হিরো-মাহির মনোনয়ন ও আমাদের রাজনীতি

বিএনপির ছেড়ে দেয়া ছয়টি আসনে উপনির্বাচন হবে আগামী পয়লা ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন চলচ্চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি, যার সঙ্গে একটি ফোনালাপের সূত্র ধরে মন্ত্রিত্ব এবং দল থেকে পদ হারান তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। 

এবারের উপনির্বাচনে মাহি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু পয়লা জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভায় মাহিয়া মাহিকে মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন জিয়াউর রহমান। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং সাবেক সংসদ সদস্য। এখানে বিএনপির সংসদ সদস্য ছিলেন মো. আমিনুল ইসলাম।

এই নির্বাচনে যেহেতু বিএনপি অংশ নিচ্ছে না এবং এখানে জাতীয় পার্টিও খুব শক্তিশালী নয়, ফলে মাহি মনোনয়ন পেলে তিনি যে নির্বাচিত হয়ে যেতেন, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। তবে আওয়ামী লীগ ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বা শোবিজ দুনিয়ার খ্যাতির চেয়ে স্থানীয় রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, এটি ভালো লক্ষণ। 

বছরের পর বছর যারা দলের জন্য কাজ করেন, তাদেরই মনোনীত হওয়া উচিত। রাজনীতির সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকা বা দলের জন্য কোনো ত্যাগের ইতিহাস না থাকার পরও ব্যক্তিগত বা পেশাগত পরিচয় ও জনপ্রিয়তা, এমনকি বাবা, স্বামী কিংবা অন্য কোনো আত্মীয়তার সূত্রে দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া গণতান্ত্রিক নয়।

এ ধরনের ঘটনা দলের ত্যাগী নেতাদের হতাশ ও নিরুৎসাহিত করে। সুতরাং মাহিয়া মাহি যদি সত্যিই সংসদ সদস্য হতে চান তার উচিত হবে রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া; এলাকার মানুষের কাছে যাওয়া; তাদের জন্য কাজ করা, যা ভবিষ্যতে তার মনোনয়ন পাওয়ার পথ পরিষ্কার করবে।  

এবারের উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে চান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত-সমালোচিত-বিতর্কিত হিরো আলমও, যিনি ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে না অভিযোগে দুপুর বেলা ভোট বর্জন করেন। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। তবে শেষমেশ মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

এবারও বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন হিরো আলম। কিন্তু তার কাছে দলীয় মনোনয়ন ফরমই বিক্রি করেনি জাপা। শোনা যাচ্ছে, হিরো আলমকে ‘ভাঁড়’ উল্লেখ করে তার কাছে ফরম বিক্রি করা থেকে বিরত থেকেছে জাতীয় পার্টি। (কালের কণ্ঠ, ২৩ ডিসেম্বর ২০২২)।

হিরো আলম এখন কী করবেন? আওয়ামী লীগ যে তাকে মনোনয়ন দেবে না, সেটি মোটামুটি নিশ্চিত। সে ক্ষেত্রে তিনি হয়তো স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন এবং সঙ্গত কারণে তিনি হয়তো হেরেও যাবেন। 

কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোর জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রবণতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হলেই, অর্থাৎ নৌকা প্রতীক পেলেই তার জয় নিশ্চিত। যে কারণে অনেক জায়গায়ই দেখা গেছে নৌকা প্রতীক পাওয়ার পরেই অনেক প্রার্থী অথবা তার সমর্থকরা বিজয় মিছিল করেছেন। অর্থাৎ ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়েও এখন নৌকা প্রতীক পাওয়াটাই মুখ্য। 

সংবিধান যেহেতু কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এবং পাগল ছাড়া যে কাউকেই (২৫ বছর হলেই) নির্বাচন করার অধিকার দিয়েছে; সেখানে শিক্ষা-দীক্ষারও যেহেতু কোনো শর্ত নেই; এমনকি সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা হওয়ার জন্যও যেখানে ন্যূনতম পড়ালেখা জানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, সেখানে হিরো আলম কিংবা মাহিয়া মাহির সংসদ সদস্য হতে নিশ্চয়ই কোনো বাধা নেই। প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতাও কোনো বাধা নয়। যিনি কোনোদিন স্কুলের চৌকাঠ মাড়াননি, তাকেও আইনপ্রণেতা হওয়ার পথে আমাদের সংবিধান কোনো বাধা দেয় না। 

সে হিসেবে মাহিয়া মাহি কিংবা হিরো আলম, যে কেউই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন এবং স্থানীয় সরকার তো বটেই, জাতীয় সংসদ সদস্য, অর্থাৎ আইনপ্রণেতাও হয়ে যেতে পারেন। এমনকি তিনি যদি আইন-কানুন নাও বোঝেন এবং ‘আইনপ্রণেতা’ শব্দটি নির্ভুলভাবে লিখতে নাও পারেন, তাতেও তার সংসদ সদস্য হতে কোনো বাধা নেই। 

মূলত সংবিধানের এই সহজ বিধানের সুযোগ নিয়েই অশিক্ষিত লোকজনের সংসদ সদস্য বা আইনপ্রণেতা হওয়ার পথ সুগম হয়েছে। অথচ আইন প্রণয়ন একটি জটিল প্রক্রিয়া। এর খুঁটিনাটি দিকগুলো না বুঝলে আমলারা যে ধরনের খসড়া তৈরি করে দেবেন, হুবহু সেভাবেই আইনগুলো পাস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অনেক সময় বলা হয়, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তাদেরকে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশন দেয়া হয়। কিন্তু সেসব প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টেশনেও কতজন আইনপ্রণেতা হয়ে উঠতে পারেন, সেই তর্ক বহুদিনের।

বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার, সংসদ ও সংসদীয় রাজনীতির আরেকটি ট্র্যাজেডি হলো, এখানে রাজনীতিবিদদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেশি। একটা সময় যেখানে আইনজীবী, শিক্ষক ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধাভাজন মানুষেরা নির্বাচিত হতেন, সেখানে এখন ব্যবসায়ীরাই সংখ্যাগুরু এবং সঙ্গত কারণে তারাই ডমিনেট করেন। 

ড. বদিউল আলম মজুমদার ও নেসার আমিনের প্রকাশিতব্য ‘বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও ফলাফল’ বইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের মধ্যে ৫৩.১৪ শতাংশই ব্যবসায়ী। এর বাইরে আইনজীবী ছিলেন ৮.৯৮ শতাংশ। এর আগে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ওই নির্বাচনে ব্যবসায়ী ছিলেন ৫২.৩ শতাংশ। যদিও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল আরও বেশি, ৫৭ শতাংশ। তার আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে ৫৮ শতাংশ। 

দেশের অর্থনীতি যেহেতু কিছু ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি বলে শোনা যায়, ফলে সেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোনো আইন প্রণয়ন করার এখতিয়ার সংসদের কতটুকু রয়েছে, সে প্রশ্নও আছে।

এই যখন বাস্তবতা তখন সংসদে একজন মাহিয়া মাহি কিংবা হিরো আলম কোনো দলের মনোনয়ন পেলেন কিংবা পেলেন না অথবা তারা এমপি হতে পারলেন কি পারলেন না, সেটি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য কিছু মুখরোচক সংবাদের জন্ম দিলেও সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনীতি, বিশেষ করে সংসদীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলবে, সেটিই বড় প্রশ্ন।

বাংলাদেশের রাজনীতির আরেকটি বড় ট্র্যাজেডি হলো, নিতান্ত জনগণের সেবার ব্রত নিয়ে রাজনীতি যারা করেন, তাদের পক্ষে এখন দলের মনোনয়ন পাওয়া খুব কঠিন এবং বলা ভালো অসম্ভব। একটা সময় পর্যন্ত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি যেমন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারতেন।

কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে করার পর থেকে সেই সুযোগটুকুও তিরোহিত হয়েছে। এখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্যও যে ধরনের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং পয়সার খেলা খেলতে হয়, সেই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় কোনো সুস্থ মানুষের অংশ নেয়ার কথা নয়।

যে কারণে ধীরে ধীরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষিত-সজ্জন ও ভালো মানুষের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে গেছে। জাতীয় সংসদের কথা বলাই বাহুল্য। অতএব প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ যে জায়গায় চলে গেছে, তাতে হিরো আলম কিংবা মাহিয়া এমপি হয়েই বা কী করতে পারবেন, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //