মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী

মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কথা বলব। তার আগে দুনিয়াতে কীভাবে মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল তার বাস্তব ইতিহাস নিয়ে একটুখানি গল্প করে নিই। 

এক. 

বিজ্ঞানীদের মতে, বিবর্তনের ধারায় পৃথিবীতে মানুষের উৎপত্তি শুরু ২৫ লাখ বছর আগে। তবে মানুষের উৎপত্তি একটিমাত্র প্রজাতি হিসেবে হয়নি। হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতি হিসেবে। আবার সব প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি একই অঞ্চল বা সময়ে হয়নি। হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন সময়ে। বিবর্তনের ধারায় একটি প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি যদি হয়ে থাকে ২৫ লাখ বছর আগে, তাহলে আরেকটি প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছে তার ১ লাখ বা ২ লাখ বছর পর। এভাবে আরও ৩ লাখ, ৫ লাখ বা ১০ লাখ বছর আগে।

এক্ষেত্রে যে বিষয়টি পরিষ্কার থাকতে হবে সেটি হলো- পৃথিবীতে প্রথমে একটি প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছে এবং পরে ওই প্রজাতি থেকেই ধারাবাহিক বংশানুক্রমিকভাবে অন্যান্য সব প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছে, ব্যাপারটি কিন্তু সেরকম নয়। আসলে প্রত্যেকটি প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে, প্রত্যেকের নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে। 

বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর নানা অঞ্চলের মাটি খুঁড়ে পাওয়া লাখ লাখ বছর আগের বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের দেহাবশেষের ফসিল বা জীবাশ্ম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অন্তত ৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন। এগুলো হলো- ১. রুডল ফেনসিস, ২. সোলেফেনসিস, ৩. ইরেস্টাস, ৪. ইরগেস্টার, ৫. ফ্লোরেনসিয়েন, ৬. ডেনিসোভা, ৭. নিয়ান্ডার্থাল এবং ৮. সেপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ। এই সেপিয়েন্স প্রজাতিরাই আজকের পৃথিবীর মানুষের আদি পূর্বপূরুষ। প্রজাতিগুলোর নাম কোনো মনগড়া নয়। যে প্রজাতির মানুষের যে অঞ্চলে উৎপত্তি হয়েছে, সেই সেই অঞ্চল, দ্বীপ, নদী, হ্রদ, পাহাড়, গুহা ও উপত্যকার নাম অনুসারে তাদের নামকরণ হয়েছে। 

এখন প্রশ্ন হলো, এই ৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির মানুষেরা যে লাখ লাখ বছর পৃথিবীর বুকে বিচরণ করল এবং সর্বশেষ প্রজাতি সেপিয়েন্স মানুষের দৃপ্ত পদচারণায় এখনো যে পৃথিবী প্রকম্পিত হচ্ছে- এই সবগুলো প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল কোথা থেকে? এক কথায় এর উত্তর হলো এই সমস্ত প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছে ‘Ape’ (অ্যাপ) নামের এক প্রাণিকুলের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণির  ‘Ape’ থেকে।

বিজ্ঞানীরা এই প্রাণিকুলের নাম দিয়েছেন ‘Great Ape’, অর্থাৎ অনেক প্রকারের ‘Ape’-এর সমষ্টি। যার বাংলা করা হয়েছে বানরজাতীয় প্রাণিকুল। তবে মানুষের উৎপত্তি কিন্তু বানর থেকে হয়নি। আসলে Great Ape-এর মধ্য থেকে একশ্রেণির Ape হুবহু মানুষের মতো না হলেও অনেকটা মানুষের কাছাকাছি আকৃতিতেই ছিল, যারা বিবর্তনের ধারায় বিশেষ প্রয়োজনে দুই পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে পারত এবং বেশ কিছুদূর হাঁটতেও পারত। তাদের মাথাও অপেক্ষাকৃত বড় ছিল। বিজ্ঞানীরা এই শ্রেণির অঢ়ব-এর নাম দিয়েছেন অস্ট্রালোপিথেকাস (Australopithecus)। 

বিজ্ঞানীরা সেই কালের প্রাণিকুলের ফসিল ও ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল যে বিশেষ শ্রেণির Ape থেকে সেই একই Ape থেকে উৎপত্তি হয়েছে শিম্পাঞ্জি, বুনোবো এবং ওরাং ওটাং নামের প্রাণীর। সে কারণে শিম্পাঞ্জিদেরকে বলা যায় মানুষের আদিমকালের জ্ঞাতিভাই, কিন্তু বানরেরা কখনোই নয়। বরং একথাও বলা যায় যে, মানুষের উৎপত্তি হয়েছে Ape নামের অনেকটা মানুষ আকৃতির এক ধরনের ‘আদিমতম মানুষ’ থেকেই।  

দুই. 

উপরে যে ৮টি প্রজাতির মানুষের কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে বুদ্ধি, চালাকি ও কর্মতৎপরতায় সেপিয়েন্স মানুষেরা হয়ে উঠেছিল, অন্যান্য প্রজাতির তুলনায় অনেক উন্নত। বিজ্ঞানীদের মতে বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা মস্তিষ্কের বিশেষ গড়ন, ‘জিনগত’ বৈশিষ্ট্য এবং সর্বোপরি ভাষাকে সৃজনশীলতা দিয়ে নানাভাবে ব্যবহার করতে পারার দক্ষতার কারণেই সেপিয়েন্সরা সবার থেকে উন্নত প্রজাতির মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছিল, যা অন্যান্য প্রজাতির মানুষরা পারেনি।

তারপরও তারা শিকারের জন্য পাথরের নানা রকমের অস্ত্র বানাতে পারত। আগুনের আবিষ্কারও হয়েছিল তাদেরই হাতে। প্রায় তিন লাখ বছর আগে (সেপিয়েন্স মানুষের উৎপত্তিরও আগে) ইরেস্টাস এবং নিয়ান্ডার্থাল প্রজাতির মানুষেরা শিকার করা পশুর মাংস পুড়িয়ে খাওয়াসহ প্রায় প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে আগুনের ব্যবহার করত। 

কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, সবার শেষে উৎপত্তি একমাত্র সেপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ বাদে অন্য সকল প্রজাতির মানুষ প্রাকৃতিক এবং আরও নানাবিধ কারণে পৃথিবীর বুক থেকে চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে তাদের মধ্যে কোনো প্রজাতি ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ, আবার দু-একটি প্রজাতির মানুষ ১০-১৫ লাখ বা আরও বেশি বছর টিকেছিল। নিয়ান্ডার্থাল মানুষেরা টিকেছিল ২০ লাখ বছর। এমনকি আজ থেকে দেড় লাখ বছর আগেও নিয়ান্ডার্থাল মানুষ পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বসবাস করেছে। বিশেষজ্ঞ-গবেষকরা মনে করেন যে, অপেক্ষাকৃত বেশি বুদ্ধিমান, ধূর্ত ও দস্যুপ্রকৃতির সেপিয়েন্স মানুষেরা দীর্ঘ দিনের গণহত্যার মাধ্যমে নিরীহ, শান্তিপ্রিয় নিয়ান্ডার্থালদেরকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করে দিয়েছে। 

তিন. 

এতক্ষণ অতিসংক্ষিপ্তাকারে প্রাগৈতিহাসিক কালের বিভিন্ন প্রজাতির মানুষ ও উৎপত্তি নিয়ে যে বাস্তব গল্প বলা হলো তার উদ্দেশ্য হলো, আজকের একুশ শতক পর্যন্ত টিকে থাকা সেপিয়েন্স প্রজাতির মানুষদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু কথা বলা। 

পৃথিবীর আজকের মানুষদের আদি পূর্বপুরুষ সেপিয়েন্স প্রজাতির মানুষের উৎপত্তি হয়েছিল দেড় লাখ বছরেরও কিছু আগে। সে হিসেবে পৃথিবীর আজকের মানবজাতির বয়স দেড় লাখ বছরের কিছু বেশি। অতীতের অন্যান্য প্রজাতির মানুষদের সঙ্গে তুলনা করলে সেপিয়েন্সদের (আমাদের) হয়তো আরও ১০-১৫ লাখ বছর টিকে থাকার কথা।

কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, জিনগত ও অন্যান্য কারণে সেপিয়েন্স মানুষদের স্বভাব এতই লোভী, অহংকারী ও ধ্বংসাত্মক যে, এককালে তারা নিরীহ শান্তশিষ্ট নিয়ান্ডার্থাল মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়ে সমূলে নিশ্চিহ্ন করেছে, এখন বহুমাত্রিকভাবে মানবসভ্যতার প্রভূত উন্নতির পাশাপাশি যে চরম বিকৃতি ও বৈকল্য দৃশ্যমান, তাতে এরা নিজেরাই নিজেদেরকে মাত্র কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে।

কথাটা সত্য বটে। পৃথিবীতে মানুষের হাতে আজ যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ আছে এবং অদূরভবিষ্যতে এই মজুদ আরও যে হারে বৃদ্ধি পাওয়ার আশংকা রয়েছে, তা দিয়ে অন্তত দুটি পৃথিবীর মানুষকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। বার্ট্রান্ড রাসেল, ভবিষ্যতে পৃথিবীতে পারমাণবিক বোমার চেয়েও আরও ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক ‘কোবাল্ট বোমা’র আতঙ্কের কথা বলেছেন, যে বোমার মাত্র কয়েকটির বিস্ফোরণ ঘটলে গোটা পৃথিবীতে মানুষের আর কোনোই অস্তিত্ব থাকবে না।

তদুপরি সীমাহীন অর্থসম্পদ বৃদ্ধির লোভে মানুষ প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে যেভাবে এবং যে হারে ধ্বংস করে চলেছে, তাতে কয়েক হাজার বছর নয়, মাত্র এক হাজার বছরের মধ্যেই পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলোপ হয়ে যেতে পারে। এভাবে সেপিয়েন্স মানুষেরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করার এক ‘মহোৎসবে’ মেতে উঠেছে। 

তবে উদ্বেগ ও হতাশার মধ্যেও এই মহাসংকট নিয়ে আমরা অন্যভাবেও চিন্তা করতে পারি। মানবজাতির, কয়েক হাজার বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অর্থ এ-ও হতে পারে যে, ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বাঁচার জন্য আমরা লড়াই করার অন্তত কয়েক হাজার বছর সময় পাচ্ছি। কয়েক হাজার বছর নেহাত কম সময় নয়। এর মধ্যেই আমরা বিপর্যয়ের কার্যকারণগুলো খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী বাঁচার লড়াই করতে পারি।

মানবপ্রজাতির আজকের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্য প্রধানত দায়ী যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ও সমাজব্যবস্থা, তা ইতোমধ্যে আমরা শনাক্ত করেছি এবং তার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে লড়াইও জারি রয়েছে। সে হিসাবে আমরা দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি, আগামী পাঁচ থেকে ছয়শ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে পুঁজিবাদী সমাজের অবশ্যই বিলোপ ঘটবে। বিলোপ ঘটবে সকল প্রকারের ফ্যাসিবাদ, শোষণ, লুণ্ঠন ও প্রভুত্বকামী শাসনব্যবস্থার। এর ফলে মানবজাতির ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কাজ অর্ধেকেরও বেশি সম্পন্ন হয়ে যাবে। 

আমাদের ধ্বংসোন্মুখ অবস্থার জন্য আরও দায়ী হচ্ছে অতিশয় লোভ, ঘৃণা, বিদ্বেষ, অহংকার, কুসংস্কার এবং মূর্খতা। এগুলো বাইরে থেকে আরোপিত কোনো সংকট নয়। বার্ট্রান্ড রাসেলের ভাষায়- “ভাগ্যের বিধান নয়, এর সব কিছুই মানুষের মূর্খতাপ্রসূত। প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এ পাপ উঠে এসেছে মানুষের মনের গভীর থেকে, যার উৎস নিহিত আছে অতীতের নিষ্ঠুরতা আর কুসংস্কারের গহনে। ...অসুখের উৎস নিহিত আছে আমাদের অন্তরের গভীরে। অন্তরের সেই অন্তস্তল থেকেই উপড়ে ফেলতে হবে তাকে।” 

আজকের বিজ্ঞানীদের মতে, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, বিশেষত বায়ো-টেকনোলজির অবিস্মরণীয় বিকাশের স্তরে মানুষের জিনগত ত্রুটিগুলো অদূরভবিষ্যতে অবশ্যই পুরোপুরি শুধরানো সম্ভব হবে। আশার কথা এই যে, আজকের পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের জিন হয়তো এখনো পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠেনি। কারণ তারা মানবজাতির মুক্তি চায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম লাখ লাখ বছর এই সুন্দর পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়।

লেখক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //