শহীদের সংখ্যা ও ইতিহাসের দায়

বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের গণমানুষ সবচেয়ে বীরত্বপূর্ণ এবং গৌরবময় অধ্যায় রচনা করেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। শুধু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তো নয়, বীর বাঙালি শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জন করেছে। অঞ্চলভিত্তিক ছোটখাটো খণ্ড-ক্ষুদ্র যুদ্ধজয়ের দু-চারটি দৃষ্টান্ত অতীতে থাকলেও বাঙালি জাতীয়তার ভিত্তিতে এমন শৌর্য-বীর্যময় বিজয়লাভ আগে কখনো ঘটেনি।

অথচ ১৯৭১ সালের এ যুদ্ধ ছিল এক অসম যুদ্ধ, ভোটযুদ্ধে জয়ী শান্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির উপরে যুদ্ধবাজ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেয়া একতরফা যুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকেরা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় অতর্কিতভাবে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পৈশাচিক হত্যালীলায় মেতে ওঠে, অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন আর নারীনির্যাতনের মধ্য দিয়ে সারা দেশে চরম ত্রাস সৃষ্টি করে। দুঃসহ এই জীবন-মরণ সংকটের মুখে বাঙালিকে আত্মরক্ষার তাগিদেই ঘুরে দাঁড়াতে হয়, যুদ্ধের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে প্রাণ বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। অর্জিত হয় বাঙালির বিজয়, সার্থক হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি বিজয়ের অর্ধ শতক। মহার্ঘ এই অর্জন নিয়ে আমাদের আনন্দ এবং শ্লাঘা পর্বতপ্রমাণ। কিন্তু বিরাট এ পর্বতের ভিত্তি রচিত হয়েছে যাদের রক্তের মূল্যে, জাতীয়ভাবে তাদের অবদান কীভাবে এবং কতখানি মূল্যায়িত হয়েছে সেটা খতিয়ে না দেখলেই নয়। বিশেষ করে আমি দৃষ্টি ফেরাতে চাই ‘তিরিশ লাখে’র সংখ্যাগত প্রাকারে বন্দি শহীদদের দিকে।

মুক্তিযুদ্ধে নানা রকমের অবদানের জন্য এরই মাঝে সরকার নানান স্বীকৃতি, সনদ এবং ভাতা প্রদানের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা প্রশংসনীয় এতে সন্দেহ নেই, কিন্তু এ নিয়ে বেশ বিতর্কও তৈরি হয়েছে। এটা হয়েছে সর্বজনগ্রাহ্য নির্ভেজাল মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়নের ব্যর্থতার কারণে। সরকারের সচিব পর্যায়েও যখন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম সন্নিবেশিত হয়ে যায়, তখন আর এ নিয়ে মন্তব্য করার কীইবা থাকে! স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমরা মুক্তিযোদ্ধার নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করতে পারিনি এর চেয়ে গ্লানিকর আর কী হতে পারে! ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না।’ প্রশ্নটা এইখানে- তারা সত্যিই কতজন ছিলেন? এক দুই তিন চার করে কাঁটায় কাঁটায় ঠিকঠাক সঠিক সংখ্যা না হয় না-ই হলো, কিন্তু তাদের নাম ঠিকানা সেইটুকুও কোথাও লেখা হবে না!

মুক্তিযোদ্ধার তালিকা শুধু নয়, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা অথবা অমুক্তিযোদ্ধা শহীদ (সাধারণ মানুষ) কোনো তালিকাই নেই আমাদের হাতে। বলা হয় তিরিশ লাখ শহীদের কথা। এই সংখ্যা নিয়েও অভব্য ও অরুচিকর বিতর্ক তৈরির চেষ্টা এ দেশে হয়েছে। এ বিতর্ক যে কোনো প্রকার সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা এই ‘তিরিশ লাখের’ প্রাকারবন্দি হতভাগ্য (!) মানুষগুলোর কোনো পরিচয় জাতি জানতে পারবে না কখনো? শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তবু এক প্রকার তালিকা পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধের কারণে যে সমস্ত সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, তাদের কি কোনোদিন কোনো রকম তালিকাই হবে না? খাস জমি কিংবা সরকারি ভাতা না হোক বরাদ্দ তাদের নামে, তবু শহীদের স্বীকৃতিটুকু অন্তত দেয়া যাবে না? কারও উত্তরপুরুষ যদি জাতির কাছে জানতে চায়- আমার পূর্বপুরুষ ১৯৭১ সালে তার নিজ বাড়িতেই পাকিস্তানি সৈনিকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে, তবু তাকে শহীদ বলা হবে না কেন? রাষ্ট্রের কোনো দলিলপত্রে তাকে শহীদ বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি কেন? তার এই প্রাণদানের কোনো মর্যাদা নেই? কেবল ‘তিরিশ লাখের’ প্যাকেটে ঢুকিয়ে রাখলেই চলবে?

আমরা কিছুতেই ভুলে যাব না যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু দুই দল সৈনিকের শক্তি পরীক্ষার যুদ্ধ ছিল না, একেবারে শুরু থেকেই অগণিত সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে তা হয়ে ওঠে জনযুদ্ধ। সৈন্যবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান তৈরি করা যত সহজ, মনে রাখতে হবে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ মোটেই তত সহজ নয়। কিন্তু আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাও অসম্ভব নয়। প্রয়োজন আন্তরিকতা ও বাস্তবতার নিরিখে উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ। এ ধরনের শুভ উদ্যোগের জন্য জাতিকে আর কত অপেক্ষা করতে হবে কে জানে! শোনা যায়- ‘তিরিশ লাখ’ এই সংখ্যা নিয়েও কোনো কোনো মহলে বিশেষ উদ্বেগ আর শঙ্কা রয়েছে, পাছে শহীদের সংখ্যা যদি ওই পরিমাণ না হয়! সত্যের ভার বহনে লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই। সংখ্যা যদি তিরিশ লাখের উপরে হয়, সেটা কি তবে আনন্দের হবে? তিরিশ লাখের প্রাকার ভেঙে শহীদের প্রকৃত সংখ্যা ও সঠিক পরিচয় লিপিবদ্ধ করার সময় এখনো একেবারে ফুরিয়ে যায়নি।

শহীদের সংখ্যার পাশাপাশি যুদ্ধকালে সম্ভ্রমহারা নারীদেরও সঠিক সংখ্যা ও পরিচয় উদ্ধার করা খুবই জরুরি। কাজী নজরুল কোন রণে ‘কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর’ বলে স্বামীহারা অকাল বিধবাদের সংখ্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে খেদোক্তি জানিয়েছেন যে শহীদদের নামের পাশে তাদের নাম লেখা হয় না। আমরা আর এক ধাপ এগিয়ে ‘সিঁথির সিঁদুর’ হারানো শহীদপত্নীদের নাম ছাড়িয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রমহারা বীরাঙ্গনাদের কথা বলতে চাই। তাদের প্রতি সম্মান জানানোর মহৎ উদ্দেশ্যেই নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন।

আরও জরুরি প্রয়োজন এর উল্টো দিকে দৃষ্টি দেয়া। গণমানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণে ধন্য আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল কারা? অনেকে এরই মধ্যে ভোল পাল্টে ফেলেছে। তবু এখনো আন্তরিকতা নিয়ে কাজে হাত দিলে এই কুখ্যাত স্বাধীনতা-বিরোধীদের তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে এতদিন পরে কী হবে এ তালিকা করে? কী হবে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা সম্ভব, কিন্তু এখন থাক সে আলোচনা। এখন শুধু বলি- সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো না বলাও এক রকম পাপ।

বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আসুন আমরা আমাদের এতদিনের অপারগতাসমূহের বিশ্লেষণ করি নিরপেক্ষভাবে। ‘হয়তোবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না’ গানের এই বেদনাধোয়া বাণী বুকে ধারণ করেই বলতে চাই- ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লেখার উদ্যোগ আজ হোক কাল হোক, আমাদের নিতে হবে। এটাকে ইতিহাসের দায় বলে মানতেই হবে আমাদের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //