উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ থেকে মুক্তি কবে

বাংলাদেশে শিক্ষার আনুভূমিক বিস্তার ঘটছে জোরেশোরে। শিক্ষায় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনের জন্য তাড়াহুড়া ছিল। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত মান বৃদ্ধির কথা ভাবা হয়নি। ভিত্তি পর্যায়ে এই দুর্বলতা মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় প্রকট ছিল ও আছে। উচ্চশিক্ষা আমাদের দেশে বেশ আকর্ষণীয়- সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। 

সবার জন্য  প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করে অল্প কিছু সুবিধাভোগী মানুষ তৈরির প্রকল্প ছিল এটি। সেই প্রবণতা এখনো আছে। তবে এখন উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করছে আগের চেয়ে বেশি ছেলেমেয়ে। বর্তমানে মাধ্যমিক (উচ্চ) পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যে যুদ্ধ হয় তাতে রক্তক্ষয় বাদে- অর্থ, শ্রম, সময় ইত্যাদি সবই ক্ষয় হয়। 

পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ হাজার ৩৫টি আসনের বিপরীতে ভর্তি-ফরম বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৯০ হাজার ৩৪৭টি। প্রতিটি ফরম ১ হাজার টাকা ধরে যার মোট মূল্য ২৯ কোটি ৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা। গত বছরের চেয়ে প্রতিটি ফরমের এই মূল্য ৩৫০ টাকা বেশি। প্রতিবছর ভর্তি ফরমের এই মূল্য বাড়ানো হয়। আগের বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ২০ কোটি টাকা ফরম বিক্রি থেকে আয় করেছিল। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী খরচ বাদ দিয়ে যার লাভ ছিল ১২ কোটি টাকা। শিক্ষকদের মধ্যে এই লাভের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কেলেঙ্কারিও হয়েছিল, যা নিয়ে পরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে তদন্ত করতে হয়। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরম বিক্রির টাকা হিসাব করলে তা সহজেই ১০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। 

সহজেই বোধগম্য যে, প্রতিটি ফরমের দাম কোনো বছরে মাত্র ১ টাকা বাড়ালেই মোট আয় বাড়ে ৩ লাখ টাকা। এই বিপুল অংকের টাকা থেকে অর্জিত লাভ কি ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী কাজে লাগে? 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তা ব্যয় হয়? যদি হয় তবে বিভিন্ন অজুহাতে শিক্ষার্থীদের নানারকম ব্যয় বাড়ে কী করে? আবার ভর্তি ফরমের এই মূল্য বাদেও শিক্ষার্থীর অনেক খরচ আছে। যেমন- অনেক শিক্ষার্থীই একাধিক ইউনিটে পরীক্ষা দেয়। ফলে তখন তার আরও দুই-এক হাজার টাকা ফরমের খরচ বাড়ে।

অনেককেই কোচিং সেন্টারে দুই-তিন মাস কোর্সের জন্য আবার দশ-বারো হাজার টাকা গুণতে হয়। এদের বেশিরভাগই তাদের কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না, যেহেতু সব জায়গাতেই আসন সীমিত। 

কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের কথা ধরি। এখানে যারা ফরম কিনেছে তাদের ২ লাখ ৮৪ জনই ভর্তি হতে পারেনি। অথচ যারা শুধু ফরম কিনতে ব্যয় করেছে ২৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। তার অর্থ- ফরম বিক্রি থেকে অর্জিত এই বিপুল অংকের টাকার প্রায় পুরোটাই তাদের, যারা ভর্তি হতে পারেনি। এর বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় এক পয়সারও শিক্ষাসেবা দেয়নি। এখন কোনো সুস্থ পুঁজিবাদী সমাজে কি এমন বিপুল অর্থ আয় করা যায় ন্যূনতম সেবা দেওয়া ছাড়াই? 

দুই-তিন লাখের ছেলেমেয়ের মধ্য থেকে কি সত্যি এভাবে মেধা যাচাই করে দুই-চার হাজার শিক্ষার্থী বাছাই করা যায়? তাদের এই আয়ের পেছনের কারিশমা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী নানা কারণে এখানে পড়তে চায়। এই চাহিদাকেই তারা পুঁজি করে থাকে। জোগান ও চাহিদার ফারাক এখানে আকাশ-পাতাল। 

তাই কেবল লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগের জন্যই এক্ষেত্রে দাম দিতে হয়, আর তা দুই-চার টাকা নয়। কেন এই বিপুল চাহিদা? আমাদের দেশে চাকরির বাজারে সংকটের কারণে শিক্ষার্থীরা মনে করে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট তাদের চাকরি পেতে সহায়তা করবে। 

আবার বেশিরভাগ চাকরিদাতা স্নাতকোত্তর ছাড়া কারও আবেদনই গ্রহণ করেন না। অতএব ভালো ব্র্যান্ডিংওয়ালা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিটা তাদের প্রয়োজন। সার্টিফিকেটের এই চাহিদা মেটানোর জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে- শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রয়ের অর্থনৈতিক ধারণা থেকে; কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাতো পণ্য হতে পারে না।

কথা হচ্ছে- প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালগুলো চলছে কীভাবে? ২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ধসের পর যুক্তরাষ্ট্রে জনগণের টাকা ঢেলে সরকার ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়েছে, যাকে বলে বেইলআউট। আমাদের দেশের প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পাবলিক হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ও শিক্ষক দ্বারা চলেছে ও চলছে; শুরুতে বেশি এখন কম। 

এসব চিকিৎসক ও শিক্ষকরা সবাই পাবলিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খরচেই পয়দা হয়েছেন- তাদের জ্ঞান ও দক্ষতা মানবসেবায় কাজে লাগানোর জন্য, ব্যবসার জন্য নয়; কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ধীরে ধীরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অসীম গুরুত্ব ও সেই তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চাৎপদতা অনুধাবন করতে পারছেন! আর তাই আস্তে আস্তে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুসরণ করতে শুরু করেছে। 

ধীরে ধীরে পাল্টাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্র। দেখা যাচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতাল ও বিশ্ববিদ্যালয় কেবল প্রাইভেট মূলধন দিয়ে তৈরি না, এগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য রয়েছে পাবলিক বিনিয়োগ, অর্থাৎ জনগণের ট্যাক্সে তৈরি মানবসম্পদের (শিক্ষক, চিকিৎসক ইত্যাদি) গোপন ব্যবহার। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও তৈরি হচ্ছে ব্যবসার নানা ফন্দিফিকির। 

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচের প্রসঙ্গ উঠলেই তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, যেন খরচের দিক থেকে এ দুটি তুলনার বিষয়। একটির প্রতিষ্ঠা জ্ঞান সঞ্চারণ ও সৃষ্টির জন্য, আরেকটির প্রতিষ্ঠা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিক্রির জন্য। একটির সার্থকতা জ্ঞান বিস্তারে ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে, আরেকটির সার্থকতা মুনাফা অর্জনে। একটি শিক্ষার্থী যে অর্থ দেয় তা শিক্ষা ক্রয়ের জন্য নয়, তার সক্রিয় অংশগ্রহণের তৃপ্তির জন্য। 

আরেকটি শিক্ষার্থী যে অর্থ দেয় তা শিক্ষা বাজারমূল্যে ক্রয়ের জন্য। অতএব খরচের তুলনায় যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে থাকবে, তা-ই স্বাভাবিক। এই তুলনা বরং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে হীনমন্যতায় ফেলতে পারে। আর তা প্রকট হয়ে যায় যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই নানারকম ব্যয়বহুল ট্রেনিং সেন্টার, স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার ইত্যাদি নানা রকম ব্যবসাবাণিজ্য খোলা হতে থাকে।

বাজারে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রে বাজারমুখিনতা তৈরিতে বেশ সহায়তা করছে। এমনিতেই জ্ঞান সৃষ্টি ও মৌলিক গবেষণায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা করুণ, তারপর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জীবনযাপনের জৌলুস বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় এসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেনিং সেন্টারে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে কনসালটেন্সি ইত্যাদি করে বেড়ান, তখন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির দশা কী তা দেখাই যাচ্ছে। 

এই চরিত্র পাল্টানোয় নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা ইউজিসি। ২০০৬ সালে তৈরি তাদের ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রে এ দেশের উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বীজ বপন করা হয়েছে। এ কৌশলপত্রে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এও অনুরূপ উপদেশ।

(অষ্টম অধ্যায়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষানীতির ১৩নং কৌশল) আবার বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে চাকরির বাজার অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ দেশে স্বাধীন পুঁজি বিকাশের পথ বন্ধ করে দিয়ে বিদেশি পুঁজির সেবাদাস হিসেবে আমরা আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েদের গড়ে তুলছি, আর একেই শিক্ষার সফলতা ভেবে গর্ব অনুভব করছি। 

একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানবিক বিদ্যা ও মৌলিক বিজ্ঞান অবহেলিত হচ্ছে, সেখানে গড়ে উঠছে বাণিজ্য ও ব্যবসামূলক বিদ্যার বিভাগসমূহ। অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমূলক বিষয়ের তুলনায় বেশি অন্যান্য ডিপার্টমেন্ট। উচ্চশিক্ষার নামে এমন একটা জনগোষ্ঠী তৈরি করা হচ্ছে, যাদের বেশিরভাগের মান মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই রয়েছে। 

উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়া যুবা-তরুণদের বেশিরভাগের হাতে আসলে তুলে দেওয়া হচ্ছে একটা সার্টিফিকেট, যা প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে একটি কাগজমাত্র। আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতিতে স্নাতক ডিগ্রিকে সমাপনী ডিগ্রি বলে ধরে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

বলা হয়েছে কেবল শিক্ষকতা ও গবেষণা ছাড়া অন্য কোনো পেশায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রয়োজন নেই; কিন্তু স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকলে চাকরিপ্রার্থী কোথায় আবেদন করবে, যেহেতু সব চাকরিদতাই কাজের ক্ষেত্রে মাস্টার্স ডিগ্রি চেয়ে বসে থাকেন। অত্রএব ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় সর্বোচ্চ ডিগ্রির সার্টিফিকেট জোগাড়ের জন্য যুদ্ধ করতে হয়, যা শিক্ষা জোগানদারদের জন্য এক মহাব্যবসা।

বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে তৈরি ইউজিসির এই কৌশলপত্র প্রত্যাখ্যান করে উচ্চশিক্ষার জ্ঞানমুখী স্বাধীন কৌশলপত্র তৈরি করা জরুরি। সেদিনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আজ আর নেই, বদলে যাবে আরও। বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্যবসাশিল্প কাছাকাছি আসছে।

এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০২তম প্রতিষ্ঠাবর্ষিকীর প্রতিপাদ্য ছিল- ‘গবেষণা ও উদ্ভাবন: ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা’ যা এই বদলে যাওয়ারই ইঙ্গিত দেয়। শিক্ষানীতিতে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র গড়ে তোলা’র কথা বলা হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে। (দ্বাদশ অধ্যায়ের নবম ধারা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন তারই নেতৃত্ব দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ও ইউজিসির নেতৃত্বে আমাদের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষাই এখন ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিত্তবান হওয়ার একটি মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। মানবিক, নৈতিক-সাংস্কৃতিক ও জাতীয় চেতনাগুলো চাহিদা-জোগানের মুক্তবাজারে হেরে যাবে বা তাদের সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হবে। তাই জাতীয় স্বার্থে উচ্চশিক্ষার মুক্তি জরুরি।

সম্পাদক

বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //