। বাঙালির প্রত্যাশা ছিল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। রাজনীতি করতে করতে শেখ মুজিব ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়েছিলেন; তিনি এমন কৌশলে কথা বললেন, সামরিক শাসক তাকে বিচ্ছিন্নতার দায়ে দায়ী করতে পারল না, অথচ জনতা বুঝে গেল যে, স্বাধীনতার সংগ্রাম অপরিহার্য এবং সেজন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। ভাষণে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল উদ্দীপনাময় অথচ সংযত। শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পরিস্থিতি হয়ে ওঠে আরও অগ্নিগর্ভ। ১৯ মিনিটের এই ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ইউনেস্কো ২০১৭ সালে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যে নথিভুক্ত করে। পৃথিবীর অনেকগুলো ভাষায় এই ভাষণটি অনূদিত হয়েছে। 

১৬ মার্চ থেকে শুরু হলো মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক, মার্চের ২৪ তারিখ পর্যন্ত আলোচনা চললেও কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারলেন না; কারণ সময় ক্ষেপণ করাই ছিল ইয়াহিয়া খানের মুখ্য উদ্দেশ্য। আলোচনা চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে হাজার হাজার সৈন্য ও জাহাজ ভরতি অস্ত্র আনা হলো। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার একান্নতম জন্মদিনে বলেন, ‘এ দেশে জন্মদিনই বা কী, মৃত্যুদিনই বা কী, আমার জনগণই আমার জীবন’। ইয়াহিয়া খান আলোচনা বাদ দিয়ে গোপনে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করেন, ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় শুরু হয় ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা। পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালায় ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তরে; ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে সেই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক হলসহ ঢাকার সর্বত্র নিরস্ত্র জনতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। 

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করে দেশবাসীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর এই বার্তা  তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেস যোগে প্রচার করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন যে, পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বরে এই বার্তাটি ভেসে আসে। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তাটি ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা নেন। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। পরদিন ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান একই বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথমে নিজের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারেন যে, তার এই ঘোষণা বাঙালি সেনাবাহিনীর কাছে উদ্দীপনামূলক হলেও সাধারণ জনতার কাছে তার ভাষণের কোনো আবেদন থাকবে না, কারণ সেই সময়ে জনতার কাছে তিনি অপরিচিত, দীর্ঘদিন ধরে চলা স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতাও ছিল না।

এছাড়াও জাতীয় সংসদের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে পারেন। অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের পরামর্শে তার এই উপলব্ধি থেকেই তিনি পরক্ষণে বঙ্গবন্ধুর নামে আবার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন বলেই তিনি তার লেখা ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ বলে উল্লেখ করেছেন। 

বাঙালিরা ভারত এবং রাশিয়ার সহযোগিতায় পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নয় মাস যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে, স্বাধীনতার জন্য নির্বিচারে জীবন দিয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে, তবুও তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র অনুপ্রেরণা। ইয়াহিয়া খান সামারিক ট্রায়ালে বঙ্গবন্ধুর ফাঁসি নিশ্চিত করে কবরও খুঁড়ে রেখেছিলেন, কিন্তু ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলানোর কাজ কিছুদিনের জন্য স্থগিত হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করলে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখতে ভুট্টো মরিয়া হয়ে ওঠেন; জেলখানা থেকে দ্রুত বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে নেন, কারণ জেলখানা ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির বাড়ির কাছে, জেলখানার কর্মচারীদের মধ্যে প্রায় সবাই ছিল নিয়াজির এলাকার, সেনাপ্রধান নিয়াজি এবং এক লক্ষের মতো পাকিস্তানি সেনার অবমাননাকর আত্মসমর্পণের জন্য তারা বঙ্গবন্ধুকে দায়ী করছিল।

পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের পর ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন এবং একটি সমঝোতার প্রত্যাশায় বঙ্গবন্ধুকে তোয়াজ করতে থাকেন। এই প্রত্যাশায় ভুট্টো ইরানকে মধ্যস্থতা করতে নিয়োজিত করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে ইরান হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তনের অনুরোধ করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। কিন্তু ভুট্টো নিজেকেও রক্ষা করতে পারেননি। পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তান ভাঙার আক্রোশে ভুট্টোকে পরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন। 

বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা পূর্বে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুর আগমন সম্পর্কে পাকিস্তান থেকে জানতে পারে। পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। মহিউদ্দিন আহমদ ১ আগস্ট পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনে ট্রাফলগার স্কয়ারে প্রবাসী বাঙালির এক বিরাট সমাবেশে বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেছিলেন। এই মহিউদ্দিন আমার সহোদর ভাই বিধায় আমাদের পরিবার তাকে নিয়ে গর্বিত। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না, তাই বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।


লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //