তবলিগের বিভক্তি দূর হোক

২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হলো এবারের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। ১৫ জানুয়ারি প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০২০ সালেও ঢাকায় তবলিগের বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারও আগে ইজতেমা দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হওয়ার নজির আছে। তবে তা ছিল লোকসমাগম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে।

বাংলাদেশের জেলাগুলোকে দুই ভাগ করে প্রথম পর্বে এক ভাগের জেলাগুলো থেকে এবং পরের পর্বে বাকি জেলাগুলো থেকে লোকদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তবে ২০২০ সাল ও এবার দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠানের পেছনে রয়েছে তবলিগ জামাতের বিভক্তি। প্রথম পর্বটি পরিচালনা করেছে আলমী শূরা কমিটি। দ্বিতীয় পর্বটি পরিচালিত হয়েছে মাওলানা সা‘দ সমর্থকদের দ্বারা।

এই বিভক্তির কেন্দ্র স্বয়ং তবলিগ জামাতের মূল কেন্দ্র ভারতের রাজধানী দিল্লির নেজামুদ্দিন। মূলত তবলিগের বিশ্ব আমির নির্বাচন ও এই পদে স্বয়ংক্রিয় অভিষিক্ত ব্যক্তির কিছু বক্তব্য ঘিরে বিভক্তিটি সৃষ্টি হয়েছে কয়েক বছর ধরে।

তবলিগ জামাত ইসলাম প্রচারের নতুন ও ইতিবাচক একটি আন্দোলন। এতে বহুল ব্যবহৃত দুইটি শব্দ ‘দাওয়াত’ ও ‘তবলিগ’ মূলত একই মর্ম বহন করে। দাওয়াত অর্থ আহ্বান, তাবলিগ অর্থ পৌঁছানো। ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানানোই দাওয়াত ও তবলিগ। উভয় শব্দের সরল অর্থ ইসলাম প্রচার। দাওয়াত ও তবলিগের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সৎকাজে আদেশ ও মন্দ কাজে নিষেধ। 

আরবের হেজাযভূমিতে আত্মপ্রকাশ করলেও অল্পকালের মধ্যেই ইসলামের আলোকরশ্মি আরব উপদ্বীপ পেরিয়ে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। সঙ্কীর্ণ অর্থে নিছক কিছু আচার অনুষ্ঠানের ধর্ম হিসেবে নয়, নতুন এক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনবোধের বার্তা নিয়ে তা বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থিত হয়। ফলে কয়েক দশকের মধ্যেই তা  বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়।

তবে তা তলোয়ারের জোরে নয়, বরং ইসলামের অনুসারীদের দাওয়াত ও নিষ্ঠাপূর্ণ জীবনাচারে মুগ্ধ হয়ে মানুষেরা এই ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে ইসলামের ব্যাপক ও দ্রুত প্রসারের পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে সুফি দরবেশদের দাওয়াতি কার্যক্রম।

তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্ধপৃথিবীর ওপর মুসলিমদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে বিত্তবৈভবের লোভ ও প্রভাব-প্রতিপত্তির আকাক্সক্ষা মুসলমানের দাওয়াত ও তবলিগের মূল মিশনকে ভুলিয়ে দেয়। সুফিদের তরবিয়াত খানকায় এবং মাদ্রাসার পঠন-পাঠন চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি ব্যতিক্রম ছিল না।

খ্রিষ্টীয় বিংশ শতাব্দীতে ভারতে এমন এক মনীষীর আগমন ঘটে; যিনি ইসলাম প্রচারের নতুন ধারা চালু করেন। তার টার্গেট অমুসলিমরা নয়, স্বয়ং মুসলিমরা। তার পর্যবেক্ষণ ছিল, মুসলমানেরা সারা বিশ্বে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী  হলেও ইসলামের চর্চায় অত্যন্ত অবনতি হয়েছে। তিনি এই ননপ্রাকটিসিং মুসলমানদেরকে প্রাকটিসিং মুসলমানে পরিণত করার মিশন হাতে নেন। তার দরদমাখা আহ্বানের সুফল পরিলক্ষিত হয় অল্পকালের মধ্যে।

তিনি এমন এক জামাতের সূচনা করেন, যে জামাতের সদস্যরা বিশ্বের ১৫০টিরও  বেশি দেশে নিজে ব্যয়ভার বহন করে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছানো এবং মুসলিমকে প্রকৃত মুসলিম তৈরিতে ব্যাপৃত রয়েছেন। ইসলামি ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত সুদীর্ঘ এক হাজার বছরে দেখা যায় না। কোটি কোটি মুসলমানের জীবনে এই জামাত বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে এই মিশন ‘তবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত। আর এই মহান জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী (রহ.)। তিনি ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। 

শিক্ষাকাল সম্পন্ন করার পর তিনি এক পর্যায়ে দিল্লির নেজামুদ্দিন এলাকায় বাংলাওয়ালী মসজিদে ইমামতি নেন। সেখানে মেওয়াত নামক একটি এলাকার অধিবাসীরা যাওয়া-আসা করত। মেওয়াতের ভক্ত-মুরিদগণ তার কাছে মেওয়াত আগমন করার আহ্বান করেন। তিনি তাদের কাছে শর্ত দেন যে, আমি অবশ্যই আসব, তবে তোমরা নিজেদের গ্রামে মক্তব চালু করবে।

মাওলানা ইলিয়াস যখন মেওয়াত গমন করেন সেখানে ১০টি মক্তব প্রতিষ্ঠা করে আসেন। এর কিছু দিনের মধ্যে সেখানে কয়েকশ মক্তব প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে তিনি দ্বিতীয়বার হজ পালনে মক্কা গমন করেন। ফিরে এসে তিনি হতাশ হলেন। মক্তবগুলোতে এক বিশেষ শ্রেণি দ্বীনি শিক্ষার অবদান রেখে চলেছে, কিন্তু মেওয়াতের সাধারণ মুসলমানের মক্তবে গিয়ে দ্বীন শিক্ষা অসম্ভব ছিল।

তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষকে ডেকে দ্বীন শেখানো হবে না, বরং মানুষের কাছে গিয়ে তাদের দ্বীন শেখাতে হবে। এ সময় মেওয়াতে এক বিশেষ সভার আয়োজন করা হয়। তিনি সেখানে  সাধারণ মুসলমানদের ঘর থেকে কয়েক দিনের জন্য বের হয়ে মসজিদে মসজিদে ভ্রমণের ফাঁকে ইসলামের মৌলিক বিষয় শেখা ও চর্চার নিয়ম উপস্থাপন করেন। যারা প্রস্তুত হলো, তিনি তাদের নিয়ে মেওয়াতের পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রথম জামাত  নিয়ে যান। সিদ্ধান্ত নেন পরের জুমা স্থানীয় সোনা মসজিদে আদায় করবেন। এভাবে দাওয়াত ও তবলিগের কাজ শুরু হয় এবং মেওয়াতের অনেক জামাত বিভিন্ন এলাকায় বের হতে থাকে। 

এভাবে তিনি আলীগড়, দিল্লি, বুলন্দশহর, কান্ধলা, সাহারানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে তবলিগের জামাত প্রেরণ শুরু করেন। হযরত মাওলানা ইলিয়াসের ১৮ বছরের দিন-রাতের নিরলস পরিশ্রম আলোর মুখ দেখতে থাকে।  দূর-দূরান্তে জামাত রওনা হওয়া শুরু করে। 

প্রখ্যাত মুসলিম মনীষী সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী (র.) এ প্রসঙ্গে  লিখেছেন- যেখানে কোনো মসজিদ দেখা যেত না, সেখানে গ্রামে গ্রামে মসজিদ তৈরি হয়। দেখতে দেখতে উপমহাদেশে হাজার হাজার মসজিদ তৈরি হয়। অসংখ্য মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। হাফেজের সংখ্যা হাজার থেকে লাখে উন্নীত হয়।

আলেমের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। হিন্দুয়ানি অবয়ব ও লেবাসের প্রতি ঘৃণা এবং ইসলামি লেবাসের মর্যাদা অন্তরে বসে যায়।  অসৎ চরিত্র সংশোধন হতে থাকে, হানাহানি-মারামারি নিঃশেষ হতে থাকে, শিরিক-বিদ’আত, রসম-রেওয়াজ থেকে মানুষ তওবা করতে শুরু করে।

ফকির ও দরবেশি চরিত্রের একজন আলেমে দ্বীন শুধু মেওয়াতে বিপ্লব সংগঠন করেননি বরং তার প্রতিষ্ঠিত মোবারক জামাত পুরো বিশ্বে এমন এক বিপ্লব প্রতিষ্ঠা করেন; যার উদাহরণ ইসলামের ইতিহাসের কোনো পৃষ্ঠা বা পাদটীকায় খুঁজে পাওয়া যায় না।

এই মহান মুবাল্লিগ ও আলেমে দ্বীন  ১২ জুলাই ১৯৪৪ সালে এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। এরপর তার ছেলে মাওলানা ইউসুফ ২৯ জিলকদ ১৩৮৪ হিজরি মোতাবেক ২ এপ্রিল ১৯৬৫ সালে ইন্তেকাল পর্যন্ত এবং তার  পরে তাদের পরিবারের সদস্য মাওলানা এনামুল হাসান ১৯৯৫ সালে ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তবলিগ জামাতের নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।

কিন্তু মাওলানা এনামুল হাসানের মৃত্যুর পর তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য একক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি না থাকায় শূরা সদস্যদের মাধ্যমে তবলিগ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওই শূরা কমিটিতে ভারত ছাড়াও ব্রিটেন, পাকিস্তান ও  বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ছিলেন।

তবে নেজামুদ্দিনের তিনজন সদস্যের একজন মাওলানা ইজহারুল হাসান অল্পকালের মধ্যে ইন্তেকাল করায় তখন সেখানকার সবার সিনিয়র মাওলানা জুবায়েরুল হাসান হওয়ায় কার্যত তিনিই এতে নেতৃত্ব দিতেন। তাকে সহায়তা করতেন মাওলানা সা‘দ সাহেব।

২০১৪ সালে  মাওলানা জুবায়েরুল হাসানের ইন্তেকালের পরেই নেতৃত্বের দাবিদার হন মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর অধস্তন পুরুষ মাওলানা সা‘দ সাহেব। মাওলানা ইলিয়াস সাহেবের ছেলে মাওলানা ইউসুফ, তার ছেলে মাওলানা হারুন, তার ছেলে মাওলানা সা‘দ। মাওলানা এনামুল হাসানের মৃত্যুর পর গঠিত শূরা কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য ইন্তেকাল করলে তাদের শূন্যস্থান পূরন করার পদক্ষেপ নিতে চান প্রবীণ সদস্যরা। 

তারা চেয়েছিলেন তবলিগের শূরাভিত্তিক পরিচালনা অব্যাহত থাকুক। কিন্তু একটি শ্রেণি মাওলানা সা‘দ সাহেবকেই আমির করার পক্ষে শক্ত অবস্থান নেয়। তাদের ভাষ্য, শূরা কমিটিতে নেজামুদ্দিন মারকাজের তিনজন সদস্যের দুইজনই ইন্তেকাল করায় অবশিষ্ট সদস্য মাওলানা সা‘দ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমির হয়ে গেছেন। 

মাওলানা সা‘দের স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমির হয়ে যাওয়া নিয়েই তবলিগ জামাতের দায়িত্বশীল ও প্রবীণ সদস্যদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। কেননা মাওলানা সা‘দ সাহেব শূরাভিত্তিক পরিচালনা পদ্ধতি এড়িয়ে একক নেতৃত্বে কাজ শুরু করেন। তাছাড়া তিনি এমন কিছু বক্তব্য দিতে থাকেন, যা নিয়ে আপত্তি উঠতে থাকে আলেমদের পক্ষ থেকে।

এমনকি মাওলানা সা‘দের এমন কর্মপন্থা ও বক্তব্য নিয়ে নিজামউদ্দিন মারকাজের সিনিয়র ব্যক্তিরা বিরক্ত হয়ে দিল্লি ছেড়ে নিজ নিজ অঞ্চলে চলে যান। ফলে তবলিগ জামাত পরিচালনার দুটি ধারা তৈরি হয়- শূরাভিত্তিক বনাম আমির ভিত্তিক।

তবলিগের মূলকেন্দ্র ভারতে সৃষ্টি হওয়া এই বিভক্তি বিশ্বের প্রায় সব দেশের মতো বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি শূরা কমিটি ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন মাওলানা সা‘দের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখলেও অপর কয়েকজন তার একক নেতৃত্ব মানতে রাজি নন। এতে দেখা দেয় দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের ফল এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয় এবং শেষপর্যন্ত ঢাকার ইজতেমার বিভক্তি ঘটে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও দুই পৃথক ধারা আলাদা করে ইজতেমা করছে।

কিন্তু কারণ যেটাই হোক, এতে স্বয়ং তবলিগ জামাতের এবং বৃহত্তর পর্যায়ে ইসলামের যে সমূহ ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে, তা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। পদবি ও সুবিধার ঊর্ধ্বে উঠে নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে এই জামাতে শামিল হওয়ার যে অনন্য নজির তৈরি হয়েছিল, তা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

সাধারণ মুসলমানদের যে অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভক্তি ছিল তবলিগ জামাতের প্রতি, তা মারাত্মক ক্ষুণ্ন হয়েছে। অরাজনৈতিক ও অহিংস কার্যক্রম হওয়ায় অমুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের দাওয়াতি মিশন যেভাবে দ্রুত সমাদর লাভ করছিল, তাতে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রসারে নতুন জোয়ার দেখা যাচ্ছিল।

কিন্তু নিজেদের বিরোধের কারণে  মুসলমানেরা এখন অমুসলিমদের কাছে ইসলামের  দাওয়াত নিয়ে যেতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন। এই অবস্থার অবসান হওয়া কাম্য। ইসলামের স্বার্থেই নিজেদের মতপার্থক্য বিসর্জন দেয়া শুধু উচিত নয়, সময়ের অনিবার্য দাবিও। আমরা ঐক্যবদ্ধ তবলিগ জামাত ও অভিন্ন বিশ্ব ইজতেমার অপেক্ষায় রয়েছি।

ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //