আসাদের মৃত্যুপরবর্তী অর্জিত শিক্ষা

একটি স্ফুলিঙ্গই পারে দাবানল সৃষ্টি করতে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির ধূমায়িত বিক্ষোভ যখন বিক্ষিপ্তভাবে দেশজুড়ে চলছে, সে সময় আসাদের আত্মদান এক মাইলস্টোন হয়ে ওঠে।

পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে আসাদ বুকে গুলি নিয়ে শহীদ হলেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন পেল নতুন গতিবেগ। উত্তাল আন্দোলন-সংগ্রামের সেই গৌরবোজ্জ্বল পরিসমাপ্তি হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানের নিগড় থেকে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করে।

পাকিস্তানি শাসকের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদের মৃত্যুর ৫৪ বছর পূর্ণ হলো। এই ৫৩ বছর পর আজকের বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, আসাদের আত্মদানকে জাতি কীভাবে স্মরণ করছে, তার স্বপ্নের পূর্ববাংলা আজকের বাংলাদেশ হয়ে তাকে কতটুকু ধারণ করছে সে প্রশ্ন উঠবে সঙ্গত কারণেই।

আসাদ ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবী নেতা। তিনি একাধারে যেমন ছাত্র আন্দোলন করতেন তেমনি কৃষক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। ১৯৬৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী যে হাট হরতালের ডাক দিয়েছিলেন, নিজ বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী থেকে সেই হাট হরতালে অংশগ্রহণ করেছিলেন আসাদ।

এ কারণে পুলিশি হামলার শিকার হয়ে গুরুতর আহতও হয়েছিলেন সে সময়। পরে মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই ঢাকায় এই খবরটি দিতে আসেন। তার কিছুদিন পরেই নিজে গুলিবিদ্ধ হলেন। সে সময় দৈনিক পাকিস্তানে নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘আসাদ এসেছিল খবর দিতে আর আসাদ আজকে এলো খবর হয়ে।’

১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রদের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে ছাত্র সংগঠনের নেতারা। সেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন আসাদ। পরে ১৭ জানুয়ারি ছাত্রনেতারা দেশব্যাপী সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দিলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ১৪৪ ধারা আইন জারি করেন। তার তিন দিন পরই ২০ জানুয়ারি আসাদ গুলিবিদ্ধ হন। আসাদ সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

আসাদের এই মত্যুর খবর পেয়ে তার সহযোদ্ধারা সেদিন ছুটে যান। তাদের জানানো হয় যে ১৪৪ ধারা ভাঙার কারণে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছে। মিছিলের প্রথম সারিতেই তিনি ছিলেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আসাদের মৃত্যুর খবর দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবির সপক্ষে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামিদের মুক্তি দাবির যে আন্দোলন চলছিল সে অবস্থায় আসাদের মৃত্যু সবাইকে নাড়িয়ে দেয়।

যা পরবর্তী সময় বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। আসাদের মতো একজন জনপ্রিয় বিপ্লবী ছাত্রনেতাকে হত্যার ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে একটি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন একটি অন্য স্তরে উন্নীত হয়। ফলস্বরূপ ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার দুমাসের জন্য ১৪৪ ধারা আইনপ্রয়োগ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আগরতলা 

মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এর পরই স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।

আসাদের গায়ের জামা দিয়ে পতাকা তৈরি হয়। তার লাশ শহীদ মিনারে রেখে শপথ নেয় ছাত্ররা, ‘আসাদ তোমার রক্ত বৃথা যেতে দেবো না।’ পল্টনে দাঁড়িয়ে ২১ তারিখ হরতালের ঘোষণা দেয়া হয়। ২১ জানুয়ারি পল্টনে ২২ থেকে ২৪শে জানুয়ারি পর্যন্ত পরবর্তী তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেদিন সেখানে মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন।

২২ তারিখ এমন কোনো বাড়ি নেই যেখানে কালো পতাকা ওঠেনি। ২৩ তারিখ সন্ধ্যার পর হয় মশাল মিছিল। তৎকালীন আজাদ পত্রিকায় যার শিরোনাম হয়েছিল ‘স্মরণকালের বৃহত্তম মশাল মিছিল’। এরপর ২৪শে জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়। পল্টনে লক্ষ লক্ষ লোক জমায়েত হন। মতিউর, মকবুল, রুস্তম ও আলমগীর- এই চারজনকে গুলি করে হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রাজপথে নেমে এলো। আগরতলা মামলার সাক্ষী, তৎকালীন মন্ত্রী, এমনকি বিচারপতির বাড়িতেও মানুষ আগুন লাগিয়ে দিল।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম দশকে রাজনীতির ভিত্তিটি ছিল ভীষণ রকমের নড়বড়ে, সংসদীয় গণতন্ত্রের কলকব্জা কাজ করছিল না ঠিকঠাক। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে ক্ষমতায় চলে আসেন আইয়ুব খান। রাজনীতিবিদদের ধরে জেলের অন্ধকারে নিক্ষেপ করা হয়ে ওঠে নিয়মিত ব্যাপার। এক বছরের মাথায় আইয়ুব খান চালু করেন বেসিক ডেমোক্রেসি বা মৌলিক গণতন্ত্র।

পাকিস্তানের দুই অংশে ইউনিয়ন বোর্ডকে ‘ইউনিয়ন কাউন্সিল’ নাম দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের দুই অংশ থেকে চল্লিশ হাজার করে মোট আশি হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদেরকেই মৌলিক গণতন্ত্রী বা বেসিক ডেমোক্র্যাট হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।

একই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান এক অদ্ভুত গণভোটের আয়োজন করলেন। এই আশি হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর প্রেসিডেন্ট হিসেবে আইয়ুব খানের উপর তাদের আস্থা আছে কিনা তা ছিল ভোটের উদ্দেশ্য। ৯৬.৬ শতাংশ মৌলিক গণতন্ত্রীর ‘হ্যাঁ’ ভোটে ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।

১৯৬৫ সালের একই ধরনের মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটের উপর ভিত্তি করে আবারও নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। আইয়ুব খানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন ফাতেমা জিন্নাহ। নির্বাচনে প্রায় সব বিরোধী দল মিলে ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ফাতেমা জিন্নাহর হয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় শেখ মুজিবুর রহমান আইয়ুব খানের কঠোর সমালোচনা করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। 

১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে ৫৩.১২ শতাংশ আর পশ্চিমে ৭৩.৫৬ শতাংশ ভোটে জিতে যান আইয়ুব খান। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামক প্রহসনের মাধ্যমে বিশাল জনগণকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মূলত এর মাধ্যমেই শেখ মুজিবকে রাজনীতি থেকে বাইরে ছুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। 

ক্রমাগত ধরপাকড়ের সম্মুখীন হয়ে আওয়ামী লীগ আর বড় সব রাজনৈতিক দলের সাংগঠিক কাজ চালিয়ে যাওয়াই কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। তাই আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে উঠে আসে ছাত্রসমাজ। ১৯৬৯ সালে জানুয়ারিতে এগারো দফা নিয়ে আন্দোলনে আসে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। মওলানা ভাসানী আর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করেছিল।

১৭ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করায় পুলিশ ছাত্রদের উপর হামলা করে। এর প্রতিবাদে ১৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয় ছাত্র ধর্মঘট। ব্যাপক ধরপাকড় আর গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে থাকে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের কর্মসূচি। সরকারি নির্যাতন বন্ধ, আটক ছাত্রদের মুক্তি আর এগারো দফার দ্রুত বাস্তবায়নে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২০ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়।

ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ছাত্রদের মিছিল বের হয় ধর্মঘটের সমর্থনে। মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ঠিক সামনের রাস্তাটি আসাদের রক্তে লাল হয়ে যায়। সেই মুহূর্ত থেকেই আইয়ুব খানের পতনের দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। এই হলো আসাদের আত্মত্যাগের পূর্বাপর ঘটনা প্রবাহ। 

আজকে আসাদের শহীদ হওয়ার ৫৩ বছর পরের বাংলাদেশ কার্যত সেই ১৯৬৯ সালের মানুষের চেতনার ধারাবাহিকতায় নেই। নির্মম সত্য হলো একজন আসাদ বা মতিউরের মৃত্যু যেভাবে সমগ্র সাধারণ জনগণকে রাজপথে নামিয়ে এনেছিল তার পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক ছিল পরাধীনতার শেকল ছেঁড়া। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সেই শেকল ছিঁড়েছে। এখন বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম। তাহলে আর সমস্যা কোথায়? হ্যাঁ সমস্যা আছে।

আসাদের মৃত্যু পরবর্তী গণ-অভ্যুত্থান এবং এরপরের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধ করে ত্রিশ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ এসেছে তা জনগণের স্বাধীনতার উদগ্র বাসনা মেটাতে পারলেও সাধারণ মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার মেটাতে পারেনি। পারেনি একাত্তর পরবর্তী শাসকদের গণবিরোধী চরিত্রের কারণে।

দেশে আজ হাজার হাজার কোটিপতি গজিয়ে উঠেছে। হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। পাকিস্তানের কুখ্যাত বাইশ পরিবারের জায়গায় এখন নিজ দেশের বাইশ হাজার পরিবার। আপাত চকচকে ঝকঝকে দেশের উপরিকাঠামো দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরে কীভাবে গ্যাংগ্রিনের মতো ক্ষত তৈরি হয়েছে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও কোটি কোটি মানুষ ফুটপাথে দিন কাটাতে বাধ্য হয়। টিসিবির স্বল্পমূল্যের ট্রাক সেলে শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে পণ্য কিনতে বাধ্য হয়। এত বছর পরও অভাবে মৃত্যু হয় না ঠিকই কিন্তু পেটের সন্তান বেঁচে দেওয়া, অভাবে আত্মহত্যা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। 

আসাদের শহীদ দিবসে আজকের দিনে তরুণদের মধ্যে, যারা রাজনীতি করছেন, তাদের বোঝা উচিত আসাদের মতো আত্মত্যাগ শুধু শুধু আসেনি। এর পেছনে যে গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আছে, সে কারণেই এসেছে। আজকে এই জাতির দমবন্ধ দশায় আমাদের প্রজন্ম থেকে একজন-দুজন নয়, অসংখ্য আসাদের জন্ম হওয়া সময়ের দাবি।

 সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //