করিডর নাকি ট্রানজিট!

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত স্বাধীন হলে ভারত থেকে আলাদা হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিমের এমন দুটি অঞ্চল নিয়ে, যার একটির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব ছিল ১২শ মাইল, মাঝখানে হলো ভারতীয় ভূখণ্ড।

এরকম বিশাল দূরত্বে বিচ্ছিন্ন দুই অঞ্চল নিয়ে একটি রাষ্ট্র হওয়ার নজির আধুনিক বিশ্বে আর কোথাও ছিল না, এখনো নেই। এই বিরল এবং খুবই অস্বাভাবিক ঘটনাটি ঘটেছিল ভারতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ব্রিটিশ- এই তিন পক্ষেরই সম্মতিক্রমে। 

সেই স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে (১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে) পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে একটি স্থল-যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ৮০০ মাইলের একটি সরু যোগাযোগ পথ (করিডর) চেয়েছিলেন।

কিন্তু নেহরু তা কোনোভাবেই দিতে রাজি হননি। তার যুক্তি ছিল, এটা দেওয়ার অর্থ হলো ভারতের ভূখণ্ডে পাকিস্তানকে করিডর দেওয়া, আর করিডর দেওয়ার অর্থ হলো ভারতের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি-স্বরূপ।

এ ক্ষেত্রে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই মনে করেন, নেহরু তার দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে পাকিস্তানকে তার ভূখণ্ডে করিডর না দিয়ে সঠিক কাজটিই করেছিলেন। তাছাড়া সেটি আরেক অর্থে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ববাংলার জন্যও এক সুদূরপ্রসারী রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল।

কারণ করিডরের মাধ্যমে পূর্ববাংলার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সরাসরি স্থলযোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করা আমাদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যেত। 

এ থেকে প্রমাণ হয় যে, এক রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে আরেক রাষ্ট্রের করিডর দেওয়ার বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং নানা দিক দিয়েই তা বিপজ্জনক। এটি রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দিক থেকেও বিপজ্জনক। 

দুই

এই প্রসঙ্গটি এখানে তোলা হলো এ কারণে যে, ৪৮ সালে ভারত যেখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার কথা ভেবে তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানকে করিডর দেয়নি, সেখানে সত্তর বছর পর, কোনো আগ-পাছ না ভেবেই আমরা বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর, সম্প্রসারণবাদী চরিত্রসম্পন্ন আঞ্চলিক পরাশক্তি রাষ্ট্র ভারতকে তার এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে (তাও আবার খুবই এক গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে) অবাধে যাতায়াতের জন্য করিডর দিয়েছি। 

ভারতকে করিডর দেওয়ার সম্ভবত প্রথম কারণ এই যে, আমরা শুধু অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক লাভালাভের বিষয়টিকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। কিন্তু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক লাভালাভের বিষয়টি যে এতই গৌণ, যা নাকের বদলে নরুণ পাওয়ার শামিল, একথা আমরা চিন্তা করিনি।

অর্থাৎ করিডরের মধ্যে যে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব এবং এরকম আরও অনেক বিপদের বিষয় থাকতে পারে অথবা সেরকম কোনো আশঙ্কাও যে থাকতে পারে তা চিন্তা করিনি আমরা। ভারতকে করিডর দেওয়ার সপক্ষে দ্বিতীয় কারণ ও যুক্তি সম্ভবত এই যে, ৪৮ সালে পাকিস্তান তো ছিল ভারতের শত্রুরাষ্ট্র, তাই পাকিস্তানকে ভারত করিডর দেয়নি। কিন্তু আজ ভারত আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র, তাই আমরা চোখ বুজে করিডর দিতে পারি। 

করিডর দেওয়ার সপক্ষে তৃতীয় যুক্তিটি মনে হয় এই যে, আমরা মনে করি, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ‘চিরকালের’। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি এসবের ধার ধারে না। রাজনীতি চলে দ্বন্দ্বতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী। এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক তৈরি হয় সেটিও দ্বন্দ্বতত্ত্বের নিয়ম অনুসারেই।

সেই প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে যে আমাদের শুধু বন্ধুত্ব নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা টানাপড়েনের সম্পর্কও থাকতে পারে, এমনকি নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও থাকতে পারে- এসব যেন আমাদের ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। অনেকে হয়তো বলতে চাইবেন যে, ভারতের সঙ্গে আমাদের নিবিড় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা ভুল, অর্থহীন, নৈরাশ্যবাদী।

দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে অনেকে এমন কথাও বলে থাকেন যে, ভারত চিরকালের জন্য আমাদের শুধু সাধারণ বন্ধুই নয়, একাধারে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বেরও বন্ধু। তাই ভারত না চাইলেও আমাদের করিডর দেওয়া উচিত। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসময় ভাষা আর যা-ই হোক, কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজনীতির ভাষা হতে পারে না।

একটি রাষ্ট্রের রাজনীতি, কূটনীতি, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপার সেই রাষ্ট্রের একান্তই নিজস্ব। অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে তা শেয়ার করার ব্যাপার নয়। এজন্যই রাষ্ট্রের নিজস্ব রাজনীতি, কূটনীতি, সেনাবাহিনী-গোয়েন্দাবাহিনী-সীমান্তরক্ষাবাহিনী থাকে। 

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায়, সাধারণভাবে এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের শত্রু অথবা সম্ভাব্য শত্রু বলে গণ্য করা হয়। তবুও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্টতা ও শান্তিরক্ষার স্বার্থে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তা হয় সমঅধিকারের ভিত্তিতে। তবে গ্লোবাল ও আঞ্চলিক রাজনীতির জটিল টানাপড়েনের কারণে আজকের বন্ধুরাষ্ট্র আগামীতে শত্রুরাষ্ট্র হতে পারে।

আজকে আমরা যে ভারতকে আমাদের ভূখণ্ডে করিডর দিয়ে দিলাম- সুদূর কিংবা অদূরভবিষ্যতে চীন ও ভারতের মধ্যে অথবা চীন ও আমেরিকার মধ্যে যদি বড় ধরনের কোনো সংঘাত বাধে (আর ভারত যদি আমেরিকার পক্ষ নেয়) এবং সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যদি কারও সঙ্গেই কোনো সংঘর্ষে জড়াতে না চায়, সে ক্ষেত্রে চীনকে প্রতিহত করার জন্য ভারতীয় বাহিনী করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকে চীনাবিরোধী সামরিক ঘাঁটি বানাবে না তার নিশ্চয়তা কী?

এছাড়াও ভারতের সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্যের জনগণের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব-সংঘাত কখনো যদি চরম আকার ধারণ করে, তাহলে করিডরের কারণে সেটিও হবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এই সবকিছুর বিচার-বিবেচনা না করে আমরা ভারতকে করিডর দিয়ে দিলাম। তাও আবার সত্তর বছর আগে ভারত যেখানে পাকিস্তানকে একটিমাত্র সরু পথেও করিডর দেয়নি, সেখানে ভারতকে আমরা করিডর দিলাম একটিমাত্র সরুপথ দিয়ে নয়, সেটি দিলাম- জলে, স্থলে, অন্তরিক্ষে বাসে, ট্রাকে, নৌযানে, রেলপথে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম সবদিকে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। যার ফলে বলা যায়, বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে ভারতের ‘করিডর রাষ্ট্রে’। 

তিন 

প্রসঙ্গত আরও একটি গুরুতর বিষয় এখানে তুলে ধরা প্রয়োজন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতকে আত্মঘাতী করিডর দেওয়ার বিষয়টিকে দেশের সাধারণ জনগণের কাছে গ্রহণীয় ও সহনীয় করে তোলার জন্য সকলে মিলে আমরা কোরাসের মতো করে করিডরকে বলছি ও প্রচার করছি ‘ট্রানজিট’ বলে। অথচ আমরা সকলেই জানি, ট্রানজিট ও করিডর কোনোভাবেই এক জিনিস নয়।

ট্রানজিট হলো কোনো দেশের (যেমন ভারতের) কোনো মালামাল বাংলাদেশের ভূখণ্ড হয়ে তৃতীয় কোনো দেশে (যেমন মিয়ানমারে) প্রবেশ করা, অথবা বাংলাদেশের কোনো মালামাল ভারতের ভূখণ্ড হয়ে নেপালে প্রবেশ করা। কিন্তু ভারতের কোনো মালামাল বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে ভারতেরই অন্য কোনো অঞ্চলে প্রবেশ করার নাম ট্রানজিট নয়, করিডর। অথচ আমরা সবাই মিলে এই করিডরকে সর্বত্র প্রচার করছি ‘ট্রানজিট’। 

তাহলে ভারতকে দেওয়া করিডরের প্রশ্ন কোনো অর্থনীতি বা বাণিজ্যের প্রশ্ন নয়। এটি বাংলাদেশের রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। অথচ এই করিডরকে ‘ট্রানজিট’ বলে প্রচার এবং লেখালেখি করে আমরা যখন করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশের ‘ভাগ্য পাল্টাতে’ আহামরি কতকিছু পাওয়ার মহিমা প্রচার করে চলেছি, তখন কি আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ভেবে দেখার সময় পেয়েছি যে, আমাদের দেশপ্রেম ও সার্বভৌমত্ববোধ কতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে? 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //