পরীমণিদের সুখ-দুঃখ ও আমরা

আমরা স্টারদের খবর পড়ি, তাদের চিনি আর নাই চিনি। তারা আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকে সমাজের মননে, কারণ তারা এই বাস্তবতার অংশ। এটা আরও বেশি করে বাস্তবতা, কারণ এই নয়া মিডিয়ার জামানায় যেখানে খবর চলে কোটি মাইল স্পিডে। এতে পাঠকের চোখ কোন দিকে যায় আমরা জানি। আমাদের মনন নির্মাণে তারকাদের বিশাল ভূমিকা যদিও আমরা চেষ্টা করি অস্বীকার করতে। 

দুইটা আলাদা দুনিয়ার খবর হলেও কিন্তু ফুটবল ওয়ার্ল্ডকাপের সঙ্গে যে খবর কম্পিটিশন করতে পারে সেটা হলো আমাদের স্টাররা। রাজনীতির খবর অন্য কিসিমের, কারণ তাতে আছে দ্বন্দ্ব, লড়াই, ক্ষমতা অর্জন। কিন্তু নিরেট খবর হিসেবে পরীমণিসহ এই সব স্টার আমাদের মিডিয়া দুনিয়াকে সচল রাখার বড় ভূমিকায় রয়েছেন। 

দুই.
বোট ক্লাবের ঘটনার সময় পত্রিকায় অনেক খবর আসে পরীমণিকে নিয়ে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং রিমান্ডে যেতে হয় পর্যন্ত। যারা তার বিরুদ্ধে ছিল তারা দেশের ওপরতলা সব দিক থেকে। এবং পরীমণি অনেকের কাছে পরিণত হন একটি সামাজিক প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে। প্রাতিষ্ঠানিক বা সরকারি শক্তি সেটা বিত্তবান, পুলিশ বা মিডিয়া যেই হোক তাকে লড়তে হয় সামাজিক বলয়ের সাথে। 

এমন নয় যে সবাই পরীমণির পক্ষে ছিল, অনেকেই তাকে নানা কারণে গালি দেয় তার লাইফস্টাইল নিয়ে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে পরীমণি আর একজন ‘নটি’ ছিল না এই দ্বন্দ্বে। সে পরিণত হয় সামাজিক প্রতিবাদের প্রতীকে। অর্থাৎ ক্ষমতাহীন বনাম ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর যে বিবাদ ও দ্বন্দ্ব, সে তার অংশ হয়ে যায়। পরীমণির জামিন পাওয়া ছিল এই দুর্বল সমাজের এক ছোট্ট বিজয়ও।

তিন.
এই দেশে বড়লোক হতে গেলে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে অনেক টাকা বানানোর পদ্ধতি হচ্ছে বড়লোকি জোটের সাথে যুক্ত হওয়া। ওই জোটের জালের অংশ না হলে বড়লোক হওয়া যায় না। এই কারণে ক্লাবগুলো বড় ভূমিকা পালন করে। সেটা বোট ক্লাবই হোক অথবা ঢাকা ক্লাব অথবা পাড়ার ক্লাব, সবই এই এক মডেলের কারখানা। অতএব যাদেরকে পরীমণি ক্ষিপ্ত করে তারা ওপরতলার জালের বাসিন্দা, যারা তাদের বিপক্ষে, তাদের জাল নিম্ন কিসিমের, মজবুত না। কেউ চাক আর না চাক পরীমণি সেই অসম বিবাদের ট্রিগার হয়ে যান। এই তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ। 

চার. 
যখন ঘটনা ঘটে এই নারীকে আমি চিনতামই না, যেহেতু সিনেমার খবর রাখি না। তাই পরে খবর নিয়ে জানলাম, ঢাকার বাইরের নিম্নবিত্ত ঘরের মানুষ যে টিকে থাকতে বা ওপরে উঠতে চায়। যে পদ্ধতি তার জন্য সফল সে সেটা বেছে নিয়েছে। তার পারিবারিক জীবনের কথা মিডিয়াতে আসে যেটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সেই সময় তার একাধিক বিবাহ, সম্পর্ক, জীবন-যাপন নিয়ে কথা আসে। মিডিয়া কেবল তথ্য দেয়নি, কখনো কখনো তার সাথে মন্তব্য জুড়েছে। ফলে পরীমণির জীবনের নেতিবাচক বিষয়গুলো এসেছে বেশি। আমাদের সুশীল মধ্যবিত্ত নির্মিত দুনিয়াকে ধাক্কা দিয়েছে, তাই পরীমণি ‘খারাপ মেয়ে’-এর তকমা পায়। তার সাথে অন্য কয়েকজন এক কথায় বনে যায় ‘রাতের রানী’, যারা বড়লোকের ছেলেদের মনোরঞ্জন করে। অবশ্য ছেলেদের কোনো খোঁজ নেই, কেবল মেয়েদের নাম আছে লিস্টে। 

পাঁচ.
এই টাইটেল দেওয়ার পর বাংলাদেশের নারীবাদীরা খেপে যায় এবং ফেসবুকে ‘রাতের রানী’ সেজে যে যে রকম পেরেছে প্রতিবাদ করে। অর্থাৎ এটা কেবল তার বিষয় আর থাকেনি, অনেকের বিষয়ে পরিণত হয়। মধ্যবিত্ত সুশীল নারী সমাজ তার এই তকমা লাগানোর প্রতিবাদ করে আজকালকার ভাষায়। একাত্মতা ঘোষণা করার এই পর্যায়ে এসে পরীমণি সামাজিক পরিসরে মূলধারায় প্রবেশ করে। তবে সে সমাজের প্রতিবাদের সূত্র/উৎস হলেও অংশ হয়নি। মনে আছে এক পত্রিকায় তার ওপর লেখা আমার কলাম সরিয়ে দেয়। তারা ভদ্র, সম্ভ্রান্ত পত্রিকা। এই বিষয়, এই সব লেখা তারা ছাপে না বলে।

ছয়.
এত সব কথা লিখলাম। কারণ ইদানীং পরীমণি আবার খবর হয়েছেন তার পারিবারিক জীবন নিয়ে। তার বিয়ে, সংসার, কলহ, স্বামী সবই সংবাদ। অন্য কোনো স্টারের সাথে তার স্বামীর সম্পর্ক এই নিয়ে ডিভোর্সের পর্যন্ত খবর এসেছে। আমিও শিরোনামে চোখ বুলিয়েছি, কিন্তু পড়িনি। কারণ তার ব্যক্তিগত জীবন আমার আগ্রহের জায়গা নয়, তবে অনেক মানুষেরই এটা। 

বিয়ে আর ডিভোর্স দুটিই জনপ্রিয় সংবাদ শিরোনাম, যারই হোক। আর স্টার পাড়ায় এটা অনেক ঘটে। অতএব সুস্বাদু শিরোনাম দিয়ে পরীমণি আজ মিডিয়াকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটা পার্থক্য আছে। পরীমণির সুখ-দুঃখে কারও কিছু আসছে যাচ্ছে না। তার সাথে আজ কেউ নেই। তাই যদি হয় তাহলে সে কে আমাদের চোখে? এত যে তার পক্ষে ধ্বনি উঠল সোশ্যাল মিডিয়াতে সে সব কী ছিল? সে তো এখন ঘরনি হিসেবে প্রমোশন পেয়েছে রাতের রানী থেকে, তরপরও কেন এই ‘অবজ্ঞা’ তার অবস্থার প্রতি? 

সাত. 
আসলে সেই পরীমণি আর এই পরীমণির মধ্যে অনেক তফাত। বোট ক্লাবের পরীমণিকে আমাদের দরকার ছিল, সে ব্যবহৃত হয়েছে খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে। সে কেবল হাতিয়ার, তার সাথে সমাজের সম্পর্ক এটাই। সে রাতে গিয়ে মদ্যপানের আসরে ছিল ক্লাবে, কোনো ঝামেলা হয়। এই পর্যন্ত বিষয়টা ছিল তার নিজের, এখন যেমন। কিন্তু যখন তার প্রতিপক্ষ বের হলো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে, অবস্থা পাল্টে যায়। সেই সংঘাত ছিল সমাজের সাথে, ব্যক্তি পরীমণি নামে কেউ নেই সেখানে। তাই সে প্রতীকে পরিণত হয়। কিন্তু এখন আর কেউ বাত্তি জ্বালিয়ে ‘আমি পরীমণি’ বলবে না। এটা সব ক্ষেত্রেই বাস্তবতা। ব্যক্তি আর সমাজের দূরত্ব এখানেই এবং কোনোদিন ব্যক্তির আন্দোলন আগায় না, সমাজের তা লক্ষ্যে পৌঁছায়। 

আট. 
যে আন্দোলন চলেছে, চলছে, চলবে আগামীতে তাতে পরীমণি অংশীদার ছিলেন। তার নিজের কারণে নয়, ইতিহাসের প্রয়োজনে। আমরা সবাই ত্যাজ্য, এটাই স্মরণ রাখা দরকার। প্রয়োজনের স্বার্থে আমাদের বাঁচা, মরা, লাফালাফি। পরিস্থিতির কারণেই কেউ সম্রাট, কেউ ভিখারি। ইতিহাস সবার জন্য সমান নিষ্ঠুর, কাউকে মনে রাখে না। ভালো থাকবেন পরীমণি আপা।

সাহিত্যিক, গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //