শিক্ষা যখন পণ্য

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি এই তিন মাস যেসব অভিভাবকের সন্তানরা বেসরকারি স্কুলগুলোতে পড়ে তাদের জন্য হার্ড টাইম, বলতে গেলে ভয়াল সময়। এ সময়ে শিক্ষা খাতে ব্যয়ের বোঝা দ্বিগুণ কখনো বা তিনগুণ বেড়ে যায়।

কোভিড পরবর্তী প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, রিজার্ভ সংকট ইত্যাদি কারণে নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার যে ঝক্কি গত কয়েক মাস ধরে সাধারণ মানুষকে পোহাতে হচ্ছে, তার ওপর এসে ভর করেছে ভয়াল নভেম্বর-জানুয়ারি শিক্ষা খাতে ব্যয়ের বোঝা। প্রতিটি বেসরকারি স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীকে নভেম্বর-ডিসেম্বর দুই মাসের বেতনসহ পরীক্ষার ফি, কোর্স ফি, অন্যান্য বকেয়া নানা ফি, ক্লাস পার্টি ফিসহ একটা বড় অঙ্কের টাকা স্কুলে জমা দিতে হয়।

ডিসেম্বরে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় ভর্তি ফি, স্পোর্টস ফি, ইউটিলিটি ফি নানা ফিয়ের হ্যাপা সামলাতে হয়। সেখানেও বড় অঙ্কের একটা টাকা ঢালতে হয়। তারপর আসে জানুয়ারি, সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা উপকরণ কেনার লম্বা লিস্ট। 

২০১৬ সালে ‘শিশু শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন তাদের শরীরের ওজনের এক-দশমাংশের বেশি হবে না’ এ মর্মে হাইকোর্ট সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিলে শিশুকে হয়তো শারীরিকভাবে বইয়ের বোঝা বহন করতে হচ্ছে না, তবে গাদা গাদা বই তাদেরকে ঠিকই পড়তে হচ্ছে স্কুলে। ব্যাগের বোঝা কমাতে গিয়ে অভিভাবককে দিতে হচ্ছে দ্বিগুণ গচ্চা।

বেসরকারি ও বিদেশি ভাষার মাধ্যমের স্কুলগুলোর নিয়ম হলো, এক সেট বই-খাতা স্কুলে থাকবে, এক সেট থাকবে বাড়িতে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীর জন্য দুই সেট বইপত্র কিনতে হবে। এ ক্ষেত্রে একজন মধ্যবিত্ত অভিভাবকের দুজন সন্তান যদি খরচের দিক থেকে একটা মধ্যম সারির বেসরকারি স্কুলে পড়ে তাহলে বছরের শুরুতেই ন্যূনতম এক লাখ টাকার জোগান দিতে হয়। এবং এই খরচ বয়স ও শ্রেণিভেদে প্রতিবছর বাড়বে।

ছাত্র বা ছাত্রী যে কিনা একটা স্কুলে একবার ভর্তি হলো, সে যদি ১০ বছর ওই একই স্কুলে পড়ে তবে ওই দশ বছরে দশবার তাকে একই স্কুলে প্রতিটা শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি হতে হবে এবং সেই ভর্তি ফি দশ হাজার থেকে ২৮-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপর তাকে বই-খাতা ও স্টেশনারি, ড্রেস, জুতা বাবদ আরও ব্যয় করতে হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।

এই টাকা স্কুলের মান ও মাধ্যম (ইংরেজি, ইংলিশ ভার্সন ও বাংলা) ভেদে আরও বাড়বে বৈ কমবে না। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে একজন অভিভাবককে বছরের শুরুতে তার স্বাভাবিক আয়-ব্যয়ের খরচের বাইরে এই বাড়তি খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষাকে বাণিজ্যে রূপ দেওয়া এসব স্কুল বই-খাতা, স্টেশনারি ও ড্রেস কেনার সুযোগ অভিভাবকের হাতে না দিয়ে সেগুলো তাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে রাখে।

যেখানে একজন প্লে বা নার্সারি শ্রেণির ছাত্রের পাঁচটা ফটোকপি বর্ণমালা ও ছবি আঁকার বই ১২০০ থেকে ২৪০০ টাকায় কিনতে অভিভাবককে বাধ্য করা হয়। এক বছরের কলম, পেন্সিল, রং পেন্সিল, ইরেজার, শার্পনার,  স্কেল, কাগজ, পোস্টার কাগজ, অফসেট পেপার, আর্ট পেপার, জল রং, তেল রং, টিস্যু পেপার ইত্যাদি রসদ একবারে কেনার টাকা স্কুলে জমা দিতে হয়।

এছাড়া স্কুলগুলোর ধরিয়ে দেওয়া লম্বা বইয়ের লিস্ট তো আছেই। এবং এ সবই কিনতে হবে প্রথম মাসের নির্দিষ্ট তারিখের ভেতরেই। এরপর আছে মাসের-পর-মাস ইউটিলিটি ফির নামে টিউশন ফির সঙ্গে নতুন নতুন ফি যোগ হওয়ার হ্যাপা। এরপর স্কুলের শ্রেণিকক্ষে কী পড়াবে কে জানে! অভিভাবককে তার সন্তানের ভালো ফলের আসায় ছুটতে হবে কোচিং সেন্টারগুলোতে। এবং বলাই বাহুল্য, কোচিং সেন্টারগুলোর খরচ স্কুলের তুলনায় দ্বিগুণ এবং বেশিরভাগ কোচিং সেন্টারের শিক্ষক ওই স্কুলেরই শিক্ষক-শিক্ষিকা।

এখন প্রশ্ন থেকে যায় যে, এই একই শিক্ষক যখন কোচিংয়ে ছাত্রছাত্রীকে এত ভালো বোঝাতে সক্ষম হচ্ছেন, তবে শ্রেণিকক্ষে বোঝাতে সমস্যাটা কোথায়? যে ছাত্র বুঝবে না তার তো কোনো জায়গায়ই বোঝার কথা না! আর যে বুঝবে তার তো সর্বত্রই বুঝতে পারার কথা- যদি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাটা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়! 

এ তো গেল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত অভিভাবকদের সন্তানের শিক্ষা খাতে ব্যয়ের একটা ন্যূনতম চিত্র। নিম্ন আয়ের অভিভাবক, যারা তাদের সন্তানকে সরকারি-আধা সরকারি বিদ্যালয়গুলোতে পড়তে পাঠান তারা কতটা সুলভে পান শিক্ষাটা? সরকারি বা বেসরকারি স্কুলে পড়তে গেলে যে শিক্ষাটা সুলভে পাওয়া যাবে এই ধারণা এখন ঠিক না। সেখানেও ভর্তি খরচের নামে এক ডাকাত বসে আছে।

শ্রমজীবী বা নিম্ন আয়ের মানুষকে বছরের শুরুতেই ভিক্ষুক বানিয়ে দেয় এই বেনিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা। স্কুলের বাইরে নিম্ন আয়ের এসব অভিভাবকের সন্তানদেরও প্রতিটি বিষয়ে কোচিং করাতে হয়। পাঠ্যবইয়ের বাইরে বাধ্যতামূলকভাবে কিনতে হয় কয়েক হাজার টাকার গাইড বই, নতুন স্কুল ড্রেস ইত্যাদি। সরকারি স্কুলগুলোতে উপবৃত্তির টাকা অনেক সময় স্কুলে কোচিংয়ের নামে কেটে নেওয়া হয়। 

ফলে আমাদের শহর ও নগরের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বাবা-মায়েরা সন্তানকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে গিয়ে জীবনের সব সাধ বিসর্জন দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তবু শেষরক্ষাটা হচ্ছে কি? একটা বিশ্বমানের শিক্ষা এদেশের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে কি? 

বিশ্ব ব্যাংকের ‘লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশন প্রমিজ ২০১৮’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের স্কুলগুলো শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে এগিয়ে থাকলেও মানের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। প্রাথমিক স্তরে ১১ বছর পর্যন্ত যা শেখানো হচ্ছে, তা মূলত অন্যান্য দেশের বাচ্চারা সাড়ে ছয় বছরের মধ্যে শিখছে। শিক্ষা কার্যক্রমের অনুন্নত মানের কারণে ১১ বছরের মধ্যে সাড়ে চার বছরই গচ্চা যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে আজও সরকারি প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার মান যেখানে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে সেখানে অভিভাবকদের বাধ্য হয়ে বেসরকারি স্কুলে ছুটতে হচ্ছে। 

গত কয়েক বছরে শিক্ষা কারিকুলামে একের পর এক পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে শিক্ষার মান ও গুণগত পরিবর্তন খুব একটা  হয়নি। বরং ছাত্র-ছাত্রীদের গাইড বই, কোচিং ও গৃহশিক্ষকের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়ে চলেছে । 

এই দেশের নগরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এত বেশি যার সিংহভাগই ব্যয় হয় শিক্ষা খাতে, যা বিশ্বের অন্য কোথাও বিরল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আগেই পণ্য হয়েছে এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিলে তিলে দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ শিক্ষাকে পণ্য করার প্রতিযোগিতায় নামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাস টেনে ধরার নেই কোনো ব্যবস্থা। উপরন্তু  অভিভাবকের কাছে শিক্ষা আজ হয়ে পড়েছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //